নারী এখন মিডিয়া-বিজ্ঞাপনে প্রদর্শনের বস্তু

no-edশালীনতা নারীত্বের অহংকার। বাইরের কলুষিত পরিবেশ থেকে বেঁচে থেকে ঘর ও ঘরোয়া পরিবেশে বেড়ে ওঠা তাদের  সামাজিক অধিকার। প্রদর্শনেচ্ছা নারীত্বের সহজাত বৃদ্ধির পথে বড় অন্তরায়। আল্লাহ পাক সৃষ্টির  প্রতিটি বস্তুর জন্য স্ব স্ব ক্ষেত্র নির্ধারণ করে দিয়েছেন। নিজস্ব ভুবনে, আপন পরিমণ্ডলে বিচরণ করলে তাদের অবস্থান যেমন সুদৃঢ় হয় তেমনি পথচলাও হয় নিঝঞ্জাট। নিজস্ব অবস্থান থেকে ভিন্নগামী হলেই দেখা দেয় বিপদ। নিজের স্থর ও অবস্থানের প্রতি আত্ত্ববিশ্বাস থাকলে কারো সে বিপদের সম্মুখীন হওয়ার কথা নয়। সুনিপুণ কারিগর মহান প্রভু প্রত্যেকের স্বর-বিন্যাসের ক্ষেত্রে তাঁর অসাধারণ  কৌশলের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। সুতরাং এ ক্ষেত্রে অসমতা কিংবা অপরিপক্কতার কোনো প্রশ্ন উঠানো আদৌ সমীচীন নয়।

 নারীদেরকেও আল্লাহ তায়ালা একটি ক্ষেত্র নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তাদের নিরাপত্তার জন্য সেটি অত্যন্ত – সহায়ক। এখন যদি তারা স্রষ্টার স্বাভাবিক ধারার প্রতি বিদ্রোহ পোষণ করে তাদের ক্ষেত্র সম্পর্কে অসন্মতি জ্ঞাপন করেন কিংবা আপত্তিকর  প্রশ্ন উত্থাপন করেন তাহলে তা হবে নিজের স্রষ্টার প্রতি অবিচার। বর্তমানে নারীদের সমঅধিকারের শ্লোগান তুলে স্রষ্টার চিরায়ত বিধানকে নস্যাৎ করার অশুভ একটা পাঁয়তারা চলছে। কর্মক্ষেত্রে সম্প্রসারণের দোহাই দিয়ে কৌশলে তাদেরকে ঘরের বাইরে বের করে পদে পদে অপদস্থ ও অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। অপরিণামদর্শী অনেক নারী চিত্তাকর্ষক ও মায়াবী এই জালে সহজেই আটকা পড়ে যাচ্ছে।

বর্তমানে নারীদেরকে তুলে ধরার প্রয়াস চলছে নানাভাবে। এ  ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করছে মিডিয়া। আধুনিক মিডিয়ায় সাধিত হচ্ছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। মিডিয়ার শক্তি ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয়  ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। মিডিয়ায় নিজেকে উদ্ভাসিত করার অঘোষিত প্রতিযোগিতাও শুরু হয়ে গেছে। নিজেকে প্রকাশ করার প্রয়াস মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। অঘোষিত এই প্রতিযোগিতায় বর্তমানে পিছিয়ে নেই নারীরাও। সমাজের গুরুত্ত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ইতিবাচকভাবে তাদের অংশ গ্রহণ প্রত্যাশিত। মেধা, মননশীলতা ও যোগ্যতার ক্ষেত্রগুলোতে নারীদের কাজে লাগানোর উপযুক্ত মাধ্যম হতে পারে প্রিন্ট মিডিয়ার বিশাল পরিমন্ডল। নারীরা তাদের নিজেদের সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা নিজেরা যতটা উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা নিয়ে উপস্থাপন করতে পারবে তা অন্যদের দ্বারা সম্ভব নয়। এজন্য প্রিন্ট মিডিয়ায় নারীদের যথোচিত অংশগ্রহণ সমাজের জন্য বিশেষ কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। ইদানীং এ  ক্ষেত্রে নারীরা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছেন।
ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতেও শালীন কার্যক্রমে নারীদের অংশগ্রহণ নিরুৎসাহযোগ্য নয়। কিন্তু বর্তমানে মিডিয়ায় নারীদেরকে যেভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে তা কিছুতেই তাদের মর্যাদা ও শালীনতার জন্য সহায়ক নয়। নারীকে খোলামেলা করে উপস্থাপনের অঘোষিত প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। মোহনীয় ভঙ্গির  নারীদেহ বর্তমান মিডিয়ার প্রধান উপজীব্য। এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া কোনোটিই। পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের পাতাগুলো নারীদেহের অবাধ প্রদর্শনীতে পরিণত হয়েছে। স্টলগুলোতে ঝুলতে থাকা পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদের দিকে নির্দিধায় তাকানো যায় না। বিনোদনের পাতা জুড়ে প্রায়ই নায়ক-নায়িকাদের যে ছবি ছাপা হয় তাতে সুস্থ রুচির মানুষেরা ঘরে রেখে পত্রিকা পড়ার সাহস হারিয়ে ফেলছেন। যেকোন বিষয়ে দুর্বলতাকে উস্কে দেয়াই যে এর উদ্দেশ্য এ কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না।

ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া  এ  ক্ষেত্রে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে। দেশীয় টিভি-সিনেমার পাশাপাশি বর্তমানে খুলে গিয়েছে ডিশ এন্টেনা ও সিডির সাহায্যে উন্মুক্ত বিরাট বিদেশী জগত। সংস্কৃতি ও বিনোদনের নামে  খোলামেলা নারীর চিত্র ছড়িয়ে দিয়ে পয়সা হাতানোই এর উদ্দেশ্য। সহজলভ্যতার কারণে সমাজের কোনো শ্রেণীই আজ এ বিষয় থেকে মুক্ত নয়। শহর থেকে নিয়ে মফস্বলের খেটে খাওয়া মানুষের ঘরে পর্যন্ত- শোভা পাচ্ছে অবারিত বিনোদনের নানা উপকরণ। কোমলমতি শিশু-কিশোর থেকে বৃদ্ধা-বনিতা  পর্যন্ত – কেউই বাদ পড়ছে না এ সবের করালগ্রাস থেকে। সিনেমার অশ্লীলতা সম্পর্কে মাঝে মাঝে হৈ চৈ হয়। কিন্তু অশ্লীলতার কোনো সংজ্ঞা তারা নিরূপণ করতে পারেননি। দেখা যায় যাকে তারা অশ্লীল বলে মনে করেন তাও বেহায়াপনার চূড়ান্ত- সীমায় উপনীত। অবস্থা  এমন যে, যে অনুষ্ঠানে নারীদেরকে যত খোলামেলা উপস্থাপন করা যাবে সে অনুষ্ঠান তত জনপ্রিয়তা পাবে।

স¤প্রতি মিডিয়া জগতে প্রতিভা অন্মেষণের নামে নারীদেরকে বিকৃতভাবে উপস্থাপনের নতুন খেলা শুরু হয়েছে। অমুক দীপের নায়িকা খুঁজছি, অমুক পেস্টের তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ, অমুক সাবানের ফটো সুন্দরী প্রতিযোগিতা, অমুক চ্যানেলের গানরাজ অন্বেষণ, গাও বাংলাদেশ গাও ইত্যাদি আকর্ষণীয় নামে তরুণদের সঙ্গে তরুণীদেরকেও ব্যাপকভাবে উদ্ধুদ্ধ করা হচ্ছে বিনোদনের দিকে। চিত্রজগত, গ্লামার ও শোবিজে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর তরুণীরা আগপিছ না ভেবে উপছে পড়ছে এসব কর্মসূচীতে। লাজুকতা ও শালীনতার জন্য বিখ্যাত বাংলাদেশের মফস্বলের তরুণীরাও এখন তাদের অস্তিত্ত্ব , অবয়ব ও সৌন্দর্য নিয়ে হাটতে বসতে  কুন্ঠিত হচ্ছে না।
মিডিয়ায় নারীদেরকে টাকার জোরে অপদস্থ করে ব্যবহার করার আরেকটি প্রধান কৌশল হচ্ছে বিজ্ঞাপন বাণিজ্য। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পণ্যের প্রচার-প্রসারের জন্য বিজ্ঞাপনের ব্যবহার ব্যাপক। নারীর অংশগ্রহণ ছাড়া যে বিজ্ঞাপন নির্মাণের ধারণা এখন প্রায় দুর্লভ। সামান্য ব্লেডের বিজ্ঞাপনেও রূপসী নারীর খোলামেলা প্রদর্শনী করা হয়। টিভি চ্যানেলের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞাপনের উদ্ভাবন করা হচ্ছে নিত্য নতুন আইডিয়া। যে যত মোহনীয় ভঙ্গিমায় নারী দেহের প্রদর্শনী করতে পারবে তার বিজ্ঞাপন তত সার্থক। বিজ্ঞাপনের এই প্রতিযোগিতা শুধু মিডিয়াতেই থেমে থাকেনি। বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। রাস্তায় রাস্তায় পোস্টার, লিফলেট, বিলবোর্ড ইত্যাদির মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। আবেদনময়ী, রূপবতী নারীর খোলামেলা দেহ শোভা পাচ্ছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে, মাথার উপরে, চোখের সামনে নারীর দেহ, অনুভূতি ও আচরণ তুলে ধরা হচ্ছে। বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত ভাষার অশ্লীলতার গণ্ডি অনেক ক্ষেত্রে অতিক্রম করেছে।

