সমাজেও চাই আলেমদের সরব ভূমিকা

urlসমাজের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ আলেমসমাজ। সমাজের ভরসাস্থলও তাঁরাই। তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের মূল্যায়ন সমাজের অন্য যেকোনো শ্রেণীর চেয়ে একটু ভিন্ন। তাদেরকে সবাই যেমন সম্মানের চোখে দেখে, তেমনি কিছু ব্যতিক্রম বাদে সমীহও করে। এজন্য সমাজে আলেম-ওলামার ভূমিকাটা অন্যদের তুলনায় জোরালো হওয়ার কথা। ধর্মীয় প্রয়োজন তাঁরা যথার্থভাবেই পূরণ করছেন। জাতিকে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করতেও তাদের প্রয়াস লক্ষ্যণীয়। তবে আলেমদের সমাজঘনিষ্ঠতাটা একটু কম বলেই মনে করা হয়। সমাজের নানা পর্যায়ে আলেমদের ভূমিকা আরো যত সক্রিয় হওয়ার কথা ছিল ততটা নেই। কিছু ব্যতিক্রম বাদে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সমাজের গতিবিধি আলেমদের

পর্যবেক্ষণের বাইরে। ধর্মীয় প্রয়োজন বাদে সমাজসংশ্লিষ্ট কর্মকা- তাদের থেকে খুব একটা নজরে পড়ে না।
মুসলিম বিশ্বের প্রখ্যাত ইসলামী স্কলার মাওলানা সাইয়েদ সালমান হোসাইনী নদভী বাংলাদেশে সফরকালে একবার বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের আলেমসমাজের পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ হচ্ছে তারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। এদেশের দীনী মাদরাসাগুলো এক একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। প্রত্যেকে তাদের স্ব স্ব দ্বীপে অবস্থান করেই তৃপ্ত থাকছে, অন্যের কথা ভাবার কোনো তাগিদ তারা অনুভব করছেন না। এভাবে চলতে থাকলে এদেশের আলেমসমাজ চরম হুমকির সম্মুখীন হতে পারেন।’ এ ধরনের সতর্কবাণী আরো অনেক আগেই এদেশে সফরে এসে উচ্চারণ করেছিলেন বিংশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ খ্যাত সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.। তিনি এদেশের আলেমদেরকে সমাজের সঙ্গে মিশে কাজ করার জন্য বারবার তাগিদ দিয়েছেন। এদেশের সমাজব্যবস্থা, এখানকার রাজনীতি, শিল্প, সাহিত্য, ভাষা সবকিছুর মধ্যে নিজেদেরকে অপরিহার্য করে তোলার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছেন।

আলেমসমাজের সমাজবিচ্ছিন্নতা দিনদিন চরম পরিণতির দিকে এগুচ্ছে। সমাজের প্রতি তাদের আকর্ষণ ও ভাবনার গভীরতা ক্রমেই যেন ক্ষীণ হয়ে আসছে। যারা সমাজের গতিধারার নিয়ন্ত্রক হওয়ার কথা ছিল সমাজের প্রতি তাদের এই নির্মোহতা যুগপৎ ব্যথিত ও বিস্মিত করে। সংখ্যা ও সামর্থের দিক থেকে এদেশের আলেমসমাজ পিছিয়ে নেই। প্রয়োজনীয় উপকরণ তাদের হাতে রয়েছে। কিন্তু এসবের উপযুক্ত প্রয়োগ তারা ঘটাতে পারেননি বলেই মনে করা হয়। সমাজকেন্দ্রিক ভাবনার অভাবে তাদের কোনো সম্ভাবনাই যেন আলোর মুখ দেখছে না। কারণ সমাজের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজস্ব ভুবন সৃষ্টির কোনো সুযোগ নেই।
আমাদের দেশে ও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে আলেম-ওলামার উপস্থিতি তেমন চোখে পড়ে না। দেশের কী-পয়েন্ট যাদের মনে করা হয় সেখানে আলেমদের কোনো উপস্থিতি নেই। সংকীর্ণ গ-ি ও নির্দিষ্ট সীমারেখাতেই আবদ্ধ আলেম-ওলামার যাবতীয় কার্যক্রম। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার সঙ্গে তারা সর্বোতভাবে জড়িত নন। শিক্ষা, সাহিত্য, রাজনীতি, দর্শন, দৃষ্টিভঙ্গি কোনো ক্ষেত্রেই তারা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের ছাপ লাগাতে পারেননি। তাদের প্রণীত শিক্ষাধারাকে শ্রেষ্ঠ মনে করা হলেও সমাজের বিশাল অংশ এর প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত। সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তাদের উদাসীনতা রীতিমতো বিস্ময়কর। রাজনৈতিক ময়দানে তাদের দীনতার কথা ভাবলেও লজ্জিত হতে হয়। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সঙ্কীর্ণতার দোষে দুষ্ট। উদার ও প্রসার চিন্তাধারা তাদের থেকে খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না। তাদের কর্মকা-গুলো মহৎ হলেও তা ততটা জোরালো ও গোছালো নয়।

