অস্তিত্ব সংকটে ইসলামী রাজনীতি!

zahirbabor.comআমাদের দেশে ইসলামী রাজনীতির একটি ঐতিহ্য আছে। প্রচলিত রাজনীতির বাইরে ইসলামী ধারার রাজনীতি কিছুটা হলেও স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে। ইসলামী রাজনীতি বলতে বোঝানো হচ্ছে আলেম-ওলামা দ্বারা পরিচালিত রাজনীতি। তবে এদেশে সবচেয়ে বড় ইসলামী দল দাবিদার জামায়াতে ইসলামী এর মধ্যে পড়ে না। কারণ দলটি ইসলামী রাজনীতি ও আন্দোলনের কথা যতই দাবি করুক প্রচলিত ধারার রাজনীতি থেকে খুব একটা স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পারেনি। এজন্য এখানে জামায়াতে ইসলামী আলোচনার অন্তর্ভুক্ত নয়। রাজনীতির বয়স এবং পরিধি হিসেবে ওলামায়ে কেরাম পরিচালিত রাজনীতি এদেশে অনেক পুরোনো। ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে ওলামায়ে কেরামের ভূমিকার কথা কারও অজানা নয়। এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা-স্বাধিকার থেকে শুরু করে পরতে পরতে আলেমরা ভূমিকা পালন করেছেন। বিভিন্ন সন্ধিক্ষণে তাঁরা জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। সাধারণ মানুষের আস্থা এবং নেতৃত্বের যোগ্যতার বিচারে আলেমরা সাধারণ রাজনীতিকদের চেয়ে এগিয়ে আছেন। এজন্য ইসলামী ধারার আন্দোলন-সংগ্রাম শুধু আলেম-ওলামা এবং মাদরাসাপড়–য়াদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সাধারণ মানুষও এর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন।
বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতি মোটাদাগে বিকশিত হয় আশির দশকে। এর আগেও আলেম-ওলামা রাজনীতিতে ছিলেন, তবে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর ডাকেই প্রথম ব্যাপকভাবে আলেমরা রাজনীতিতে আসেন। তাঁর তওবার ডাকে সাড়া দিয়ে খানকা, হাদিসের মসনদ, মসজিদের মিম্বর আর দরস-তাদরিসের পাশাপাশি রাজনীতিটাকেও একটি কাজ হিসেবে গ্রহণ করেন আলেমরা। খালেস দ্বীনি আন্দোলন হিসেবে এই সংগ্রামে জড়িত হওয়াকে ইবাদত হিসেবে গণ্য করেন তাঁরা। হাফেজ্জী হুজুর রহ. দুইবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেন। তাঁর পক্ষে জনমত তৈরিতে আলেম-ওলামার ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। আলেমরাও যে এদেশে একটি শক্তি তখনই সর্বমহলে ব্যাপকভাবে তা আলোচিত হয়। সাধারণ দ্বীনদার মুসলমানরাও তখন আলেমদের এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে তখন সবাই অন্যতম সওয়াবের কাজ হিসেবেই মনে করতেন।
হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর সূচিত আন্দোলনের শুরুতে সবার মধ্যে যে ইখলাস ও লিল্লাহিয়াত ছিল পরবর্তী সময়ে এতে যথেষ্ট ভাটা পড়ে। খোদ হাফেজ্জী হুজুরসহ এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত অনেকেই এতে হতাশ হয়ে পড়েন। ব্যক্তিগত স্বার্থ, পদের লোভ, পারিবারিক ও গোষ্ঠী বলয় ইসলামী রাজনীতির বিকশমান ধারায় যথেষ্ট চিড় ধরায়। যে হাফেজ্জী হুজুর রহ.কে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে মেনে সবাই এককাতারে জড়ো হয়েছিলেন তাঁর জীবদ্দশাতেই আলেমদের মধ্যে বিভেদ চরম আকার ধারণ করে। শুরু হয় ইসলামী ধারার ভাঙা-গড়ার রাজনীতি। হাফেজ্জী হুজুরের ইন্তেকালের পর ইসলামী রাজনীতি বহু ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। একসময়ে রাজনীতিতে যারা সরব ছিলেন তাদের কেউ কেউ একদম চুপ হয়ে যান। আবার যারা সক্রিয় তারাও নিজ নিজ বলয়ে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। এভাবে ইসলামী রাজনীতির সম্ভাবনাময় বিকাশটি প্রথমবারের মতো হোচট খায়। তবে সবকিছুর পরও ইসলামী ধারার রাজনীতিকদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি কিছুটা হলেও শ্রদ্ধাবোধ ছিল। যেকোনো প্রয়োজনে, ইসলাম ও জাতির স্বার্থে সবাই একমঞ্চে জড়ো হয়ে যেতে পারতেন। দ্বীনের ওপর যেকোনো আঘাত এলে সবাই একসুরে হুংকার ছাড়তেন। নিজ নিজ বলয়ে কাজ করলেও সবার মধ্যে দূরতম একটি ঐক্য ছিল। সবাই নিজেদেরকে অভিন্ন প্লাটফর্মের যাত্রী মনে করতেন। নেতারা কিছু মোসাহেব ও চাটুকার বেষ্টিত থাকলেও তাদের মধ্যে একটি ব্যক্তিত্ব ছিল।
