নিঃসীম রূপালী জলরাশির সাগরকন্যা (২)

K 3দুপুর পেরিয়ে বিকেল ছুঁইছুঁই। আমরা পৌঁছে গেছি সাগরকন্যা কুয়াকাটায়। যেহেতু রানা ভাই সঙ্গে আছেন নো টেনশন। তিনি এর আগে কত বার যে এসেছেন তা হিসাব কষে বলতে পারবেন না। কুয়াকাটায় তার দাদার রেখে যাওয়া জমি আছে। আত্মীয়-স্বজনও আছেন এখানে। কোন হোটেলে উঠব সেটা তিনিই ঠিক করবেন। যেহেতু অফ পিক সিজন হোটেল মিলল সহজেই। সৈকতের গর্জন শোনা যায় এমন কাছের একটি হোটেলে উঠলাম আমরা। গোসল সেরে একটু ফ্রেস হয়ে রানা ভাইয়ের পূর্বপরিচিত এক চাচার রেস্টুরেন্টে গেলাম খেতে। সমুদ্রের তাজা মাছের স্বাদ, চাচার আন্তরিকতা, পেটের ক্ষুধা সবকিছুর কারণে খাওয়াটা সম্পন্ন হলো বেশ তৃপ্তির সঙ্গে। বিল দিতে গিয়ে দেখলাম যে কোনো পর্যটনস্পটের চেয়ে এখানে খাদ্যের দাম তুলনামূলক কম।

হোটেলে ফিরে ক্লান্তিতে গা এলিয়ে দেয়ার মন চাচ্ছিল। কিন্তু সে সময় নেই। এখনই সৈকতে না গেলে øিগ্ধ মন উজাড় করা সামুদ্রিক সৌন্দর্য দেখতে পাব না। সাগরকন্যা দেখতে এসে হোটেলে অলস বিকেল কাটানোর মানে হয় না। আমরা ছুটলাম সৈকতে। সাগরকন্যা কুয়াকাটা দেখার স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আনন্দে মনটা থেকে থেকে নেচে উঠছে। সৈকত টানে না এমন লোক খুঁজে পেতে কষ্ট হবে। সে সৈকত যদি হয় বিরল কিছু বৈশিষ্ট্যের ধারক তাহলে তো কথাই নেই।
হ্যাঁ, সাগরকন্যা কুয়াকাটা বিরল বৈশিষ্ট্যের একটি সৈকত। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র সৈকত যেখান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়। সমুদ্রের পেট ছিড়ে সূর্য উদয় হওয়ার এবং সমুদ্রের বক্ষে সূর্যকে হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে পারা নিঃসন্দেহে ভাগ্যের ব্যাপার। বঙ্গোপসাগরের ১৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এ সৈকতের অবস্থান। একমাত্র কুয়াকাটা সৈকত থেকেই সাগরের নানা রূপ সারা বছরই উপভোগ করা যায়। তাই বিভিন্ন ঋতুতে পর্যটকদের ভিড়ে মুখরিত হয়ে থাকে এ সৈকত। এখানে আবিজাত্য ও কৃত্তিমতার ছাপ একটু কম। এজন্য প্রাকৃতিক একটা পরিবেশ অনুভব করা যায়।

সূর্য ডোবার তখনও অনেকটা বাকী। আমরা চারজন দাঁড়িয়ে আছি সৈকতে। আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখে আশঙ্কা করেছিলাম হয়ত কুয়াকাটা এসেও দেখা হবে না সূর্য ডোবার অপূর্ব দৃশ্য। কিন্তু এখন মেঘ কেটে গেছে। পশ্চিম দিগন্তটা অনেকটাই পরিচ্ছন্ন মনে হচ্ছে। পশ্চিমের আকাশ থেকে মেঘ আস্তে আস্তে সরে যাওয়অ মানে আমাদের মনের মেঘও সরে যাওয়া। কুয়াকাটা সৈকতের প্রধান আকর্ষণ সূর্য ডোবার দৃশ্য একটু পরেই উপভোগ করবÑসে আনন্দ তো আর ধরে রাখা যায় না।

