আদর্শবাদী এক কবির প্রতিচ্ছবি

cmsinblog-netকবি ও কবিতার প্রতি আসক্তি বা অনুরাগ নেই এমন লোক সমাজে খুব কম। কবিতার সম্পর্ক আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত। যুগে যুগে কবিরা তাদের কবিতার মাধ্যমে ফুঁটিয়ে তুলেছেন সমাজের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। অন্যায়, অসত্য আর অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তাদের কলমে গড়ে তুলেছেন তুমুল প্রতিরোধ। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের পাশাপাশি বাস্তবতার নিরিখে অংকন করেছেন সমাজের চিত্রকে। কবিতা হচ্ছে সমাজের দর্পণ। সমাজ সভ্যতার উৎকর্ষ সাধনে কবিতার ভূমিকা অপরিসীম। কবিতার মধ্যে প্রেম, ভালোবাসা, অনুরাগের কথা যেমনিভাবে উঠে এসেছে; তেমনি বর্ণিত হয়েছে চিন্তা, চেতনা, আদর্শ ও কৃষ্টির কথা। কবিরা তাদের লালিত বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন

তাদের কবিতার মাধ্যমে। ছন্দের ঝঙ্কারে, সুরের মুর্ছনায়, ভাষার শৈল্পিকতায় এবং ভাবের সুনিপুণ উপস্থাপনায় মানুষদেরকে তারা করে নিয়েছেন আপন। সাধারণ মানুষের কাছাকাছি থেকে তারা ভাগ করে নিয়েছেন তাদের সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনার প্রতিটি মুহূর্তকে। সাধারণ মানুষের অব্যক্ত কথাগুলো ব্যক্ত হয়েছে তাদের কবিতার মাধ্যমে। তাদের কলমের ডগায় প্রতিফলিত হয়েছে জাতির স্বপ্ন। তবে কথা-কাজে মিল আছে এমন কবির সংখ্যা কম। অনেকেই নিজে যা লিখতেন অন্তরে তা বিশ্বাস করতেন না। ব্যতিক্রম ছিলেন কবি ফররুখ। ইসলামি রেনেসাঁর এই কবি ছিলেন আদর্শবাদী চেতনার বাস্তব প্রতিচ্ছবি।

কবি ফররুখ ১৯১৮ সালের ১০ জুন বর্তমান মাগুরা জেলার মাঝআইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সৈয়দ হাতেম আলী, মাতা বেগম রওশন আক্তার। তিনি ১৯৩৭ সালে খুলনা জেলা স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেন। ১৯৩৯ সালে কলকাতা রিপন কলেজ থেকে আই এ, এবং পরে স্কটিশচার্চ কলেজে দর্শনে অনার্স করেন। কর্মজীবনের শুরুতে ১৯৪৩ সালে এ আই জি প্রিজন অফিসে, ১৯৪৪এ সিভিল সাপ্লাই অফিসে এবং ১৯৪৫-৪৭ এ জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে ও মোহাম্মদী পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করেন। ১৯৪৭ সাল থেকে প্রায় মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ঢাকা বেতারে স্টাফ রাইটার পদে কাজ করেন।

তিনি তাঁর জীবনে বাংলা একাডেমী পুরস্কার, পাকিস্তান সরকারের প্রেসিডেন্ট পুরস্কার“প্রাইড অব পারফরমেন্স”, হাতেমতায়ী গ্রন্থের জন্য আদমজী পুরস্কার, পাখির বাসা গ্রন্থের জন্য ইউনেস্কো পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া মরণোত্তর একুশে পদক ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কারে ভূষিত হন। তাঁর রচনাবলির মধ্যে  Ñ সাত সাগরের মাঝি, সিরাজাম মুনীরা,নৌফেল ও হাতেম, মুহূর্তের কবিতা, পাখির বাসা, হাতেমতায়ী, নতুন লেখা, হরফের ছড়া, ছড়ার আসর, হে বন্য স্বপ্নেরা, হাবেদা মরুর কাহিনী, দিলরুবা, মরুর কাফেলা প্রমূখ উলে¬খযোগ্য। কবিতা ছাড়াও সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার সফল পদচারণা লক্ষ্য করার মতো।

