মিডিয়া দ্বিতীয় খোদা!

EU Mediam pic_0মিডিয়াকে বর্তমান বিশ্বের পরাশক্তি বললে একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না। সারা বিশ্বে আজ মিডিয়ার ক্ষমতা একচ্ছত্র, অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বিশ্বায়নের এই যুগে মিডিয়া ছাড়া এক মুহূর্তের কথাও আমরা কল্পনা করতে পারি না। অনেক ক্ষমতাধর রাষ্ট্র ও ব্যক্তি পর্যন্ত মিডিয়ার কাছে ধরাশায়ী হয়ে পড়ে। মিডিয়ার প্রভাব এতটাই ব্যাপক ও বিস্তৃত যে, সহজাত ও চিরায়ত ধারাকে উল্টোপথে বাহিত করে দিতে পারে। তিলকে তাল বানিয়ে, বিন্দুকে সিন্ধু বলে উপস্থাপন করেও মিডিয়া তাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারে। মিডিয়ার কারিশমায় অতি তুচ্ছ জিনিসও হয়ে উঠতে পারে মহিয়ান। আবার পূত-নিখুঁত কোনো বস্তু বা বিষয়কেও পৌঁছে দিতে পারে তুচ্ছতা ও ঘৃণার চরম পর্যায়ে। একটি ডাহা মিথ্যাকে পরম সত্য হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার ক্ষমতা যেমন মিডিয়ার আছে তেমনি আছে চিরায়ত কোনো সত্যকে মিথ্যা ও নিকৃষ্ট বলে প্রমাণ করার বিরল কৌশল। ক্ষমতার এই আধিপত্যের কারণে মিডিয়ার কাছে সবাই পরাভূত, অসহায় ও ধরাশায়ী।

বর্তমান বিশ্বমিডিয়ার উল্টো ও বিপরীত প্রবাহকেই সবাই মেনে নিতে বাধ্য। মিডিয়ার দাপটে আমরা এতটাই তটস্থ যে, অনেক সময় সত্য কথা মুখে আনতেও আমাদের বুক দুরুদুরু কাঁপে। না জানি মিডিয়াস্রোতের বিপরীতে আমাদের কোনো কথা বের হয়ে যায়! মিডিয়া বিরাগভাজন হলে কিংবা এর শ্যেনদৃষ্টি কারো ওপর পতিত হলে নিশ্চিত তার অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। প্রশস্ত জমিন তার কাছে সঙ্কীর্ণ বলে মনে হবে। তার ওপর আরোপ করা হবে এমন কিছু উদ্ভট অপবাদ যা শোনার পর নিজের ওপরই নিজের ঘৃণা চলে আসবে। মিডিয়ার আগ্রাসী তৎপরতা এবং অন্যায় দাপটের কারণে প্রতি মুহূর্তে কতজন যে দুর্বিষহ জীবনের মুখোমুখি হচ্ছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এক সময় বলা হতো, Money is Second God  (টাকা দ্বিতীয় খোদা) আর এখন বলতে হবে, Media is Second God (মিডিয়া দ্বিতীয় স্রষ্টা) তবে অঢেল টাকা না থাকলে মিডিয়ার কথা কল্পনা করা যায় না। আর অবৈধ পথে গড়ে তোলা সম্পদের পাহাড় সুরক্ষার জন্য চাই মিডিয়ার আনুকূল্য। অনেকে একটু মজা করে বলেন, মিডিয়া হলো বড়লোকের বাড়ির কুকুর।
দুই.
বিশ্বমিডিয়ার বর্তমান যে স্রোত উল্টোপথে প্রবহমান এর প্রধান টার্গেটই হলো সত্য, সুন্দর ও বাস্তবতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। সারা বিশ্বের মিডিয়ার অবস্থা মোটামুটি এক। প্রকৃতি ও গতিধারায় স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় বলিষ্ঠ মিডিয়ার সংখ্যা নিতান্তই অল্প। আজকের মিডিয়ার গতি হলো অন্যায্য ও অবৈধ পথে। আধিপত্য বিস্তারের খেলায় মিডিয়া এতটাই উন্মাদ যে, নীতি-নৈতিকতার প্রসঙ্গটি এখানে গৌণ, স্থান বিশেষে তুচ্ছ ও পরিত্যাজ্য। স্বার্থের ছিটেফোঁটা যেখানে আছে সেখানেই মিডিয়ার উপস্থিতি অনিবার্য। অপরিমেয় শক্তির আধার মিডিয়া তার পুরো প্রভাবটাই অন্যায্য, অসমর্থিত ও অসম পন্থায় খাটাতে চেষ্টা করে। মিডিয়ার এই নীতি ও আদর্শের মূলে রয়েছে মালিকদের স্বার্থসংশ্লিষ্টতা ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব। বিশ্বের সব মিডিয়াই কোনো না কোনো ব্যক্তি, বা গোষ্ঠীর মালিকানাধীন। মালিক শ্রেণীর মনোভাব ও মনোবাঞ্চাই প্রতিফলিত হয় মিডিয়ায়। তাদের চাহিদা ও প্রভাবটাই এখানে মুখ্য। আর বর্তমান বিশ্বের সিংহভাগ মিডিয়ার মালিকানাই সাম্রাজ্যবাদী চক্রের হাতে। যারা বিশ্বব্যাপী অশান্তি সৃষ্টির হোতা, সত্য ও সুন্দরকে যারা মিটিয়ে দিতে চায় তাদের অর্থে প্রতিষ্ঠিত মিডিয়ার কাছে গঠনমূলক কিছু আশা করা, নীতি ও আদর্শের সহায়ক কিছু কামনা করা তেঁতুল গাছে আঙ্গুর চাওয়ারই নামান্তর।

