‘আই অ্যাম মালালা’র পোস্টমর্টেম

Imageবেশ কিছুদিন ধরে মালালা ইউসুফজাইয়ের আত্মজীবনী ‘আই অ্যাম মালালা’র ওপর পাকিস্তানের সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। বেশির ভাগ আলোচকই তার বইটি না পড়েই এর ওপর বিশদ আলোচনা করছেন। একজন টিভি উপস্থাপক তো স্বীকারই করলেন, তিনি মালালার বইটি পড়েননি, অথচ তার উপস্থাপিত প্রোগ্রামটি বইটির কড়া সমালোচনা এবং মালালা সম্পর্কে কটূক্তিতে ভরা ছিল।  তবে তিনি নিজের ভুলের কথা স্বীকার করে উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। মালালার বইটির ওপর যেসব আপত্তি ওঠানো হয়েছে তা সবই যে ভুল তা কিন্তু নয়। সত্য কথা হলো, আমি যখন তার বইটি পড়েছি আমার কাছেও কিছু বিষয় ভুল বলে মনে হয়েছে।

আমার মতে মালালার বইটিতে ভালো বিষয় বেশি, এর তুলনায় ভুল কম। তবে তার একটি বিষয় অনেক ভালোকে ম্লান করে দিয়েছে। তার বইটিতে অভিশপ্ত সালমান রুশদির প্রসঙ্গ আনার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। এটাও বলা হচ্ছে যে, এই বইটির যারা বিরোধিতা করেছেন তাদের পেছনে কোনো গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে। মূলত মালালার সঙ্গে বইটির যৌথ লেখক বৃটিশ সাংবাদিক ক্রিস্টিনা ল্যাম্বের ব্যক্তিত্ব ও চিন্তাধারা বিভিন্ন স্থানে ভৌগোলিক বাস্তবতাকে উপেক্ষা করেছে। ক্রিস্টিনা ল্যাম্বে জানেন না, উপমহাদেশের মুসলমানরা তাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সা.-এর সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় উৎসর্গ হওয়াকে নিজেদের জন্য সৌভাগ্যের বিষয় মনে করে। মুসলমানদের প্রিয়নবীর বিরুদ্ধে একটি বই রাজপালও রচনা করেছিলেন, যাকে হত্যা করেন গাজী ইলমেদ্বীন নামক এক ব্যক্তি। ইংরেজ সরকার গাজী ইলমেদ্বীনকে ১৯২৯ সালে মৃত্যুদণ্ড দেয়; কিন্তু তিনি চিরদিনের জন্য মুসলমানদের কাছে হিরো হয়ে আছেন। গাজী ইলমেদ্বীনের আইনজীবী ছিলেন কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ । আর আল্লামা ইকবাল ছিলেন তার সক্রিয় সহযোগী। গাজী ইলমেদ্বীনকে রাজপালের হত্যার জন্য কোনো গোয়েন্দা সংস্থা উস্কে দেয়নি।

ক্রিস্টিনা ল্যাম্বের দাবি, তিনি পাকিস্তানকে খুব ভালোভাবে জানেন। কিন্তু বইটি পড়ে মনে হয়, যেখানে যেখানে তিনি মালালার সহযোগী হওয়ার চেষ্টা করেছেন সেখানেই বিচ্ছুতি ঘটেছে। পাকিস্তানে সালমান রুশদির বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছিল ১৯৮৯ সালে, আর মালালার জন্ম ১৯৯৭ সালে। ১৯৮৯ সালের ঘটনা মালালার বইয়ে আনার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। একদিকে ক্রিস্টিনা ল্যাম্বে মালালাকে অপ্রয়োজনীয় বিতর্কে টেনে এনেছেন অন্যদিকে কিছু কলামিস্ট তার বই থেকে অপ্রাসঙ্গিকভাবে উদ্ধৃত করে তাকে ইসলাম ও মুসলমানের শত্রু হিসেবে পরিচিত করার অপচেষ্টা করেছেন।

বইটির ৩৭ পৃষ্ঠায় মালালা লিখেছেন, “আমার বাবার কলেজে সালমান রুশদির একটি বই পড়ানো হয়। কিছু ছাত্রের মত হলো, এই বইটি নিষিদ্ধ করা হোক। আমার বাবাও এই বইটি ইসলামবিরোধী হিসেবেই জানতেন। কিন্তু তিনি প্রগতিশীল মানসিকতা লালন করার কারণে সিদ্ধান্ত নিলেন, প্রথমে এই বইটি পড়ানো হোক; পরে এর জবাবে একটি বই লেখা হবে। তিনি বললেন, ইসলাম কি এতই দুর্বল যে, তার বিরুদ্ধে লেখা একটি বইও সহ্য করতে পারবে না?”