সেই ছোটবেলায় স্কুলের পাঠ্যবইয়ে ফাল্গুনী কবিতায়“আজানের সুর মেশে নীল আকাশে/ শিরশির করে ঘাস হিম বাতাসে/ আচানক দুনিয়াটা আজব লাগে/ আড়মোড়া দিয়ে সব গাছেরা জাগে” এ জাতীয় পংক্তিগুলো পড়ে তাঁর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ি আমরা।  তাঁর কবিতার ভাষা ও ব্যক্তিত্বের মধ্যে রয়েছে দারুণ মিল।  যে আদর্শ, যে বিশ্বাস ও যে চেতনার কথা তাঁর কবিতায় ফুঁটে উঠেছে; বাস্তব জীবনে তিনি তাঁর সঠিক রূপায়ন করেছেন। গতানুগতিক  কবিদের মতো আদর্শের বুলি আওড়িয়ে নিজেকে সে পথে পরিচালিত না করার মতো কবি ছিলেন না ফররুখ। কবিতার অগ্নিঝরায় যে আদর্শ ও বিশ্বাস তুলে ধরেছেন, তিনি ছিলেন তার বাস্তব রূপকার। তাঁর লালিত বিশ্বাসের মূলে আঘাত হেনে তিনি কখনও আদর্শবিচ্যুত হননি। কবি মনের লাগামহীন উচ্ছ্বাসের দোহাই দিয়ে তিনি প্রকৃতিপূজারী  ও অশ্লীলতার ধারক হয়ে উঠেননি। তাঁর মধ্যে যে স্বতন্ত্রতা লক্ষ্য করা যায় তা অন্যদের ক্ষেত্রে বিরল।

প্রিয়কবি ফররুখ ছিলেন ইসলামি পুনর্জাগরণের কবি। ইসলামের হারিয়ে যাওয়া চেতনা, হৃত গৌরব ও স্বর্ণালী ঐতিহ্যের কথা তাঁর কবিতায় স্থান পেয়েছে ব্যাপকভাবে। আত্মবিস্মৃত মুসলমানদের দীলের ঝঙ্কার দূর করার জন্য কবি ফররুখ কলম চালিয়ে গেছেন সারা জীবন। তাঁর কবিতার ছন্দে-ছন্দে যেমন মুসলিম জাতির প্রকৃত পরিচয় ফুটে উঠেছে, তেমনি উঠে এসেছে তাদের বিপর্যয়ের নেপথ্য কথা। প্রাথমিক জীবনে তিনি কমিউনিজমের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু যখন এর অসারতা ও সস্তাবুলি তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠে , তখন তিনি তা পরিত্যাগ করেন; এবং ইসলামি আদর্শে নিজেকে পরিপূর্ণরুপে গড়ে তোলেন। জড়বাদী সভ্যতাকে কটাক্ষ করে তিনি লিখেছেন-
হে জড় সভ্যতা!
মৃত সভ্যতার দাস ;স্ফীতমেদ শোষক সমাজ
মানুষের অভিশাপ নিয়ে যাও আজ।

তাঁর কবিতায় শুধু ইসলামি মূল্যবোধের কথাই রচিত হয়নি, মানবতার প্রতি দরদ ও ভালোবাসার অভিব্যক্তিও পাওয়া যায় । তিনি তাঁর শাণিত কলমের দ্বারা মানবতার স্বপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন জোরালোভাবে। সবধরনের জুলুম, অত্যাচার, শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। সত্য-সুন্দর, ন্যায়-নিষ্ঠার কথা ফুটে উঠেছে তাঁর কবিতার প্রতিটি পংক্তিতে। নির্যাতিত-নিপেড়িত মানবতাকে জাগানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি পাঞ্জেরী কবিতায় লিখেন-
“ওকি দরিয়ার গর্জন-ওকি বেদনা মজলুমের!
ওকি ক্ষুধাতুর পাঁজরায় বাজে মৃত্যুর জয়ভেরী!
পাঞ্জেরী!
জাগো বন্দরে কৈফিয়ত তীব্র ভ্রুকুটি হেরি;
জাগো অগণন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রুকুটি হেরি;
দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কত দেরি! কত দেরি!”

