আলেমদের করুণা পাওয়ার মতো কিছু কি জামায়াত করেছে?

zahirbabor.comজামায়াতে ইসলামীর নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদীর একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে কয়েক দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইয়ে যাচ্ছে। মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের আগে মাসুদ সাঈদী ফেসবুকে লেখেছেন, ‘একজন নিরপরাধ বয়োবৃদ্ধ আলেমকে হত্যার উৎসব দেখে যে সকল আলেম বোবা হয়ে আছেন আল্লাহ তাদেরকে চিরকালের জন্যে বোবা বানিয়ে দিন। আমিন।’ তাদের দলীয় প্রধানের ফাঁসি হয়ে যাবে, তার মনে দুঃখ-কষ্ট, ক্ষোভ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি এর জন্য আলেমদের ওপর বদদুআ দেবেন সেই অধিকার তাকে কে দিয়েছে? তার দল কি আলেম-ওলামার সঙ্গে কখনও সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে? আলেমদের সঙ্গে কাজ করার কোনো ইতিহাস কি এই দলের আছে? সুদিন থাকাকালে অহংকার আর অহমিকায় তাদের ধারেকাছে যাওয়ার সুযোগ ছিল না কোনো আলেমের। এদেশের মূলধারার আলেম-ওলামাকে এই দলটি সবসময়ই তাদের শত্রুজ্ঞান করে আসছে। আলেম-ওলামাও দলটিকে সহীহ ধারার কোনো দ্বীনি আন্দোলন মনে করেন না।
আলেমরা জামায়াতে ইসলামীর বিরোধিতা করে আসছেন সেই পাকিস্তান আমল থেকে। কোনো রাজনৈতিক কারণে নয়, আকিদাগত কারণেই আলেমরা জামায়াতের বিরোধিতা করেন। জামায়াত যার মতাদর্শ লালন করেন সেই মওদুদীর অনেক আকিদা ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনাসহ নানা বিষয়ে মওদুদীর ভ্রান্ত আকিদার ব্যাপারে আলেম-ওলামা বরাবরই সোচ্চার ভূমিকা পালন করছেন। দেশের বিশিষ্ট আলেমরা সম্মিলিতভাবে মওদুদিবাদের বিরদ্ধে ফতোয়াও জারি করেছেন। এক সময় আলেমরা জামায়াত ও মওদুদিবাদের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বৃহত্তম ঐক্যের কথা চিন্তা করে বেশির ভাগ আলেম এক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দিয়েছেন। বিশেষ করে চারদলীয় জোট গঠনের সময় জামায়াতের প্রতি আলেম-ওলামার একটি শ্রেণি কিছুটা নমনীয় হন। তবে আলেমদের অনেকেই এখনও জামায়াতের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে আছেন। জামায়াতের বিরোধিতা করাকে তারা এখনও ঈমানি দায়িত্ব মনে করেন।
আশির দশকের শেষ এবং নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযম আলেমদের সঙ্গে তাদের দূরত্ব কমিয়ে আনার ব্যাপারে কিছুটা উদ্যোগী ছিলেন। এরপর জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের কোনো নেতা আলেমদের সঙ্গে তাদের দূরত্ব কমানোর ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন এটা জানা যায়নি। বিশেষ করে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর জামায়াত নিজেদেরকে এদেশের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামি শক্তি মনে করে ‘ধরাকে সরা জ্ঞান’ করতে থাকে। এমনকি চারদলীয় জোটে থাকা অন্যান্য ইসলামী দলকে কনুই দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে কোণঠাসা করে রাখে। মুফতি আমিনী রহ. বেশ কয়েকবার এ ব্যাপারে হার্ডলাইনে গেছেন। জামায়াতের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে কোনো কোনো সময় জোট হুমকিও দিয়েছেন। তবে জোটনেত্রীর একান্ত ইচ্ছায় শেষ পর্যন্ত চারদলীয় জোট অটুট থাকে।