ভাঙা-গড়ার হলেও নব্বইয়ের দশকে ইসলামী রাজনীতি একটি স্বতন্ত্র বলয় সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। বেশির ভাগ ইসলামী দল নিয়ে গঠিত ঐক্যজোট এদেশের রাজনীতিতে অন্যতম শক্তি হিসেবে গণ্য হতে থাকে। ভোটের রাজনীতিতেও তাদেরকে একটি ফ্যাক্টর মনে করা হতে থাকে। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ইসলামী দলগুলো বিশেষ ভূমিকা রাখে। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় আসা চারদলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল ইসলামী ঐক্যজোট। প্রথমবারের মতো ইসলামী দলগুলোর চারজন প্রতিনিধি জাতীয় সংসদে যান। এদেশের আলেম-ওলামা, মাদরাসায় পড়–য়া এবং দ্বীনদার মুসলমানদের প্রত্যাশার পারদ অনেক উপরে অবস্থান করতে থাকে। কিন্তু আশার গুড়ে বালি। সামান্য একটি মন্ত্রিত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতেই ভেঙে গেল জোট। কোন দল ও বলয় থেকে কে মন্ত্রী হবেন তা নিয়ে শুরু হয় দর কষাকষি। যারা রাজনীতিতে হাক্কানী ওলামায়ে কেরামের উত্থান চান না তাদের ইন্ধনে একপর্যায়ে রাতের আঁধারে ভেঙে ফেলা হয় ঐক্যজোট। কিন্তু যে আশা নিয়ে জোট ভাঙা হয়েছিল সে আশা পূরণ হয়নি। ব্রাকেটবন্দী জোটকে মন্ত্রিত্ব দেয়নি তথাকথিত ইসলাম ও জাতীয়তাবাদী জোট সরকার। পরবর্তী সময়ে সেই জোট এবং ইসলামী দলগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়েছে। এতে বেড়েছে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, প্রতিহিংসা আর ভ্রাতিঘাতী সংঘাত।
আপাতদৃষ্টিতে ২০০১ সালের নির্বাচনের বিজয়ে ইসলামী দলগুলোর বিশেষ ভূমিকা থাকলেও এই নির্বাচনটি আলেম-ওলামার রাজনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ক্ষমতার কাছাকাছি যাওয়ার ফলে আলেম রাজনীতিকদের মধ্যে এর মোহ ও লোভ প্রকটভাবে ছেয়ে বসে। ক্ষমতায় যাওয়াকেই তারা রাজনীতির লক্ষ্য বানিয়ে নেন। ইসলামী রাজনীতির আদর্শিক যে ধারাটি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছিল তাতে যথেষ্ট চিড় ধরে। যে দলগুলোর মূল লক্ষ্য ক্ষমতা তাদের লেজুরবৃত্তি করতে থাকে ইসলামী দলগুলো। ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার জন্য অনেক ক্ষেত্রে ইসলামের শাশ্বত আদর্শকেও বিসর্জন দেয়া হয়। যেমন সাময়িক প্রয়োজনে নারী নেতৃত্বকে ইসলাম সমর্থন করলেও এটা কোনো স্থায়ী প্রক্রিয়া নয়। কিন্তু নারী নেতৃত্ব যে হারাম সে বিষয়টি ইসলামী দলগুলোর নেতারা প্রায় ভুলেই গেছেন। রমজান মাসে ইফতার মাহফিলে শীর্ষ আলেমদের পাশে খোলামেলা একজন সুন্দরী নেত্রীকে বসিয়ে যেভাবে প্রদর্শন করা হয় তা শরীয়তের কোন গ-িতে পড়ে আল্লাহ মালুম। প্রচলিত ধারার রাজনীতিতে এটা কৃতিত্বের বিষয় হলেও ইসলামী ধারার রাজনীতিতে কোনোক্রমেই সমর্থনযোগ্য নয়। আবার ক্ষমতার জন্য মরিয়া নেতাদের কেউ কেউ সেক্যুলার দলগুলোর সঙ্গে জোট করতেও পিছপা হননি। এভাবে ২০০১ পরবর্তী সময়ে ক্ষমতার মোহ মুখ্য হয়ে ওঠায় ইসলামী রাজনীতি তার স্বকীয়তা হারিয়েছে।
পর পর শীর্ষ কয়েকজন নেতার ইন্তেকালে ইসলামী রাজনীতি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা যে পর্যায়ের নেতা ছিলেন পরবর্তী সময়ে তাদের গড়া দলের যারা হর্তাকর্তা হয়েছেন যোগ্যতা ও মানের বিচারে কোনো অংশেই ধারেকাছেও না। ফলে ইসলামী রাজনীতির প্রভাব সৃষ্টিকারী ধারাটি আস্তে আস্তে ¤্রয়িমান হয়ে পড়ে। ইসলামী রাজনীতির সংকটের পেছনে ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের হঠাৎ উত্থান অনেকাংশে দায়ী। ইসলামী দলগুলোর নেতারা তাদের দলীয় পরিচয়ের বাইরে হঠাৎ করে হেফাজতের পরিচয়ে পরিচিত হতে থাকেন। খালেস দ্বীনি চেতনায় গড়ে ওঠা একটি আন্দোলনকে তারা ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার চেষ্টা করেন। এতে একটি সম্ভাবনাময় আন্দোলনকে তারা যেমন গলাটিপে হত্যা করেছেন তেমনি ক্ষতি করেছেন নিজের দলের। তাদের ভাগ-বাটোয়ারা রাজনীতির বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পর নিজেদের মধ্যেই দানা বাধে অবিশ্বাসের; শুরু হয় টানাপোড়েন।  সেই টানাপোড়েন আজও আছে; এখনও ইসলামী দলগুলো ছন্নছাড়া। লক্ষ্যহীন এই যাত্রা ইসলামী দলগুলোর ভবিষ্যৎ কোথায় নিয়ে ঠেকায় তা বলা মুশকিল।
দুই.