তিনি মানুষের কল্যাণে ব্যয় করেছেন সমস্ত শ্রম ও সাধনাকে। সারা জীবন মানুষকে নিয়ে ভেবেছেন। মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেছেন।  তাঁর লেখা হাতেমতায়ী, দিলরুবা প্রভৃতি কবিতায়  সেই অনুভূতিগুলোই প্রকাশ পেয়েছে।

কবি ফররুখের কবিতায় যে উচ্ছ্বাস, তারুণ্যের দীপ্ত প্রভা ও অনুপ্রেরণা পাওয়া যায় তা খুব কম কবির কবিতায় রয়েছে। কাজী নজরুল ইসলামের পরে কোনো জাতি গোষ্ঠীকে উত্তাল ও জাগ্রত করার কৃতিত্ব একমাত্র কবি ফররুখের কবিতা-ই পাওয়া যায়।  কবি ফররুখ তাঁর কবিতার ছন্দে ছন্দে  স্পৃহার অগ্নি ঝরিয়েছেন। নিদ্রামগ্ন জাতিকে জাগ্রত করার জন্য তিনি অগ্নিস্রাবী ভাষায় কবিতা রচনা করেছেন। যারা সর্বহারা রিক্ত তারা একদিন বিশ্বে জয়ী হবে, এ বিশ্বাস নিয়ে তিনি কবিতা লিখেছেন। তাঁর কবিতা পড়ে যেকোনো বয়সের লোক তার মধ্যে অনুভব করেছে চাঞ্চল্য, নবউদ্দম ও সাহসের সঞ্চালন। প্রেরণা পেয়েছে বাঁচার মতো বাঁচার। সব বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে জেগে উঠার। অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার। সত্য, মুক্ত, স্বাধীন জীবনের শিক্ষা তিনি দিয়েছেন। নতুন পৃথিবী গড়ে তুলতে জাগ্রত তরুণদের উদাত্ত  আহ্বান জানিয়ে তিনি লিখেছেনÑ
পাল তুলে দাও, পাল তুলে দাও মেনো না মানা
দুরন্তচারী স্বপ্ন এ মনে দিয়েছে হানা,
কারা বাঁধা দেয়? কূপমণ্ডুক কে ভীরু প্রাণী
চার দেয়ালের সীমানার ঘের মোরা না মানি।
মুক্তভোরের প্রথম সূর্য চির আযাদ
পাল তুলে দাও ঝাণ্ডা উড়াও
হে মাঝি সিন্দাবাদ।”

অসাধারণ কাব্যপ্রতিভা গুণে কবি ফররুখ খুব কম সময়ে পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন। বাংলা কাব্যে আররি-ফারসি শব্দের সফল প্রয়োগে নজরুলের কাব্য যেমন অনন্য, তেমনি ফররুখও তাঁর পথ অনুসরণ করে এক্ষেত্রে হয়েছেন ব্যাপক সমাদৃত। নিজস্ব সংস্কৃতির অনুসরণে এবং শব্দ ও ভাষা চয়নে মুসলিম কবিদের মধ্যে এ দুজনই স্বতন্ত্রতা ও স্বকীয়তা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন। কবি ফররুখ তার সাহিত্য জীবনে কাজী নজরুল, গোলাম মোস্তফা ও আবুল ফজলের সাহিত্য দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। সনেট রচনার ক্ষেত্রে তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্তকে অনুসরণ করেছেন। এতেই প্রমাণিত হয় যে তিনি সংকীর্ণ মানসিকতার ঊর্ধ্বে থেকে আদর্শের পথে গমন করেছেন। সাম্প্রদায়িকতা, বিদ্বেষমূলক মনোভাব তাঁর ছিল না কখনোই। ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি মাধুর্যপূর্ণ ব্যবহার, চারিত্রিক উদারতা, সর্বোপরি প্রবাদতুল্য আতিথেয়তা দ্বারা সকলের মন জয় করে নিতে সামর্থ্য হয়েছিলেন।

