তাবলিগে সংকট ও কোটি হৃদয়ের আকুতি

জহির উদ্দিন বাবর
Tabligসারাবিশ্বে দাওয়াতের স্বীকৃত ও ফলপ্রসূ প্লাটফর্ম হলো তাবলিগ জামাত। দীনের প্রতিটি অঙ্গনে যখন অবক্ষয়ের ছোঁয়া লেগেছে তখনও বৃহৎ ঐক্য ও আস্থার জায়গটি ধরে রেখেছে সর্বমহলে স্বীকৃত এই কর্মধারাটি। একটা সময় আমরা গর্ব করে বলতাম, এখানে নেই নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা, লৌকিকতার বাহার কিংবা স্বার্থের দ্বন্দ্ব। গতানুগতিক দল, সংগঠন ও সংস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে এর কার্যক্রম। বাহ্যিক কোনো আয়োজন ও প্রস্তুতি ছাড়াই বিশাল এই প্লাটফর্ম এগিয়ে চলছে লক্ষ্যপানে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে দাওয়াত ও তাবলিগের বহমান ধারাটি কোথায় যেন হোচট খেয়েছে। আগের সেই সাবলীল গতিধারা আর যেন বাকি নেই। প্রায়ই শুনি তাবলিগের নানা সমস্যার কথা। কোটি কোটি মানুষের এই কর্মধারায় ছোটখাট কিছু সমস্যা হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। কিন্তু এই সমস্যার আকার যখন প্রকট রূপ ধারণ করে তখন তা সবাইকে ভাবিয়ে তুলে।

তাবলিগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলয়াস রহ. একজন বিশ্বখ্যাত আলেম। তিনি দারুল উলূম দেওবন্দের সূর্যসন্তান। তাঁর হাতে সূচিত কর্মধারা দারুল উলূম দেওবন্দের চিন্তাচেতনা অনুযায়ী হবে এবং এখানে নেতৃত্বে থাকবেন আলেম-ওলামা এটা খুবই স্বাভাবিক। ইলয়াস রহ. এই কাজের শুরুতে ব্যাপক হারে আলেমদের সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেছেন। আলেমদের সম্পৃক্ততা কমে গেলে দাওয়াতের এই কাজ বিকৃত রূপ লাভ করতে পারে সেটা তিনি ভালোভাবেই টের পেয়েছিলেন। এজন্য বিভিন্ন সময় আক্ষেপও করেছেন। ইলয়াস রহ.-এর পরে এতদিন ধরে আলেমরাই তাবলিগের কাজে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। যখন থেকে আলেম ও গায়রে আলেমের মধ্যে বিভাজনটা প্রকট আকার ধারণ করেছে তখনই মূলত সমস্যার সৃষ্টি।

গত কয়েক বছর ধরে তাবলিগের প্রধান মারকাজ দিল্লিতে শীর্ষ মুরব্বিদের মধ্যে মতপার্থক্য চলছে। শীর্ষ ব্যক্তিদের বিরোধে এক পর্যায়ে অনেক পুরোনো সাথী মারকাজ থেকে চলে যান। সেই বিরোধের ধাক্কা কাকরাইলেও এসে লাগে। এখানকার বিরোধও একসময় প্রকাশ্যে চলে আসে। দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন তাবলিগের সাথীরা। খুনোখুনির মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও তাবলিগে ঘটেছে। যেহেতু বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করে থাকে কাকরাইল এজন্য তাবলিগের কেন্দ্রীয় বিরোধটা এখানেও ডালপালা গজাতে থাকে। গত বছর ইজতেমার সময় ভেতরে ভেতরে অনেক কিছু ঘটে যায়। অভিযোগ রয়েছে, কাকরাইলের নেতৃত্ব এখন জেনারেল শিক্ষিতদের হাতে। তারা আলেমদেরকে তেমন একটা পাত্তা দিতে চান না। কৌশলে কাকরাইলে থাকা আলেমদেরকে তারা কোণঠাসা করে রেখেছেন।

