যে কারণে চুপসে গেছে ইসলামি শক্তিগুলো

Zahirbaborআমাদের দেশে ইসলামি ধারার রাজনীতির একটি ঐতিহ্য আছে। ধর্মীয় ও জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুতে আলেমদের নেতৃত্বাধীন ইসলামি দলগুলো বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে এসব দল সাধারণত বিভিন্ন ধর্মীয় ইস্যুতে সরব হয়ে উঠে। অন্যান্য ইস্যুতে তাদের উপস্থিতি তেমন চোখে পড়ে না। সবশেষ ব্লগে ইসলাম অবমাননা ইস্যুতে সরব হয়েছিল ইসলামি দলগুলো। ২০১৩ সালে হঠাৎ করেই আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে হেফাজতে ইসলাম। অরাজনৈতিক দাবি করলেও কওমি মাদরাসাকেন্দ্রিক এই সংগঠনটির মধ্যে অনেকটা বিলীন হয়ে যায় ইসলামি দলগুলো। এসব দল নিজেদের পরিচয় রেখে হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে জড়ো হয়। ওই বছরের ৬ এপ্রিল মতিঝিলের শাপলা চত্বরে ঐতিহাসিক লংমার্চের মাধ্যমে নিজেদের শক্তির জানান দেয় এসব দল। তবে ঠিক এর এক মাস পর ৫ মে শাপলা চত্বরেই পতন ঘটে হেফাজতের। এরপর আর হেফাজত মেরুদ- সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। বিভিন্ন সময় নানা আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করলেও তা হালে পানি পায়নি। হেফাজত এখন নানা অংশে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। হাটহাজারী মাদরাসা, ঢাকার লালবাগ, বারিধারা ও কামরাঙ্গিচর মাদরাসা থেকে হেফাজতের আলাদা আলাদা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। কারো সঙ্গে কারো তেমন কোনো যোগাযোগ নেই।
গত দুই আড়াই বছর ধরে শুধু হেফাজতই নয় প্রতিটি ইসলামি দলই নির্জীব হয়ে আছে। কোনো কোনো দল অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। ভাঙা-গড়া ও বিভাজনের মধ্য দিয়ে কোনো রকম টিকে আছে ইসলামি দলগুলো। ছন্নছাড়া এই দলগুলোর দূরাবস্থা অবর্ণনীয়। নির্দিষ্ট কিছু নেতাকর্মীর মধ্যেই আবর্তিত হচ্ছে এদের কার্যক্রম। নির্দিষ্ট গ-ির বাইরে নেই তাদের কোনো বিচরণ। একসময় জাতীয় রাজনীতিতে ইসলামি দলগুলো ফ্যাক্টর হলেও এখন আর তা নেই। জাতীয় পর্যায়ের ব্যক্তিত্ববান কোনো নেতার অস্তিত্ব চোখে পড়ে না এই দলগুলোতে। একটি দল ভেঙে দুই-তিন টুকরোও হয়েছে। ব্রাকেটবন্দী নেতারা হাতেগোনা নেতাকর্মীদের বেষ্টনীতে থেকেই ইসলামি বিপ্লবের দিবাস্বপ্ন দেখছেন। তাদের নেই কোনো গোছালো পরিকল্পনা। এই অভিযাত্রার গন্তব্য কোথায় সেটাও জানেন তারা। নানা বৈষয়িক স্বার্থে রাজনীতি করছেন বেশির ভাগ ইসলামি দলের নেতা। বিভাজিত ইসলামি শক্তিকে পাত্তা দিচ্ছে না এদেশের প্রধান দলগুলো। পাওয়া-না পাওয়ার দোলাচলে ইসলামি দলগুলো এদিক-ওদিক যাচ্ছে, জোট-মহাজোটে শরিক হচ্ছে; কিন্তু তিলে তিলে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে তাদের অস্তিত্ব।
হঠাৎ গজিয়ে ওঠা হেফাজতে ইসলামের এভাবে চুপসে যাওয়ায় অনেকে বিস্মিত হয়েছেন। এর নেতাকর্মী ও সমর্থকেরা কোনোভাবেই মানতে পারছেন না হেফাজতের এই দূরাবস্থার কথা। তবে মেনে নিতে না চাইলেও বাস্তবতা হলো হেফাজতে ইসলাম মেরুদ- সোজা করার মতো কোনো অবস্থায় আর নেই। ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে গেছে নিয়ম-নীতিহীনভাবে চলা এই সংগঠনটি। চলছে নানা কানাঘুষা, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ। হেফাজতে ইসলামের যে সমর্থন ও শক্তি ছিল তা এখনও আছে; তবে যারা এই সংগঠনটি পরিচালনা করছিলেন সেই নেতৃত্বের প্রতি দেখা দিয়েছে অবিশ্বাস। সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে হেফাজতকে নির্জীব করে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে কয়েকজনের বিরুদ্ধে। চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসায় ২০১০ সালে জন্ম নেয়া এই সংগঠনটির প্রধান আল্লামা আহমদ শফী। তিনি সারা দেশের