সারা বিশ্বে প্রভাবশালী যে কটি মিডিয়া আছে এর সবগুলোই সরাসরি ইহুদিদের দ্বারা পরিচালিত কিংবা তাদের মিত্রদের প্রতিষ্ঠিত। ইহুদিরা এমন এক জাতি যারা কূট-কৌশলে বিশ্বকে অশান্ত করে নিজেদের সুবিধাটুকু হাতিয়ে নেয়ার উস্তাদ। ইহুদি চাল বোঝার মতো দূরদর্শিতা কোনো জাতিরই নেই। ইহুদিদের এসব অপকর্ম চালিয়ে যাওয়ার ফলপ্রসূ মাধ্যম হচ্ছে মিডিয়া। এজন্য প্রতিটি মিডিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে অত্যন্ত কৌশলে তারা বসে আছে। সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে না পারলেও নানা পন্থায় তারা বিশ্বমিডিয়ায় নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে আছে। শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, আমাদের দেশের প্রভাবশালী মিডিয়াগুলোর ওপর ইহুদিচক্রের শক্তিশালী হাত কার্যকর আছে। বাহ্যত তাদের লাভ-ক্ষতির কোনো বিষয় না থাকলেও কূটচাল ও দুষ্টুমির দ্বারা অস্থিরতা বজায় রাখাটাই তাদের সাফল্য। বিশ্বমিডিয়ার নেপথ্যে ইহুদিচক্রের দুষ্টু হাত কার্যকর আছে বলেই মিডিয়ার গতি উল্টো স্রোতে, নীতি-নৈতিকতা ও চিরায়ত ধারার বিপরীতে।
তিন.
বিশ্বমিডিয়ার এই যে বিপরীত প্রবাহ এর প্রধানত শিকার ইসলাম, ইসলামি মূল্যবোধ এবং এর অনুসারীরা। বিশ্বের প্রতিটি দেশে মুসলমানরা আজ মিডিয়া আগ্রাসনের নির্মম শিকার। ইসলাম ও মুসলমান আজ বিশ্ব মিডিয়ার কাছে সবচেয়ে অপাঙ্ক্তে। দেশে দেশে মুসলমানদের দুর্ভোগ ও দুর্দশার জন্য প্রধানত দায়ী মিডিয়া। মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুদেরকে উস্কে দেয়া ও উদ্বুদ্ধ করার দায়িত্বটুকু পালন অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছে মিডিয়া। মুসলমান সম্পর্কে ভয়াবহ ও ঘৃণ্য যে একটা ধারণা বা চিত্রকল্প দুনিয়ার সামনে তুলে ধরা হয়েছে তা মিডিয়ার নৈপুণ্য। মুসলমান ও সন্ত্রাসবাদ সমার্থক হিসেবে উপস্থাপনের যে টার্গেট নিয়ে তাগুতি শক্তি ময়দানে নেমেছিল তা পূর্ণতা পেয়েছে মিডিয়ার কল্যাণে।