গত বছর ইজতেমার পর তাবলিগের বিরোধ প্রকাশ্যে আসে। তাবলিগের ভেতরে যে সমস্যা চলছে এটা আর কারও জানার বাকি থাকে না। এক পর্যায়ে শীর্ষ আলেমরা এই বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা করেন। কাকরাইলের মুরব্বিদের সঙ্গে আলেমদের দফায় দফায় বৈঠকও হয়েছে। তবে শীর্ষ আলেমদের অভিযোগ, তাদের সঙ্গে করা ওয়াদা রক্ষা করেননি কাকরাইলের কর্তৃপক্ষীয় ব্যক্তিরা। সেখানে একটি চক্র প্রবল শক্তি নিয়ে বসে আছে, যারা কাউকেই তোয়াক্কা করতে চায় না। তাবলিগকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনার জন্য সেই চক্রটি ভাঙার ব্যাপারে সোচ্চার  হয়েছেন আলেম-ওলামা।

তাবলিগে মূল সমস্যাটি সৃষ্টি হয়েছে শীর্ষ মুরব্বি মাওলানা সাদ কান্ধলবীকে কেন্দ্র করে। তিনি তাবলিগের দ্বিতীয় আমির মাওলানা ইউসুফ রহ.-এর নাতি। আর ইউসুফ রহ. ছিলেন তাবলিগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলয়াস রহ.-এর ছেলে। ২০১৪ সালে ইউসুফ রহ.-এর আরেক নাতি মাওলানা যোবায়েরুল হাসান রহ. ইন্তেকাল করেন। তিনি সবার কাছে সমানভাবে স্বীকৃত ছিলেন। তৃতীয় আমির এনামুল হাসান রহ.-এর পর তাবলিগে আমির নির্বাচন করা হয়নি। শুরা বা পরামর্শের ভিত্তিতেই এই কাজ পরিচালিত হয়ে আসছে। তবে এনামুল হাসান রহ.-এর ছেলে যোবায়েরুল হাসান তাঁর ব্যক্তিত্বের কারণে অঘোষিত আমির হিসেবেই সবার কাছে বিবেচিত ছিলেন। তাঁর ইন্তেকালের পর মাওলানা সাদ মূলত সেই জায়গাটি দখল করতে চান। তিনি মনে করেন বংশীয়ভাবে এই কাজের নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা একমাত্র তাঁরই আছে। যদিও মাওলানা যোবায়েরুল হাসান রহ.-এর ছেলে যোহারেুল হাসানও আছেন নেতৃত্বের দৌড়ে। তবে দিল্লি মারকাজের পুরোনো ও শীর্ষ মুরব্বিদের বেশির ভাগই মাওলানা সাদ সাহেবের বিপক্ষে। তাদের অভিযোগ, মাওলানা সাদ নেতৃত্বের পাগল। নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সন্ত্রাসী বাহিনী পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন। তিনি কাউকে মূল্যায়ন করেন না। তাঁর ইলমি যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে মুরব্বিদের।

মাওলানা সাদ সাহেব বিতর্কের কেন্দ্রে আসার আরেকটি কারণ হলো তিনি এমন কিছু বক্তব্য ও মত দিয়েছেন যা আলেমরা মেনে নিতে পারছেন না। যেমন মুসা আ. দাওয়াত ছেড়ে চলে গিয়ে ভুল করেছেন; পকেটে ক্যামেরাওয়ালা মোবাইল রেখে নামাজ পড়লে নামাজ হবে না; মাদরাসায় জাকাত দিলে তা আদায় হবে না; মসজিদে ইমামতি ও মাদরাসায় পড়িয়ে টাকা নেয়া জায়েজ নেই ইত্যাদি বক্তব্য তুমুল বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। মাওলানা সাদ তেমন বড় কোনো আলেম নন, তাছাড়া তাঁর আলেম হওয়া নিয়েও আছে বিতর্ক; তাঁর মুখে এ ধরনের বিতর্কিত বক্তব্য আলেমরা সহজে মেনে নিতে পারেননি। ভারতের শীর্ষ আলেমরা এসব বক্তব্যের কড়া প্রতিবাদও করেছেন। এক পর্যায়ে দারুল উলূম দেওবন্দ তাঁর বিপক্ষে ফতোয়া দিতে বাধ্য হয়েছে এবং এখনো দেওবন্দ মাদরাসায় তাবলিগের কার্যক্রম স্থগিত আছে।

