মুরসিরা চলে গেলেও তাদের আদর্শের মৃত্যু নেই

জহির উদ্দিন বাবর
ফেরআউনের দেশ খ্যাত মিসরের ইতিহাসে জনগণের ভোটে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন ড. মুহাম্মদ মুরসি। ২০১২ সালে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বছর না ঘুরতেই তাঁকে হারাতে হয় ক্ষমতা। গত ১৭ জুন আদালত প্রাঙ্গণেই ইন্তেকাল করেছেন মুরসি। দেশটির সামরিক সরকারের পক্ষ থেকে এটাকে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ বলা হলেও তাঁকে যে পরিকল্পিতভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে সেটা পরিষ্কার।

জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে মুরসির মৃত্যুর তদন্তের দাবি উঠেছে। তবে বিশ্বের কোনো শাসকের মুখে শোনা যায়নি তেমন কোনো প্রতিবাদ। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তায়েব এরদোগান ছাড়া মুরসির জন্য জোরালো কোনো শোকবার্তাও চোখে পড়েনি। এর কারণ হলো গত সাত বছর ধরে মিসরের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এক সামরিক শাসক, যিনি কি না মুরসির অধীনে চাকরি করেছেন। বাংলাদেশসহ কোনো দেশই বিগত শাসকের পক্ষে কথা বলে বর্তমান শাসকের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক দুর্বল করতে চায় না। এজন্য মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী শাসকেরাও জানাননি শোকবার্তা। ফিলিস্তিন, কাতার, তিউনিসিয়া ছাড়া আরব বিশ্বের দেশগুলো মুরসি ইস্যুতে কোনো কথাই বলেনি।
তবে মুসলিম বিশ্বের ব্যতিক্রমী এই নেতার জন্য চোখের অশ্রু ঝরেছে কোটি জনতার। একদিকে তারা মুরসির প্রতি জানিয়েছেন হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা আর সমবেদনা; অপরদিকে জেনারেল সিসি ও তার অনুসারীদের প্রতি বর্ষণ করেছেন ঘৃণার ধারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত ছিল মুরসিময়। তা দেখেই অনুমান করা যায়, যুগে যুগে মুরসিদের জায়গা মানুষের হৃদয়ের মনিকোঠায়, আর সিসিদের জায়গা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে।

আল-জাজিরার খবরে বলা হয়, সেদিন আদালতে শুনানির সময় দীর্ঘ বক্তব্য দিচ্ছিলেন মুরসি। মিথ্যা ও বানোয়াট মামলাগুলোতে তিনি নিজের শুনানি নিজেই করতেন। প্রায় ২০ মিনিট বক্তব্য দেওয়ার পর এজলাস কক্ষেই হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন মুরসি। খবর বেরিয়েছে, কয়েক ঘণ্টা বিনা চিকিৎসায় পড়েছিলেন মিসরের তুমুল জনপ্রিয় এই শাসক। পরে যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় ততক্ষণে তিনি কাক্সিক্ষত মাহবুব মাওলা পাকের সঙ্গে গিয়ে মিলিত হয়ে গেছেন।

বর্ণাঢ্য জীবন, ঈর্ষণীয় যোগ্যতা
মুরসির পুরো নাম মুহাম্মদ মুরসি ইসা আল-আইয়াত। তিনি ১৯৫১ সালের ২০ আগস্ট মিসরের শারকিয়া প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৫ সালে প্রকৌশল বিষয়ে স্নাতক এবং ১৯৭৮ সালে একই বিষয়ে সাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ওই বছরই উচ্চ শিক্ষার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান মুরসি। ১৯৮২ সালে ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ ক্যালিফোর্নিয়াতে মুহাম্মদ মুরসি প্রকৌশল বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন এবং তিনি ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি, নর্থরিজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।

পরবর্তী সময়ে ১৯৮৫ সালে মুরসি শারকিয়া প্রদেশের জাগাজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে ক্যালিফোর্নিয়ার অধ্যাপনার চাকরি ছেড়ে মিসরে চলে আসেন। ২০০০ সালে মুরসি প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সাংগঠনিকভাবে তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য হলেও হোসনি মোবারকের শাসনামলে এই সংগঠনটি মিসরের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ছিল। তাই তিনি স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। সাংসদ হিসেবে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বহাল ছিলেন মুরসি। এ সময়ে তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। ফিলিস্তিনের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। শাসক হওয়ার পর নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন।
২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি গণবিক্ষোভের মুখে হোসনি মোবারকের পতন হয়। এরইমধ্যে মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় দলটির প্রত্যক্ষ সমর্থনে ‘মুসলিম ব্রাদারহুড ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি’ (এফজেপি) নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। মুরসি দলটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ২০১২ সালে মে ও জুনে দুই পর্বের নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিপুল জনসমর্থনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন মুরসি। এ সময় মুসলিম ব্রাদারহুড ও এফজেপি আনুষ্ঠানিকভাবে মুহাম্মদ মুরসিকে ‘মিসরের সর্বস্তরের মানুষের রাষ্ট্রপতি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