বাহ্যিক দৃষ্টিতে এই উদ্ধৃতিতে সালমান রুশদির প্রতি কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই; কিন্তু তা সত্ত্বেও এই বিষয়টি আমার কাছে খারাপ লেগেছে। কারণ বেশ কিছু পশ্চিমা দেশে ইহুদিদের সঙ্গে হলোকাস্টে যে আচরণ করা হয়েছে সে সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা অপরাধ বলে গণ্য হয়। কারণ এতে ইহুদিদের আবেগ-অনুভূতিতে আঘাত লাগে। বাকস্বাধীনতার নামে ইহুদিদের আবেগ-অনুভূতিতে আঘাত দেয়া যেমন সমীচীন নয় তেমনি মুসলমানদের প্রাণের চেয়েও প্রিয় নবীকে অবমাননা করাও অন্যায়। তবে এটাও এখানে বিবেচনা করতে হবে যে, মালালার বাবা সালমান রুশদির বিরুদ্ধে বই লেখার ঘোষণা দিয়েছেন। এমন ব্যক্তি কি ইসলামের শত্রু হতে পারে!

এ বিষয়টিও আমার কাছে খারাপ লেগেছে, বইটির কোথাও নবী করিম সা. এর নামের সঙ্গে ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম.’ বা ইংরেজিতে PBUH লেখা হয়নি। এটা অনেক বড় ভুল। ভুল অবশ্যই ধরিয়ে দিতে হবে এবং তা সংশোধনের জন্য সতর্ক করতে হবে। কিন্তু কাউকে ‘কাফের’ বলে দেয়া এটা সাংবাদিকদের কাজ নয়, এটা শুধুই আলেমদের কাজ। আমরা তো এটাও দেখি যে, বইটির ৭৫ পৃষ্ঠায় মালালা বলছেন, “আমি এজন্য গর্বিত, আমার দেশ মুসলিম বিশ্বের সর্ববৃহৎ দেশের মর্যাদা পেয়েছে।” মালালা কায়েদে আজমকে ‘জিন্নাহ’ নামে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু তাকে মুসলমানদের অধিকার আদায়ের প্রতিনিধি বলেছেন। মালালা এটাও বলেছেন, কাশ্মির পাকিস্তানেরই অংশ হওয়া উচিত, ভারতের নয়। কারণ কাশ্মিরের জনসংখ্যার বেশির ভাগ মুসলমান। বইটিতে নিজের জীবনের বিভিন্ন সমস্যা ও সংকটের কথা তুলে ধরেছেন মালালা। প্রতিটি সংকটে মালালার মা আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করতেন এবং কুরআন পাকের তেলাওয়াতে মগ্ন হয়ে যেতেন। মালালা তার বইয়ে নিজের কুরআন খতমের কথা অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। খতমের পর মালালা কোরআনের তরজমাও পড়া শুরু করেছিলেন। একবার কুরআনের পাঠদানকারী উস্তাদ পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর হত্যাকে জায়েজ বললে মালালা এ বিষয়ে তার বাবার কাছে অভিযোগ করেন। কিন্তু মালালার বাবা তাকে বলে দিলেন, তুমি শুধু উস্তাদের কাছ থেকে শুদ্ধ করে কুরআন পড়বে, তার চিন্তা-চেতনার দিকে একদম নজর দেবে না। এটা কি কুরআনের প্রতি ভালোবাসা থেকে নয়!

মালালা তার বইয়ে উল্লেখ করেন, তের বছর বয়সে তার শারীরিক বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। তখন তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ আমার উচ্চতা আরেকটু বাড়িয়ে দিন। আমি শোকরিয়া হিসেবে ১০০ রাকাত নফল নামাজ পড়বো।’ মালালা বলেন, তিনি রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে আয়াতুল কুরসি পড়তেন।

তিনি তার বইয়ে লিখেছেন, তিনি যখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন তখন তার বাবা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তার মা ছিলেন খুবই আশাবাদী। কারণ তিনি প্রতি বেলা নামাজের পর কুরআনের সুরা হজ তেলাওয়াত করতেন। আর আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! আমার মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখো!’