তবে জোট সরকারের পাঁচ বছর জামায়াত সরকার এবং জোটে দুর্দান্ত প্রতাপ খাটিয়েছে। আলেম-ওলামাকে কোণঠাসা করা, আলেমদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি, তাদেরকে মনোনয়ন না দেয়া, কওমি মাদরাসাগুলো যেন কোনো সুযোগ-সুবিধা না পায় সে ব্যাপারে জোর তৎপরতা চালায়। ফলে যে আলেম-ওলামার আন্দোলনের ফসল চারদলীয় জোট সরকার সেই আলেম-ওলামা সরকারের কাছ থেকে কিছুই পায়নি। দীর্ঘ দিনের দাবি কওমি মাদরাসার সরকারি স্বীকৃতি সেটার একমাত্র বাধা ছিল জামায়াত। তারা মনে করে, এদেশে ইসলামের ঠিকাদারি তাদের একার, আর কারও না। এদের কাজ-কর্ম ও আচরণ দেখে সেটা অনুমান করা যায়। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে তারা নানা লবির মাধ্যমে এটা প্রতিষ্ঠিত করেছে, এদেশে একমাত্র ইসলামি দল জামায়াতে ইসলামী, আর কোনো ইসলামি শক্তি নেই। কওমি মাদরাসাকেন্দ্রিক আলেম-ওলামার যে জাগরণ সেটাকে দমিয়ে রাখার সব চেষ্টা তারা সবসময় অব্যাহত রেখেছে। সুতরাং আলেম-ওলামার কাছ থেকে করুণা আর সহানুভূতির কোনো আশা তারা করতে পারে না।
জামায়াতে ইসলামীকে এখন সাইজ করছে আওয়ামী লীগ; আমি মনে করি এটা তাদের প্রাপ্য ছিল। কারণ এদেশে আওয়ামী লীগকে পুনর্জন্ম দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। ১৯৯৬ সালে জামায়াতের হঠকারী সিদ্ধান্ত, আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটিকে ক্ষমতার স্বাদ পাইয়ে দিয়েছে। শোনা যায়, সেই সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে দহরম-মহরমে মূল ভূমিকা রাখেন জামায়াতের ফরিদপুর অঞ্চলের দুই নেতা। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ২০ বছরের মাথায় সেই দুই নেতাকেই প্রথমে ফাঁসিতে ঝুঁলতে হলো।
যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত নেতাদের বিচার হচ্ছে এতে এদেশের আলেম-ওলামা খুশি এটা কখনও তাদের থেকে প্রকাশিত হয়নি। বরং কোনো কোনো আলেম সুস্পষ্টভাবে এর প্রতিবাদ করেছেন। নাজুক পরিস্থিতির কারণে অনেকেই মুখ খোলার সাহস পাচ্ছেন না। এমনকি দীর্ঘদিন ধরে যে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের ঘরসংসার তারা পর্যন্ত মুখ খুলছে না। সুতরাং আলেম-ওলামা কেন চুপ এ প্রশ্ন উঠানোর নৈতিক অধিকার জামায়াতের কোনো নেতার নেই। রাজনৈতিক কারণে আপনারা নিগৃহীত হচ্ছেন এর জন্য আলেম-ওলামার সহানুভূতি আছে; কিন্তু আপনাদের পক্ষে সোচ্চার হবেন সে আশা করতে পারে না। নিরেট ধর্মীয় ইস্যুতে বিভিন্ন সময় আন্দোলন করতে গিয়ে আলেম-ওলামারাও এদেশে কম নিগৃহীত হননি; আপনাদের সে সময়ের ভূমিকা খুব ভালো ছিল না। সবশেষ হেফাজতে ইসলামের ‘ইখলাসপূর্ণ’ আন্দোলনকে আপনারা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে গিয়ে এটাকে ‘বিতর্কিত’ করেছেন। তাছাড়া ফাঁসির মুখ থেকে নেতাদের বাঁচানোর জন্য আপনার এমন কোনো কৌশল নেই যা অবলম্বন করেননি, কিন্তু কোনো দিন কি এদেশের আলেম-ওলামা, পীর-দরবেশদের দরবারে গেছেন? আগে নিজেদের ত্রুটিগুলো শুধরান, কথিত ইসলামি আন্দোলনের পথ ছেড়ে খালেস ইসলামি আন্দোলনের পথ ধরুন, তখন আপনাদের সঙ্গে পাবেন এদেশের আলেম-ওলামাসহ সর্বস্তরের মানুষকে।

3 Comments

  1. আরাফাত said:

    মাশাআল্লাহ, খুবই সময়োপযুগী একটি বিশ্লেষনধর্মী গুরুত্বপুর্ণ লেখা!

  2. hasan beruny said:

    শুকরিয়া মুহতারাম ৷ আপনার লেখা নিঃসন্দেহে “বাঁশের কলমদানি” ৷

*

*

Top