আফগানিস্তান, ইরাকের মতো ঐতিহ্যমণ্ডিত রাষ্ট্র ধ্বংস করে দেয়ার কারিশমা ইতোমধ্যে মিডিয়া প্রদর্শন করেছে। ইরানকে বিশ্বের সামনে মানবসভ্যতার জন্য ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্মক প্রমাণিত করার প্রাথমিক প্রক্রিয়ায় তারা সফল। পাকিস্তানকে অকার্যকর রাষ্ট্র বানানোর প্রস্তুতি প্রায় শেষ। সিরিয়া ও সুদানের প্রতি মিডিয়ার শ্যেনদৃষ্টি পড়েছে আরো আগেই। প্রতিটি মুসলিম দেশকে অস্থিতিশীল করে রাখার জন্য নানান ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে মিডিয়া। ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমিতে মুসলমানদের রক্তের স্রোত বইয়ে গেলেও মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষিত হয় না, আর ইসরাইলের কোনো ইহুদির বাচ্চার পায়ে একটা সুঁইয়ের আচড় লাগলেও তা মিডিয়ার শিরোনাম হয়ে যায়। সাম্রাজ্যবাদীদের পারমাণবিক অস্ত্রের মহড়া দেখে মিডিয়া বাহ বাহ দেয়, আর মুসলিম কোনো দেশ পারমাণবিক স্থাপনা গড়ে তোলার লক্ষে একটি ইট গাঁথলেও চারদিক থেকে হৈ চৈ রব ওঠে। মিডিয়ার এই বিমাতাসুলভ আচরণ, অন্যায় ও অসভ্য কর্মকা- সমান্তরালভাবে চলছে সারা বিশ্বে। কারণ মিডিয়ার প্রভু যারা তারা মুসলমানদের অস্তিত্ব কখনও সহ্য করতে পারে না।
চার.
বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের মিডিয়া আগ্রাসনের নির্মম শিকার হওয়ার প্রধান কারণ তাদের কাছে শক্তিশালী কোনো মিডিয়া নেই। মিডিয়ার দিক থেকে মুসলমানরা নিদারুণ পিছিয়ে আছে। একপেষে ও অন্যায় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ন্যূনতম প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো মিডিয়াও মুসলমানদের নেই। এজন্যই সারা বিশ্বে মুসলমানরা আজ একতরফাভাবে মিডিয়া তা-বের নির্মম শিকার। শুধু আমাদের বাংলাদেশের কথাই চিন্তা করা যাক-এখানে ইসলামপন্থিরা মিডিয়ার কাছে কত অসহায়! নব্বই ভাগ মুসলমানের এই দেশেও ইসলামপন্থিরা যখন মিডিয়ার শিকারে পরিণত হয় তখন আক্ষেপের আর কোনো সীমা থাকে না। বাহ্যত বাংলাদেশের বেশির ভাগ মিডিয়ার মালিকানাই মুসলমানদের হাতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, মুসলমানদের স্বার্থসংশ্লিষ্টতা রক্ষিত হয়নি একটি মিডিয়াতেও। মিডিয়ার ধর্মই হয়ে গেছে এমন যে, ইসলামপন্থিদেরকে দমিয়ে রাখতে হবে। তারা যেন মাথাচারা দিয়ে উঠতে না পারে এর জন্য যা যা করা দরকার সবই করতে প্রস্তুত এদেশের মিডিয়া। এখানকার মিডিয়ার সবচেয়ে উপেক্ষিত, অবহেলিত ও অবদমিত বিষয় হচ্ছে ইসলাম ও মুসলমান প্রসঙ্গ।

বাংলাদেশের কয়েক শ সংবাদপত্র, কয়েক ডজন টিভি চ্যানেল, রেডিও স্টেশন, সংবাদ এজেন্সি এবং অগণিত মাসিক, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক সাময়িকী ইসলামের বিরুদ্ধে সক্রিয় আছে। বিশ্বমিডিয়ার উল্টোস্রোতের ধাক্কা আমাদের দেশের মিডিয়াগুলোতেও জোরালোভাবে লেগেছে। ইসলামপন্থিদের হেয় করার একটা নীরব প্রতিযোগিতা চলছে আমাদের মিডিয়া অঙ্গনে। এমন কোনো মিডিয়া পাওয়া যাবে না যাতে ইসলামপন্থিদের সরাসরি আঘাত কিংবা টিপ্পনি কাটা হয়নি। বিশ্ব মোড়লদের শেখানো বুলি এদেশের মিডিয়াগুলোতে জোরেশোরে প্রচারিত হচ্ছে। ইসলামী শিক্ষা, আদর্শ, মূল্যবোধ এবং সত্য ও সুন্দরের বিরুদ্ধে এদেশের প্রথমসারির মিডিয়াগুলো একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। বাম, ব্রাক্ষ্মণ ও স্যেকুলারপন্থিদের একচ্ছত্র প্রভাবের কারণে এদেশের মিডিয়াঙ্গন বরাবরই ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে সরব। ডানপন্থি যে ধারাটি অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী তারাও ইসলামপন্থিদের মিত্র হতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে না। সুযোগ পেলে তারাও ইসলামপন্থিদের বিপরীত অবস্থানে চলে যাওয়ার অহরহ নজির আমাদের সামনে বিদ্যমান। সুতরাং বর্তমান মিডিয়াঙ্গনে ইসলামপন্থিদের মিত্র বলে কেউ নেই। তাদের সহানুভূতি লাভের প্রয়োজন পড়লে মাঝে-মধ্যে কেউ মিত্রতার বান করে মাত্র। প্রকৃত অর্থে তারাও ইসলামপন্থিদের সহায়ক শক্তি নয়।

Related posts

*

*

Top