তবে ক্ষমতা গ্রহণ করেই দীর্ঘ সামরিক শাসনের যাঁতাকলে ক্ষয়িঞ্চু মিসরকে পতনের হাত থেকে রক্ষার জন্য মুরসি দ্রুত কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেননি বলে অভিযোগ সমালোচক ও বিরোধীদের। একইসঙ্গে তিনি দেশের স্বার্থের চেয়েও মুসলিম ব্রাদারহুডের ইসলামপন্থি কর্মসূচিকে বেশি গুরুত্ব দিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও বাস্তবতা হলো, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়ান মুরসি। দখলদার ইসরায়েল অবরুদ্ধ গাজাবাসীর জন্য মিসরের সীমান্ত খুলে দিয়ে জেরুজালেম ও আল আকসা মসজিদের ওপর ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রণের পক্ষে অবস্থান নেন তিনি। একইসঙ্গে তিনি ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টাও করেন। তাঁর এ দুটি পদক্ষেপই কাল হয়ে দাঁড়ায়। মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আদাজল খেয়ে মাঠে নামে সৌদি আরব, আরব আমিরাত ও ইসরায়েল।

অভিযোগ রয়েছে মুরসির বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভ উস্কে দেওয়ার জন্য এই তিনটি দেশ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে। আর পশ্চিমা বিশ্বের ইন্ধন তো ছিলই। যে আরব বসন্তের ওপর ভর করে মুরসি ক্ষমতায় এসেছিলেন সেই আরব বসন্তকে উস্কে দিয়েছিল পশ্চিমারাই। তবে মুরসির মতো একজন পাক্কা মুসলিম ক্ষমতায় এসে এভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষে কাজ শুরু করবেন সেটা তাদের ধারণায় ছিল না। এজন্য মুরসি ক্ষমতায় বসার পর থেকেই শুরু হয় পশ্চিমা ষড়যন্ত্র। তাহরির স্কয়ারে মুরসিবিরোধী বিক্ষোভে তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা ছিল। ২০১৩ সালের ৩ জুলাই তৎকালীন সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত ও বন্দি করে।

ব্যতিক্রমী শাসক মুরসি
মুহাম্মদ মুরসি ছিলেন কুরআনে হাফেজ। অল্প বয়সেই তিনি হাফেজ হন। তাঁর এই গুণের কথা অনেকেই জানত না। কারাবন্দি অবস্থায় তিনি জেল কর্তৃপক্ষের কাছে কুরআন শরিফ চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে তাও দেয়া হয়নি। তাই তিনি বলেছিলেন, ‘ওরা হয়তো জানে না, আমি ৪০ বছর আগেই কুরআন মুখস্ত করেছি। আমি তো শুধু এই পবিত্র কুরআনকে একটু ছুঁতে চেয়েছিলাম। এর চেয়ে বেশি কিছু চাইনি।’

পশ্চিমা দুনিয়া পড়াশোনা করলেও মুরসি ছিলেন যথেষ্ট ধার্মিক। জীবনধারা ছিল অত্যন্ত সাদাসিধে। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও আড়ম্বরহীনভাবে একটি মাত্র অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন তিনি। প্রাচুর্য তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে কম বেতনের প্রেসিডেন্ট। দেশের ধনকুবের ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কোনোদিনই তিনি বিশেষ সুবিধা নেননি। পুরো বছরে তার মোট বেতন ছিল ১০ হাজার ডলার। নিজের বেতন থেকে বাড়ির ভাড়া পরিশোধ করতেন। পারিবারিক প্রয়োজনে তিনি কখনোই সরকারি বিশেষ সুবিধা নেননি। একবার অসুস্থ বোনকে দেখতে তিনি হাসপাতালে যান। সেখানকার চিকিৎসরা তাঁর বোনকে বিদেশে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানোর পরামর্শ দেন। মুরসি সহজেই এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে বোনকে নিয়ে বিদেশে নিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তাতে তিনি রাজি হননি। মিসরের সাধারণ অন্যান্য নাগরিকের মতো সরকারি হাসপাতালেই তাঁর বোনের চিকিৎসা হয়েছিল। অবশেষে সেখানে তাঁর বোন ইন্তেকাল করেন।