সৈকত সবার মনে অন্য রকম অনুভূতির সৃষ্টি করে। পৃথিবীর আর কোনো স্থানের সঙ্গে সৈকতের তুলনা চলে না। সাগর যেমন বিশাল সৈকতে দাঁড়ালে মনটাও তত বিশাল করে দেয়। সাগরতীরে প্রাণখুলে দাঁড়ালে মনটা অনেকটাই স্বচ্ছ, নিষ্কলুষ ও ভারমুক্ত হয়ে যায়। ফেনিল হাওয়া আর উত্তাল ঢেউয়ের মৃদু চুম্বন দেহমনকে সব আবিলতা থেকে মুক্ত করে যেন সজীবতা ও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরে দেয়।

কুয়াকাটা সৈকতের ভিড়টা সহনীয় পর্যায়ের। অফপিক সিজন হওয়ার কারণে ভিড় আরো কম। বছরের ৩১ ডিসেম্বর ছাড়া এত উপচে পড়া ভিড় কুয়াকাটায় কখনও থাকে না। যাতায়াতব্যবস্থা উন্নত না হওয়া এবং পর্যটন সুবিধার ঘাটতির কারণে কক্সবাজারের মতো কুয়াকাটা জমে ওঠেনি। কক্সবাজারের সঙ্গে কুয়াকাটার মোটাদাগে পার্থক্যটা হলো, কক্সবাজার একটি জেলা শহর। আর কুয়াকাটা ইউনিয়ন থেকে মাত্র পৌরসভায় উন্নীত হয়েছে। এজন্য কক্সবাজারের সঙ্গে কেউ কুয়াকাটার তুলনা করতে চাইলে আশাহত হবেন। দেশের শীর্ষ পর্যটন স্পট হওয়া সত্ত্বেও কুয়াকাটার মানুষগুরো এখনও তেমন বদলায়নি। সেই গ্রাম্য আমেজ, লৌকিকতাহীনতার সুস্পষ্ট একটা ছাপ তারা ধরে রেখেছে। তবে কুয়াকাটা এসে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা কম।K 4

সৈকতে অসংখ্য মোটর সাইকেল আনাগোনা করছে। ভাড়ায় তারা পর্যটকদের সৈকত ঘুরে দেখাবে। আমাদের সঙ্গে যেহেতু গাড়ি আছে তাই মোটরসাইকেলের প্রয়োজন পড়েনি। সূর্যটা পশ্চিম দিগন্তে একটু পরই সেজদায় যাবে। এখন রুকুতে আছে। আমরা সমুদ্র তীর ধরে বালুকারাশির ওপর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি গাড়িতে করে। আমাদের গাড়ি ছুটছে পশ্চিমে। সূর্য ডোবার দৃশ্যটা সেখান থেকে একটু ভালো দেখা যায়। অন্তহীন সাগরের বুক ছিড়ে নোনা হাওয়া ছুটে আসছে শাঁ শাঁ করে। সাগরের স্বাভাবিক উত্তালতা কানে গুঞ্জন তুলছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমরা অপলক তাকিয়ে আছি পশ্চিম দিগন্তে ডিম্বাকৃতির সূর্যটার দিকে। শুধু আমরা নই, সাগরকন্যার তীরে দাঁড়িয়ে শত শত চোখ অপেক্ষা করছে বিরল সেই দৃশ্যটা দেখতে। অনেকে দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দী করতেও প্রস্তুত। চেয়ে থাকতে থাকতেই দিগন্ত রেখায় রক্তিম ডিম্বাকৃতিরটি যেন তলিয়ে গেল সাঝের নিচে। সারা দিনের ক্লান্ত-শ্রান্ত সূর্যটি যেন গা এলিয়ে দিল আপন ঠিকানায়। ভাবতে ভালো লাগল, আমরাই আজকের সূর্যটি অস্ত যাওয়ার মুহূর্তের সাক্ষী। পৃথিবীর আর কোথাও থেকে এ দৃশ্যটি এত গভীরভাবে কেউ দেখতে পারেনি। সূর্যটি চোখের আড়াল হয়ে যাওয়ার পর যেন চারদিকে একটি আচ্ছন্নতায় ছেয়ে যেতে লাগল। সাগরতীরে সন্ধ্যা নামার দৃশ্যটাও চমৎকার। ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকাগুলো আস্তে আস্তে তীরে এসে ভিড়ছে। নিচে এক ধরনের গাড়ির মতো চাকা লাগিয়ে নৌকাগুলো ডাঙ্গায় তোলার কাছে ব্যস্ত জেলেরা। সাগরতীর আস্তে আস্তে ফাঁকা হতে থাকল। আমরাও ফিরে এলাম। তবে অপেক্ষায় রইলাম আগামীকালের, সূর্যের উদয়টা দেখার।