কবি ফররুখের কবিতা সব বিষয়ে ব্যপ্ত। জীবনের নানান দিকের নানান কথা, সমাজের হালচিত্র, আদর্শের স্বপক্ষে জোরালো অবস্থান, অন্যায়-অবিচারের মূলে কুঠারাঘাত , প্রাকৃতিক চিত্রায়ন, প্রেম, প্রীতি, শ্রদ্ধাবোধ এসব বিষয়ে কবি ফররুখ অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। মুসলিম জাতির পরিচয় তুলে ধরে‘ সিন্দবাদ’ কবিতায় তিনি লিখেন-
খুলি জাহাজের হালে উদ্দাম দিগন্ত ঝিলমিল,
জংগী জোয়ান দাড় ফেলে করি দরিয়ার পানি চাষ,
আফতাব ঘোরে মাথার উপরে মাহতাব ফেলে দাগ;
তুফান ঝড়িতে তোলপাড় করে কিশতীর পাটাতন;
মোরা নির্ভীক সমুদ্র স্রোতে দাড় ফেলি বারো মাস।

‘দরিয়ার শেষ রাত্রি’ কবিতায় লিখেনÑ“মোরা মুসলিম দরিয়ার মাঝি মউতের নাই ভয়,
খিজিরের সাথে পেয়েছি আমরা দরিয়ার বাদশাই,
খাকে গড়া এই ওজুদের মাঝে নিত্য জাগায় সাঁড়া
বাগদাদী মাটি; কিশতীর মুখ এবার ঘোড়াও ভাই!

মুসলমানদের সামনে কন্টকাকীর্ণ পিচ্ছিল পথ, শত বাধার বিপত্তি; তবু তাকে এগুতেই হবে। দিগন্তের ওপারে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে সাদর সম্ভাষন। সেই আশার বাণী শুনিয়েছেন ‘সাত সাগরের মাঝি’ কবিতায়-
কাঁকর বিছানো পথ
কত বাধা,কত সমুদ্র পর্বত,
মধ্যদিনের নিশাচরের হামাগুড়ি,
শকুনি ফেলেছে ছায়া আমাদের মাথার উপরে উড়ি,
ফেলেছি হারায়ে তৃণঘন বন যত পুষ্পিত বন
তবু দেখা যায় দূরে বহুদূরে হেরার রাজ-তোরণ
শাহী দরজার সকল কপাট অনেক আগেই খোলা
অনেক আগেই সেখানে দ্বাদশী জোছনা দিয়েছে দোলা।

নবীর প্রেম ও ভালবাসায় কবি ফররুখ ছিলেন আকুল। বিভিন্ন কবিতায় তাঁর সেই ভালোবাসার কথা ব্যক্ত করেছেন। ‘সীরাজাম মুনীরা’ গ্রন্থে নবীজির শানে তিনি লিখেন-
দেখেছি ক্লেদাক্ত পথে ফোটায়ে মুকুল সাজানো তাদের ধরনী গেহ,
যে মরুভূমিতে জানি ফুল ফুটেনাকো, সেখানে ঊষর পৃথ্বীতল,
সেখানেও তুমি জাগালে শস্য, আনলে অঝোর ধারা বাদল।

আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার করুণ চিত্র ধরা পড়েছিল কবি ফররুখের তীক্ষèদৃষ্টিতে। তিনি এর স্বরূপ উম্মোচন করেন ‘অনুস্বার’ গ্রন্থে Ñ
নির্ঘাত ঠকাতে চাও হে সভ্যতা! অসভ্য ইংগিতে
কিন্তু এই শর্মা যেনো অতি ছড়ো বহুঘাট ঘুরে
সঙ্গে সঙ্গে অনিচ্ছায় ঘোলা পানি খেয়ে পেট পুরে
সহজে সে ঠকবেনা দেউলিয়া তোমার ভঙ্গিতে!
জেনেছে সে বিষ আছে, মধু নাই তোমার সংগীতে।