এছাড়া যারা মালালার ওপর গুলি চালিয়েছিল তাদের ব্যাপারে বইয়ের কোথাও মিথ্যা লেখেননি। তিনি পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী সওয়া অঞ্চলে চরমপন্থীদের উত্থানের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে লিখেছেন, ২০০৫ সালে সওয়াতে যখন ভূমিকম্প হয় তখন সেখানকার লোকদের সাহায্য-সহযোগিতায় সরকার এগিয়ে আসেনি, এগিয়ে এসেছিল তালেবানদের সংগঠন ‘তাহরিকে নেফাজে শরিয়তে মুহাম্মদি’। মালালা কাশ্মিরে বিলুপ্তপ্রায় লস্করে তৈয়্যেবার সেবামূলক কার্যক্রম এবং মুজাফফরাবাদের জামায়াতুত দাওয়াহ’র হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার কথাও তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন।

মালালা তার বইয়ের বিভিন্ন স্থানে মার্কিন ড্রোন হামলার সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ২০০৬ সালের অক্টোবরে সীমান্তবর্তী ‘হাজোর’ এর একটি মাদরাসায় ড্রোন হামলায় ৮০ জন মারা যান। তাদের মধ্যে মাওলানা ফজলুল্লাহর ভাই মাওলানা লিয়াকত এবং তার তিনজন শিশুসন্তানও ছিল, যাদের বয়স ১২ পার হয়নি। এই হামলার পর প্রতিশোধের শপথ নেয়া হয়। এর দশদিন পরই ‘দরগায়ী’ নামক স্থানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ট্রেনিং সেন্টারে আত্মঘাতি বোমা হামলায় ৪২ সেনা সদস্য মারা যান। মালালার বইয়ে বলা হয়েছে, ২০০৭ সালের জুলাই মাসে ইসলামাবাদের লাল মসজিদে পরিচালিত অপারেশনে যেসব তালেবান মারা গেছেন তাদের কয়েকজন সওয়াতের। লাল মসজিদ অপারেশনের পর সওয়াতের তালেবানরা পাল্টে যান এবং তারা পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।

‘আই অ্যাম মালালা’য় পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের অনেক সমলোচনা রয়েছে। এর একটি কারণ বোধহয় এটা যে, মালালার কথা অনুযায়ী সওয়াত অপারেশনে তার শিক্ষকের এক নির্দোষ ভাইকে সেনাবাহিনী গ্রেফতারের পর নির্যাতন করে হত্যা করে। পরে সেনাবাহিনী এ কথা স্বীকার করেছে যে, তিনি নির্দোষ ছিলেন। মালালার বইয়ে গুম হওয়া মানুষদের বর্ণনা এবং তাদের পরিবারের শোকগাথা উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে মালালা সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইশতিয়াক পারভেজ কিয়ানির অনেক প্রশংসা করেছেন। বইটি পড়ে জানা যায়, মালালাকে বার্মিংহাম হাসপাতালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত ছিল জেনারেল কিয়ানির। তার বাবা জিয়াউদ্দিন ইউসুফজাই বৃটেনে যেতে চাচ্ছিলেন না। পরে তাকে বাধ্য করা হয় বার্মিংহামে যেতে, যাতে মালালা হাসপাতালে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে না করে।

বইটির পরতে পরতে মালালার দেশে ফিরে আসার স্বপ্ন ফুটে ওঠেছে। আমি মালালা ও তার বাবার কাছে অনুরোধ জানাবো, বইটির পরবর্তী সংস্করণে এর ভুলগুলো দয়া করে শুধরে নেবেন। নবী করিম সা.-এর নামের সঙ্গে ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ লাগিয়ে নেবেন। সালমান রুশদির প্রসঙ্গটিই বাদ দিয়ে দেবেন। অথবা নোটে এ কথা লিখে দেবেন, কিছু কিছু পশ্চিমা দেশে বাকস্বাধীনতার মাপকাঠিতে সালমান রুশদি মুসলমানদের নবীর বিরুদ্ধে বই লেখার অনুমতি পান, কিন্তু ইহুদিদের হলোকাস্টে সমালোচনা করার অনুমতি নেই।

মালালার বইয়ের সবচেয়ে সুন্দর অংশ হলো ২৬১ পৃষ্ঠা। সেখানে তিনি লিখেছেন, তাকে বলা হয়েছিল, কাবা শরিফে দৃষ্টি পড়ার পর যে দোয়া করবে সে দোয়াই কবুল হয়ে যাবে। যখন মালালার দৃষ্টি কাবা শরিফের ওপর পড়ে তখন তার দু’চোখে পানি চলে আসে। তখন মালালা দোয়া করেন, ‘হে প্রভু! পাকিস্তানে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে দিন। মেয়েদের শিক্ষার দুয়ার খুলে দিন।’

[৭ নভেম্বর ২০১৩ বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের দৈনিক জং-এ প্রকাশিত হামিদ মীরের উর্দু লেখা থেকে অনুবাদ]

Related posts

*

*

Top