যথাসম্ভব দীনের ওপর অবিচল থাকার চেষ্টা করতেন মুরসি। প্রেসিডেন্ট থাকালে কোথাও বক্তৃতা দেয়ার সময়ও তিনি নামাজের বিষয়ে সচেতন থাকতেন। আজান না শুনলে বক্তব্য থামিয়ে তিনি জোরে জোরে নিজেই আজান দিতেন। তাঁর এই গুণ দারুণভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রভাব ফেলে। সাধারণত ফজরের নামাজের জামাত বাদ যেত না তাঁর। দিনের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও পড়তেন জামাতে। অধিকাংশ সময় মসজিদে গিয়েই নামাজ আদায় করতেন। জুমার খুতবাতেও তাঁকে অনেক সময় কাঁদতে দেখা গেছে। মুসলমানদের সত্যিকারের শাসকের অনেক গুণ তাঁর মধ্যে চোখে পড়েছে।

সেবামূলক কার্যক্রমকে গুরুত্ব দিতেন মুহাম্মদ মুরসি। ২০০৪ সালে সুনামি আক্রান্ত ইন্দোনেশিয়াতে ছুটে গিয়েছিলেন। প্রাকৃতিক এই বিপর্যয়ে সেখানে কয়েক হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। দুর্যোগ আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে এইড মিশনের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ায় যান মুরসি। অত্যন্ত জনদরদি ছিলেন তিনি। একদিন এক নারীকে রাস্তায় ঘুমিয়ে থাকতে দেখে তাৎক্ষণিক গাড়ি থামিয়ে তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন, ওই মহিলা বিধবা। তিনি নিরাশ্রয়। তখন তিনি সরকারিভাবে একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দেন। এভাবে হতদরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানো ছিল তাঁর স্বভাবসুলভ একটি গুণ।

মুরসিদের আদর্শের মৃত্যু নেই
মিসরের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় শাসক ছিলেন মুরসি। সামরিক বাহিনীর ভয় দেখিয়ে নয়, ভালোবাসা দিয়ে জনগণের মন জয় করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু পারলেন না। কারণ তিনি ষড়যন্ত্রের কাছে পরাজিত হয়েছেন। মুরসির সঙ্গে জামাতে নামাজ আদায়কালে যে সিসি কান্নার অভিনয় করতেন সেই সিসিই মুরসিকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতে নেতৃত্ব দেন। পরবর্তী সময়ে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে তাঁকে তিলে তিলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার পেছনে মূল হাত সিসির। আজ মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ এই ভূখ-টির দোর্দ- প্রভাবশালী শাসক হলেও সিসিরও একদিন চলে যেতে হবে। তিনি যার উত্তরসূরি সেই ফেরআউনও কিন্তু টিকতে পারেনি। অল্পদিনের ক্ষমতার স্বাদ নিলেও তারা চিরকালের জন্য ঘৃণা আর ভর্ৎসনার ভাগিদার। অপরদিকে মুহাম্মদ মুরসিরা হয়ত বেশিদিন ক্ষমতায় টিকতে পারেননি, স্বাভাবিক নিয়মেই দুনিয়া থেকে বিদায়ও নিয়েছেন; কিন্তু তাদের আদর্শের কোনো ক্ষয় নেই, এর কোনো মৃত্যু নেই।

মিসরের সামরিক সরকার শুধু জীবিত মুরসিকে নয়, মৃত মুরসিকেও ভয় পায়। এজন্য তাঁর জানাজাকে কেন্দ্র করে যেন কোনো লোক সমাগম না হতে পারে সে ব্যবস্থা করা হয়। পরিবারের অল্প কয়েকজনের উপস্থিতিতে জানাজা সেরে অজ্ঞাত স্থানে সমাহিত করা হয় সাবেক এই শাসককে। তবে তারা হয়ত এটা জানে না, মুরসিদের যেখানেই সমাহিত করা হোক; তাদের আদর্শকে নিশ্চিহ্ন করা কখনও সম্ভব নয়। মানুষের অন্তরে মুরসিদের জন্য যে ভালোবাসার বীজ বপন করা সেটার শাখা-প্রশাখার বিস্তার কোনোভাবেই ঠেকানো যাবে না। যেমন পারেনি মিসরে শহীদ হাসানুল বান্না আর সাইয়েদ কুতুব শহীদদের। যেমন পারেনি তুরস্কে আল্লামা বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসিদের। ড. হাফেজ শহীদ মুহাম্মদ মুরসি চলে গেছেন, তবে আদর্শের প্রশ্নে আপস করেননি। আদর্শের ওপর তাদের এই অবিচলতাই একদিন শুধু মিসরে নয়, সারা বিশ্বে ইসলামের বিজয় নিশান উড়াবে। নাসরুম মিনাল্লাহি ওয়া ফাতহুন কারি।

Related posts

*

*

Top