তিনি স্বপ্ন দেখেছেন শান্তি  ও সাম্যের একটি সুশীল সমাজের। দেড় হাজার বছর পূর্বের সেই সোনালী সমাজ ব্যবস্থা পুনরায় কায়েম হবে; নতুন পৃথিবী গড়ে উঠবে; এই আশাবাদ ব্যক্ত করে ‘আজ সংগ্রাম’ কবিতায় লিখেনÑ
প্রতি পাপড়ির পূর্ণ বিকাশে জাগুক, মুক্ত গুলে আনার,
প্রতি পাথরে সম্মেলনের প্রকাশে দাঁড়াক তূর পাহাড়,
নামুক সেখানে তওরাত ধারা, নামুক নূরানী আল কোরান,
পূর্ণ মুমিন জমায়েত হেথা আনুক আবার নতুন বান;
হেরার সূর্য ঝলকে আবার আসুক মুক্তি চির নূতন;
মুজাহিদ সেনা করুক আবার নয়া জামানার উদ্বোধন।

জাতি হিসেবে আমরা বড় দুর্ভাগা! কারণ আমরা জ্ঞানী ব্যক্তিদের যথাযথ মূল্যায়ণ করতে জানি না। যেমনটি ঘটেছে কবি ফররুখের ক্ষেত্রে। তিনি তাঁর কর্মের যথাযথ মূল্যায়ন  পায়নি আমাদের কাছ থেকে। প্রকৃতিপূজারী, স্যেকুলার ও ব্রাক্ষণ্যবাদের নিয়ন্ত্রিত সাহিত্যের ময়দানে কবি ফররুখকে সব সময়ই উপেক্ষা করা হয়েছে। তাঁর অপরাধ তিনি তাদের ধ্যান-ধারণার কবি ছিলেন না। তিনি ছিলেন আদর্শের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। ইসলামের সুমহান আদর্শ ও বিশ্বাসের অনুসারী। এজন্য তাঁকে দেখা হয় অন্য দৃষ্টিতে। তাদের অসার মন্ত্রে একাত্মতাপোষণ করতে পারেননি বলে তাদের দৃষ্টিতে তিনি সাম্প্রদায়িক ও সেকেলে। স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে চিহিৃত করার অপপ্রয়াসও চালিয়েছে। এজন্য স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তাকে নানান হয়রানি করা হয়েছে। ৫২এর ভাষা আন্দোলনে তার ভূমিকা অত্যন্ত উজ্জ্বল । পরবর্তী সময়েও দেশ ও জনগণের জন্য তিনি বিশেষ অবদান রেখেছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে ইন্ধন সৃষ্টিকারী আধিপত্যবাদী ভারতীয় ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করায় তাঁকে দেশদ্রোহী বলার ঔদ্ধত্যও দেখিয়েছে কিছুসংখ্যক জ্ঞানপাপী। ৭১-৭৪ সাল পর্যন্ত নানান বঞ্চনার শিকার হন তিনি। এ সময় বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে তাঁকে তাদের দলভুক্ত করার অপকৌশলও চালানো হয়েছে। তবে তিনি তাঁর সারা জীবনের লালিত বিশ্বাসে অবিচল থেকেছেন। নানান প্রতিকূলতায় পড়েও অসত্যের কাছে মাথা নত করেননি। জীবনের শেষ দিনগুলো তিনি কাটিয়েছেন বিভিন্ন দৈন্যে।

১৯৭৪ সালের ১৯ শে অক্টোবর তিনি ইন্তেকাল করেন। চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়ার মতো নিজস্ব জায়গাটুকুও ছিল না তাঁর। অবশেষে সহযাত্রী এক কবি বেনজীর আহমদের হৃদ্যতায় তারই পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয় ইসলামি রেনেঁসার জন্য নিবেদিত এই মহান কবিকে। ঢাকার শাহজাদপুরের নিভৃত এক গোরস্তানে তিনি শায়িত।

তিনি চলে গেছেন, কিন্তু চলে যায়নি তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ। তাঁর কাব্যের ছন্দে ছন্দে আমরা খুঁজে পাই জীবন চলার পাথেয়। গুটি কতক ইসলাম বিদ্বেষীদের কাছে তিনি উপেক্ষিত হলেও তাওহীদবাদীদের অন্তরে তাঁর স্থান উচ্চাসনে। যুগ যুগ ধরে তাঁর কবিতার মধ্যে খুঁজে পাই  মহান আদর্শ ও বিশ্বাসকে। চিরদিন তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন কবিতার মধ্যদিয়ে।

Related posts

*

*

Top