সন্ধ্যার পর আমরা গাড়িতে করে কুয়াকাটা শহরটা ঘুরে দেখার জন্য বের হলাম। শহর বললেও শহরের আভিজাত্য তেমন নেই। কয়েকটি বড় বড় অত্যাধুনিক হোটেল-মোটেল হয়েছে, কিন্তু পথঘাটে এখনও গ্রাম্য বাজারের ছাপ পুরোটাই আঁচ করা যায়। ঘুরতে ঘুরতে আমরা চলে গেলাম রাখাইন পল্লীতে। জনশ্র“তি আছে, রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের রাজা ‘মং’ এর নেতৃত্বে সাগড় পাড়ি দিয়ে প্রথমে চট্টগ্রাম এবং পরে পটুয়াখালীর এ জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় তাদের বসতি স্থাপন করে। নিজস্ব ঐতিহ্য ও কৃষ্টিতে গড়ে তোলে নিজেদের আবাসস্থল। কুয়াকাটার আদি বাসিন্দা রাখাইন সম্প্রদায়। জানা যায়, তৎকালীন রাজা ‘মং’ রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকদের সাগরের লবণাক্ত পানি যাতে ব্যবহার করতে না হয় সেজন্য সমুদ্র সৈকতের কাছেই মিষ্টি পানির দুটি ‘কুপ’ খনন করেন। এ কুয়ার জন্যই ওই এলাকার নাম হয় কুয়াকাটা। পরে রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকেরা আশেপাশের এলাকার ঝোঁপঝাড় পরিষ্কার করে নিজেদের পদ্ধতিতে চাষাবাদ ও বসতি শুরু করে। রাখাইনদের বড় উৎসব রাশ মেলা। এ সময় কুয়াকাটা সরগরম হয়ে ওঠে। আমরা সন্ধ্যার পর রাখাইন পল্লী ঘুরে এসে বার্মিজ মার্কেটে ঢু মারি। পছন্দ মতো হালকা কেনাকাটাও সম্পন্ন করেন সবাই।

আমাদের হোটেলের অবস্থানটা একদম সৈকতের কাছে। বেড়ি বাঁধটুকু টপকালেই সৈকত। হোটেলের খোলা বেলকনিতে বসে সাগরের উত্তালতা উপভোগ করলাম গভীর রাত পর্যন্ত। সাগরের ভয়াল গর্জনে বার কয়েক ঘুম ভেঙ্গে গিয়ে দাঁড়িয়েছি বেলকনিতে। দেখেছি সাগরের শক্তির মহড়া কিভাবে প্রদর্শন করছে। সাগরের উত্তাল নোনা হাওয়ায় মনের সব কালিমা যেন নিমিষেই দূর হয়ে গেছে। নির্মল, নিষ্কলুষ এ বায়ু গায়ে মাখলে শরীর মন দুটোই ভালো হয়ে যায়। ইট-পাথরের খাচায় বাস করে আমরা যারা নির্মল বায়ুর ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত তাদের জন্য এটা অনেক বড় প্রাপ্তি। সাগরপাড়ের খেটে খাওয়া মানুষেরা এ বায়ুর পরশেই রোগশোক থেকে অনেকটা মুক্ত। তাদের জীবনটা সংগ্রামমুখর হলেও প্রাকৃতিক øিগ্ধতায় অনেক বেশি আবিষ্ট, কৃত্রিমতার প্রলেপমুক্ত।

মোবাইলে এলার্ম দেয়া। উঠতে হবে খুব ভোরে। সাগরকন্যা কুয়াকাটার আরেক উদগ্র সৌন্দর্য সূর্যোদয়ের দৃশ্যটুকু মিস করা যাবে না। মোবাইলে সতর্ক করার আগেই গাজীর ডাকে ঘুম ভাঙল। প্রভাতের শুভ্রতা হালকা ছড়িয়ে পড়ার আগেই আমরা প্রস্তুত। রাজু ভাই ও রানা ভাইয়ের সাড়া পাওয়া গেল না। কারণ তারা ঘুমের কাছে নিজেকে এতটাই সোপর্দ করে দিয়েছেন যে, কোনোভাবেই নিজেকে তা থেকে মুক্ত করতে পারলেন না।