আলেম-ওলামার কাছে খুবই শ্রদ্ধেয়। তাঁর ব্যাপারে কারও কোনো অভিযোগ নেই। তবে বয়স বেশি হয়ে যাওয়ায় সবকিছু তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেই। আর এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে তাঁর আশেপাশে থাকা একটি চক্র হেফাজতে ইসলামকে নানাভাবে বিক্রি করেছে বলে শোনা যায়। হেফাজতের বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা থাকলেও তা অকার্যকর হয়ে পড়ে আছে অদৃশ্য ইঙ্গিতে। সরকারের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের ভালো বোঝাপড়া আছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। হেফাজত কোনো ইস্যুতে সরব হতে চাইলেই তাদেরকে মামলার ভয় দেখানো হয়। এদিকে হেফাজতের কেউ কেউ বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলের সঙ্গেও ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। হেফাজতকে তারা সুযোগ মতো কাজে লাগাতে চান। কিন্তু সরকারের সঙ্গে ভেতরে ভেতরে দহরম-মহরমের কারণে বিএনপিও তাদেরকে সুনজরে দেখছে না।
শুধু হেফাজতে ইসলামই নয়; দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি ও আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসা ইসলামি দলগুলোও অনেকটা চুপসে গেছে। বেশির ভাগ দলের অবস্থাই ভঙ্গুর। কোনো কোনো দল ভেঙে ইতোমধ্যে কয়েক টুকরা হয়ে গেছে। চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন শুরুর দিকে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে থাকলেও পরবর্তী সময়ে নিজেদের পৃথক করে নেয়। চরমোনাই পীরের ভক্ত-মুরিদরাই এই দলটির মূল শক্তি। বরাবরই আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভালো সম্পর্কের কারণে দলটির প্রতি সন্দেহ পোষণ করে আসছে অন্যান্য ইসলামি দলগুলো। তবে গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেয়া এবং আরও কিছু কারণে আওয়ামী লীগের সঙ্গে দলটির সম্পর্ক আর আগের মতো নেই। ধর্মীয় কোনো ইস্যু সামনে এলে দলটির কিছু তৎপরতা চোখে পড়ে; এছাড়া তেমন কোনো কার্যক্রম দেখা যায় না।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম একটি প্রাচীন দল। ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক এই দলটির আভ্যন্তরীণ অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। সম্প্রতি জাতীয় কাউন্সিলে ভাঙনের মুখ থেকে রক্ষা পেয়েছে দলটি। তবে ভেতরে ভেতরে বিরোধ এতটাই প্রকট যে, যেকোনো সময় ভাঙন দেখা দিতে পারে। চারদলীয় জোট সরকারে দলটির দুইজন এমপি থাকলেও সারা দেশে নেই কার্যক্রম। এছাড়া মাদরাসার বাইরে নেই তেমন কোনো তৎপরতা।
মুফতী আমিনীর ইসলামী ঐক্যজোটের অবস্থাও ভালো নয়। তার ইন্তেকালের পর দলের নেতৃত্ব নিয়ে ভেতরে ভেতরে চলছে অসন্তোষ। মুফতী আমিনীর নিজ দল খেলাফতে ইসলামীর প্রধান হয়েছেন তার ছেলে হাসানাত আমিনী। বয়সে তরুণ হওয়ায় অনেক নেতা তাকে মেনে নিতে পারছেন না; কেউ কেউ এ কারণে দলও ত্যাগ করেছেন। ইসলামী ঐক্যজোট আছে ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে। আলাদাভাবে দলটির কোনো তৎপরতা দেখা যায় না।
শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের দল খেলাফত মজলিস তার জীবদ্দশাতেই ভেঙে দুটি হয়ে গেছে। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস এবং খেলাফত মজলিস নামে আলাদা আলাদা নিবন্ধনও পেয়েছে। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের প্রধান সিলেটের প্রিন্সিপাল হাবীবুর রহমান হলেও দলের নেতৃত্ব মূলত শায়খুল হাদিসের পরিববারের হাতে। পরিবারকেন্দ্রিক এই অংশটির নেতৃত্ব নিয়ে রয়েছে নানা অসন্তোষ। এই ক্ষোভে কেউ কেউ ইতোমধ্যে দল ছেড়ে চলেও গেছেন। খেলাফত মজলিস নামের অংশটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাওলানা ইসহাক ও আহমদ আবদুল কাদের। দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের সুসংহত কিছু কর্মী আছে; তবে জনসমর্থন তেমন নেই। এই অংশটি ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে থাকলেও গুরুত্বহীন।