istam80গতবার নানা নাটকীয়তার পর শেষ মুহূর্তে বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেন মাওলানা সাদ এবং দুই পর্বেই তিনি মোনাজাত পরিচালনা করেন। এবারও যখন ইজতেমা ঘনিয়ে আসছে তখনই তাঁকে নিয়ে বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ১১ নভেম্বর শনিবার উত্তরায় শীর্ষ আলেমরা জড়ো হয়েছিলেন একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে। দেশের সর্বশীর্ষ আলেম আল্লামা শাহ আহমদ শফী দা.বা. সেখানে উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও অসুস্থতাজনিত কারণে আসতে পারেননি। তিনি প্রতিনিধি পাঠিয়ে তাঁর বক্তব্য জানিয়ে দিয়েছেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সব মত-পথ ও গড়ানার মূলধারার শীর্ষ আলেমরা। দীর্ঘ সময় তাদের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে তাবলিগের বিভক্তির কথা। তবে সবার বক্তব্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন মাওলানা সাদ। তাঁকে তুলোধুনো করেছেন মোটামুটি সবাই। এমনকি কেউ তাকে  ‘গোমরাহ’ কেউ ‘মুরতাদ’ কেউ ‘জাহেল’ এ ধরনের নানা টাইটেল দিয়েছেন। সভা থেকে তাঁকে বাংলাদেশে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করে ইজতেমায় আসতে দেয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে।

তাবলিগের বিরোধ নিরসনে আলেম-ওলামাদের এধরনের উদ্যোগ প্রশংসাযোগ্য। তবে এভাবে খোলা ময়দানে ব্যাপক উপস্থিতির সামনে একজন আলেমের ব্যাপারে প্রকাশ্যে বক্তব্য রাখা নিয়ে কিছুটা সমালোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে এই মঞ্চ থেকে রাজনৈতিক বক্তব্য এসেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাবলিগ যেহেতু একটি অরাজনৈতিক প্লাটফর্ম এখানে রাজনৈতিক ভাষায় কথা বলা কারও কাম্য নয়। শনিবারের সমাবেশটিতে আলেমরা যে ভাষায় কথা বলেছেন সেটা একজন ব্যক্তির সংশোধন হওয়ার ক্ষেত্রে কতটা উপযোগী তা তারাই ভালো বলতে পারবেন। সমাবেশে যারা বক্তব্য দিয়েছেন তাদেরকে নিয়ে একটি ঘরোয়া পরিবেশে পরামর্শ সভা হতে পারতো। সেখানে নেয়া সিদ্ধান্তগুলো জানিয়ে দিলেই হতো। এভাবে প্রকাশ্য সমাবেশ করে একটি ফেতনা নির্মূল করতে গিয়ে আরও কতটি ফেতনার যে জন্ম হবে সেটা আশঙ্কার বিষয়।

তবে সবকিছুর পরে আলেমদের হস্তক্ষেপ ও ভূমিকা প্রশংসার যোগ্য। যেকোনো মূল্যে তাবলিগের কাজ আলেমদের তত্ত্বাবধানেই হওয়া উচিত। এখানে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ থাকবে, কিন্তু মূল নেতৃত্বে থাকতে হবে আলেমদের। না হলে এর বিকৃতি কেউ ঠেকাতে পারবে না। এখানে কোনো ব্যক্তি মুখ্য নয়, কাজটিই মুখ্য। দাওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য এছাড়া বিকল্প কোনো বড় প্লাটফর্ম নেই। দেশি-বিদেশি কুচক্রি মহল এই কাজকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এজন্য যেকোনো মূল্যে তাবলিগের বিভক্তি নিরসন করতে হবে। যেহেতু এটা দীনি কাজ তাই এর মধ্যে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান দীনিভাবেই খুঁজতে হবে। কোটি কোটি হৃদয়ের আকুতি, আস্থা ও নির্ভরতার একমাত্র প্রতীক এই প্লাটফর্মটি মুক্ত থাকুক সব বিতর্ক থেকে। দাওয়াত ও তাবলিগের এই ধারা অব্যাহত থাকুক কেয়ামত পর্যন্ত। ব্যক্তিস্বার্থে নয়, একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আসুক এ ব্যাপারে যাবতীয় সিদ্ধান্ত।

Related posts

*

*

Top