আমি আর গাজী ছুটলাম। ঘুমানোর সুযোগ অনেক হবে, কিন্তু কুয়াকাটা আসার সুযোগ আর হয় কি-না! সকালের সৈকত নির্জনতায় খাঁ খাঁ করছে। আমরাই বোধহয় প্রথমে এলাম। একটু পর অবশ্য পর্যটকদের আনাগোনা বাড়তে লাগল। সকালের সৈকতটাকে আরো বেশি উচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত ও সজীব মনে হলো। সাগরের পাড় ঘেঁষে ঝাউবনের কাছে গিয়ে সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখতে হয়। সেটা আমাদের জানাও আছে। কিন্তু আমরা আনমনে হাঁটা শুরু করেছি গতকালের সূর্যাস্ত দেখার পয়েন্টের দিকে। আর বারবার তাকাচ্ছি পশ্চিম দিগন্তে সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখতে। হঠাৎ আমাদের বোকামীর বিষয়টি নিজেরাই টের পেলাম। সূর্য যেদিকে অস্ত গিয়েছিল উদয়টা তো হবে এর বিপরীত দিকে। কী আর করা! উল্টো বেগে দ্রুতগতিতে ছুটলাম বালুকাময় পথ মাড়িয়ে। খালি পায়ে নরম বালির কোমল ছোঁয়া ভালোই লাগছিল।

সূর্যাস্ত দেখার জন্য ভিড়টা যত বড় ছিল এখন ততটা নয়। কারণ ঘুম জয় করে আসাটা অনেকের কাছে কঠিন। আমাদের চোখের সামনেই থালার মতো ছড়ানো রক্তিম সূর্যটা যেন সাগরের বুক ছিঁড়ে বেরিয়ে এলো। দেখতে দেখতে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল চারদিক। মনেই হলো না সূর্যটা পৃথিবী থেকে অনেক গুণ বেশি বড়। সূর্য যত উপরে উঠছে তার কিরণ তত ছড়িয়ে পড়ছে। আস্তে আস্তে আর তাকানো যাচ্ছে না। ঝাউবনের ফাঁকে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয়ের অপূর্ব মুহূর্তটি উপভোগ করলাম। কিছু ক্যামেরায় ধারণ করলাম। বালি-পানির পথ ধরে আবার ফিরে আসলাম। এ সময় মাছ ধরে আসা কয়েক জেলের সঙ্গে আমাদের কিছু কথা হলো। জানলাম তাদের জীবনসংগ্রামের কিছু কথা। তাদের জীবনযাত্রা আমাদেরকে শিহরিত করলেও তাদের কাছে এ জীবন উপভোগ্য বলেই মনে হলো।

কুয়াকাটা দেখা শেষ। মনোমুগ্ধকর পরিবেশ, সৈকতের মায়াবী হাতছানি কিছুতেই কুয়াকাটা ছেড়ে আসতে মন চাচ্ছিল না। কিন্তু বাস্তবতার কঠিন কষাঘাতে সে সুযোগ কই! আমাদের মতো জীবনবাস্তবতায় জড়িয়ে যাওয়া কিংবা কর্তব্যের ভেড়াজালে বন্দী হওয়া কারো জন্য সে সুযোগ নেই। অলস সকাল পেরিয়ে দুপুর যখন ছুুঁইছুঁই তখন বাস্তবতার কাছে নথি স্বীকার করে আমাদের ফিরে আসার প্রস্তুতি চূড়ান্ত হলো। আমরা ছুটলাম বরিশালের দিকে। হঠাৎ জোয়ারে রাস্তায় ফেরি পার হতে দুর্ভোগ কিছুটা পোহাতে হলো। তবে দুর্ভোগটাকে এডভেঞ্চার হিসেবে নিলাম। সন্ধ্যার পর যখন বরিশাল লঞ্চঘাটে তখন প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি চলছে। লঞ্চের কেবিন বুকিং দেয়া। শুনলাম, আবহাওয়া অফিস থেকে তিন নম্বর সতর্ক সংকেত দেয়া হয়েছে। তবুও ঝুঁকি নিয়েই চড়লাম লঞ্চে। চোখে মুখে আতঙ্কের যথেষ্ট ছাপ, অন্তরে আল্লাহর নাম। করুণাময় প্রভুর মেহেরবানীতে কোনো সমস্যা হলো না। সকালে চোখ খুলে আবিষ্কার করলাম আমরা সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে। (সমাপ্ত)

*

*

Top