হাফেজ্জী হুজুরের দল খেলাফত আন্দোলনও কোনো রকম নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। সম্প্রতি দীর্ঘদিন ধরে নেতৃত্বে থাকা হাফেজ্জী হুজুরের বড় ছেলে আহমাদুল্লাহ আশরাফকে অসুস্থতার অজুহাতে সরিয়ে নেতৃত্ব পেয়েছেন আরেক ছেলে মাওলানা আতাউল্লাহ। এ নিয়ে খোদ পরিবারে চলছে অসন্তোষ। আহমাদুল্লাহ আশরাফের ছেলে নেতৃত্ব পাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। সাধারণত ঢাকার কামরাঙ্গীচর মাদরাসাকেন্দ্রিক ঘুরপাক খায় দলটির কার্যক্রম। কোনো ধর্মীয় ইস্যু সৃষ্টি হলে মিছিল-সমাবেশে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয় এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী দলটি। এছাড়া বেশ পুরোনো দল নেজামে ইসলাম পার্টি ভেঙে এখন অস্তিত্ব হারানোর পথে। ইসলামী ঐক্য আন্দোলনের কোনো কার্যক্রমও চোখে পড়ে না।
মূলত ইসলামি দলগুলোর নেই কোনো পরিকল্পনা। তারা কী করতে চান, কোন পথ ধরে এগুতে চান, আর এর জন্য কী করতে হবে এর সুনির্দিষ্ট কোনো ছক নেই ইসলামি দলগুলোর। গতানুগতিক ধারায় চলছে দল ও রাজনীতি। দলগুলোর গঠনতন্ত্র থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা অনুসরণ করা হয় না। কারণ হয়ত এক ব্যক্তি, পরিবার বা বলয়েই চলছে দল। এখানে তাদের কথাই মুখ্য; গঠনতন্ত্র তার জায়গায় থাকবে। ব্যক্তি ও পরিবার পূজা ইসলামি দলগুলোর বিকাশের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইসলামি রাজনীতি এখনও পরিচালিত হয় মসজিদ-মাদরাসাকেন্দ্রিক। বেশির ভাগ দলেরই মূল জনশক্তি কোনো না কোনো মাদরাসা। সারা দেশ থেকে নানা মত ও পথের মানুষের সন্তানেরা রাজধানীর মাদরাসাগুলোতে পড়তে আসে। কিন্তু ওই মাদরাসাটি কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের বলয়ে হলে ওই ছাত্রটিকেও বাধ্যতামূলক এই দলটির কর্মী হয়ে যেতে হয়। কোনো ইস্যুতে মিটিং-মিছিলের প্রয়োজন হলে তাকে নামতে হয় রাজপথে। ওই দলটির মূল জনশক্তি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। তারা কেউ বুঝে আবার কেউ বাধ্যতামূলকভাবে দলীয় কর্মী হয়ে মাদরাসা পরিচালক বা কর্তৃপক্ষের রাজনীতির হাতিয়ার হন। এর বাইরে জনসাধারণের মধ্যে ইসলামি দলগুলোর নেই তেমন কোনো প্রভাব। কেউ কেউ পীর হিসেবে মুরিদদেরও দলীয় কর্মী মনে করেন। কিন্তু নির্বাচনের সময় ওই পীরের মুরিদেরাও ওই দলকে ভোট দেয় না। কারণ পীর সাহেব মুরিদদেরকে দলীয় কর্মী মনে করলেও মুরিদরা ভাবেন ভিন্ন।
সাধারণ মানুষদের সঙ্গে ইসলামি দলগুলোর তেমন কোনো যোগসূত্রতা নেই। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের ভাগীদারও হয় না ইসলামি দলগুলো। শুধু ধর্মীয় কোনো ইস্যু তৈরি হলেই ইসলামি দলগুলো সরব হয়। অন্যথায় তেমন কোনো কার্যক্রমই থাকে না এ দলগুলোর। সাধারণ মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক নানা সমস্যার ব্যাপারে মাথা ঘামান না ইসলামি দলের নেতারা। ইসলাম সম্পর্কে কেউ কটূক্তি করলে ইসলামি দলগুলো বক্তৃতা-বিবৃতিতে যেভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে সেটা দেখা যায় না জাতীয় কোনো ইস্যুতে। এসব কারণে ইসলামি দলগুলোর প্রভাব দিন দিন কমে আসছে। এক সময় মহীরুহতুল্য দেশের শীর্ষ আলেমরা ইসলামি দলগুলোর নেতৃত্ব দিতেন। কিন্তু এখন এসব দলে প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে নেতৃত্ব সংকট। তাছাড়া নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে বারবার আপস করায় ইসলামি দলগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে।

Related posts

*

*

Top