সমাজ থেকে আলেমদের দূরে সরে পড়ার জন্য জনসাধারণের উপেক্ষা যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী আলেমদের সমাজের প্রতি নির্মোহতা। সামাজিক দায়িত্ববোধের ক্ষেত্রে আজকের আলেমসমাজ নিদারুণ পিছিয়ে আছে। সমাজবিচ্ছিন্ন মনোভাব তাদের মধ্যে বদ্ধমূল। এজন্য সমাজের প্রতিনিধিত্ব করার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন মনে করা হচ্ছে না আলেমদেরকে। সমাজের অন্যান্য শ্রেণী-পেশার মানুষদের যেভাবে মূল্যায়ন করা হয় সেভাবে আলেমদেরকে করা হয় না বললেই চলে। সাধারণ মানুষের ধারণা, আলেম-ওলামার জায়গা মসজিদ-মাদরাসা। এর বাইরে কেনা তাঁরা আসবেন। সমাজের নানা স্তরে যে আলেমদের উপস্থিতি থাকতে পারে সেটা মানুষের ধারণার বাইরে। সমাজ পরিচালনার যথেষ্ট যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আলেমরা আজ নিজেদের প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বর্তমানে সামাজিক পর্যায়ে আলেমদের খুব একটা সুনজরে দেখা হয় না। নাগরিক মর্যাদায়ও তারা কয়েক ধাপ নীচে। এটা তাদের জন্য যেমন অপমানকর, তেমনি জাতির জন্যও দুর্ভাগ্যের বিষয়।

আলেমসমাজের জন্য এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখে সার্বিকভাবে সমাজের সঙ্গে নিজেদের জড়িত করা। যোগ্যতা ও পদাধিকার বলে সমাজের হর্তাকর্তা তারাই হওয়ার কথা ছিল। ওলামায়ে কেরামের সোনালী অতীত সে কথাই প্রমাণ করে। এজন্য সমাজে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করতে আলেমদের সমাজঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। সমাজের সঙ্গে মেশা ও জড়ানোর অর্থ বহমান গতিধারায় বিলীন হয়ে যাওয়া নয়। এটা কখনও হতে পারে না, আলেমদের শানও এমন নয়। নিজেদের অবস্থান বজায় রেখেও সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে নিজেদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়। যেমন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আলেমরা অংশ নিতে পারেন। এর মাধ্যমে তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না খুব কাছ থেকে ভাগাভাগি করা যায়। সমাজসেবার মাধ্যমে আলেমরা সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারেন। শুধুই ধর্মীয় বিষয়ে নয়, সামাজিক নানা বিষয়েও আলেমদের চাই সরব ভূমিকা।

Related posts

One Comment;

  1. সাইমুম আলী said:

    সুন্দর বিশ্লেষণ। সুপ্রভাত ওলামায়ে কেরাম।

*

*

Top