মিডিয়া ও বিজ্ঞাপনে নারীদেহের খোলামেলা এই প্রদর্শনী আমাদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনকে নিয়ে যাচ্ছে এক অশুভ পরিণতির দিকে। এর দ্বারা নারীকে চরমভাবে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। হাদীসে নারীদেরকে জগতের স্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অমূল্য এই সম্পদের অপব্যবহার তাদেরকে মূল্যায়নের  ক্ষেত্রে অবাস্তব  বড় দলীল। এর দ্বারা নারীদেরই শুধু ক্ষতিবাড়ছে না, বরং ক্ষতি হচ্ছে দেশ, জাতি, সমাজ ও ধর্মের। আমাদের সমাজ আজ চরম বর্বরতার দিকে ধাবমান। সমাজের এই অবয়ের পেছনে বড় কারণ হচ্ছে তরুণ ও যুবসমাজের বিপথগামিতা। এর  জন্য প্রধানত দায়ী নারীদেহের এই খোলামেলা বাণিজ্যিক ব্যবহার। মিডিয়া ও বিজ্ঞাপনে নারীকে নগ্নভাবে উপস্থাপনের ফলে বহু যুবক নারীদেহের বিচিত্র রূপ ও বিবিধ আহবান গভীরভাবে রেখাপাত করছে। মূলত এ কারণেই সমাজে হত্যা, সন্ত্র্রাস, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, যৌতুক, নেশাগ্রস্ততা, নারীদেরকে উত্তক্তকরণ ইত্যাদি সামাজিক অপকর্মসমূহ উত্তেজনকভাবে বেড়ে চলেছে।

এভাবে চলতে থাকলে আমাদের সমাজব্যবস্থা পতনে কোন বেলাভূমিতে গিয়ে ঠেকবে তা অনুমান করা যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় ক্ষতি যা হবে তা হচ্ছে জাতির সম্ভাবনাময় যুবসমাজের সুপ্তমেধা ও সুকুমার বৃত্তির অপূরণীয় ক্ষতি। ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের যে ঐতিহ্য রয়েছে তা চিরতরে বিলীন হয়ে যাবে। সাময়িক উক্তিতে মিডিয়া ও বিজ্ঞাপনে নারীর ব্যবহারের নেতিবাচক দিকটি তেমন প্রকটভাবে ধরা না পড়লেও এ সুদূরপ্রসারী বিষক্রিয়া হবে খুবই ভয়াবহ। পাশ্চাত্যের নোংরা সংস্কৃতির লাগামহীন প্রচলন এদেশে ঘটলে আমাদের সামাজিক অবকাঠামো সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়বে। পরিবার ও সমাজের সুদৃঢ় ব্যবস্থার যে ঐতিহ্য এদেশে আজো টিকে রয়েছে তা নস্যাৎ হয়ে যেতে কোন বাড়তি আয়োজন লাগবে না। এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার উপযুক্ত সময় এখনই। নারী অধিকারের শ্লোগানে চারদিক মুখরিত করে তোলার তো বহুলোক। নারীর জন্য অবমাননাকর এই আয়োজন ও দৃশ্যগুলো থামানোর লোক নেই। সত্যিই বিস্ময়কর!

Related posts

*

*

Top