নানা ভাঙা-গড়া ও বিভাজনের পর এখন দেশে বেশ কয়েকটি ইসলামী দলের অস্তিত্ব আছে। কিন্তু ছন্নছাড়া এই দলগুলোর দুরাবস্থা অবর্ণনীয়। নির্দিষ্ট কিছু নেতাকর্মীর মধ্যেই আবর্তিত হচ্ছে এদের কার্যক্রম। নির্দিষ্ট গ-ির বাইরে এদের কোনো বিচরণ নেই। একসময় জাতীয় রাজনীতিতে ইসলামী দলগুলো ফ্যাক্টর হলেও এখন আর তা নেই। জাতীয় পর্যায়ের ব্যক্তিত্ববান কোনো নেতার অস্তিত্ব চোখে পড়ে না এই দলগুলোতে। একটি দল ভেঙে দুই-তিন টুকরোও হয়েছে। ব্রাকেটবন্দী নেতারা হাতেগোনা নেতাকর্মীদের বেষ্টনীতে থেকেই ইসলামী বিপ্লবের দিবাস্বপ্ন দেখছেন। তাদের নেই কোনো গোছালো পরিকল্পনা। এই অভিযাত্রার গন্তব্য কোথায় সেটাও জানেন না তারা। নানা বৈষয়িক স্বার্থে রাজনীতি করছেন বেশির ভাগ ইসলামী দলের নেতারা। বিভাজিত ইসলামী শক্তিকে পাত্তা দিচ্ছে না এদেশের প্রধান দলগুলো। ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো ইসলামী দলগুলো এদিক-ওদিক যাচ্ছে, জোট-মহাজোটে শরিক হচ্ছে; কিন্তু তিলে তিলে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে তাদের অস্তিত্ব। এভাবে চলতে থাকলে এদেশের ঐতিহ্যবাহী ইসলামী দলগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।
ইসলামী দলগুলোর বড় সমস্যা হলো তাদের নেই কোনো পরিকল্পনা। তারা কী করতে চান, কোন পথ ধরে এগুতে চান, আর এর জন্য কী করতে হবে এর সুনির্দিষ্ট কোনো ছক নেই ইসলামী দলগুলোর। গতানুগতিক ধারায় চলছে দল ও রাজনীতি। দলগুলোর গঠনতন্ত্র থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা অনুসরণ করা হয় না। কারণ হয়ত এক ব্যক্তি, পরিবার বা বলয়েই চলছে দল। এখানে তাদের কথাই মুখ্য; গঠনতন্ত্র তার জায়গায় থাকবে। ব্যক্তি ও পরিবার পূজা ইসলামী দলগুলোর বিকাশের পথে বড় বাধা। উপমহাদেশে পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির ঐতিহ্য থাকলেও ইসলামী দলগুলোর ক্ষেত্রে তা সুফল বয়ে আনেনি। হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর সময় থেকে শুরু করে পারিবারিক রাজনীতির কারণেই ইসলামী দলগুলো বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কোনো পরিবার যোগ্য হলে নেতৃত্বে তাদের অংশীদারিত্ব বেশি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিপত্তি বাধে তখনই যখন অযোগ্য, অথর্ব লোকদের বসিয়ে দেয়া হয় নেতৃত্বের আসনে। অমুক হযরতের সন্তান হওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো যোগ্যতা নেই। অথচ এই দলে অনেক যোগ্য লোক আছেন, যারা তিলে তিলে দলকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। কিন্তু তাদের অযোগ্যতা হলো তারা কোনো হযরতের সন্তান নন। অযোগ্য ও অথর্ব পারিবারিক বলয় থেকে মুক্ত হতে না পারলে ইসলামী রাজনীতির বিকাশ সম্ভব নয়।
ইসলামী রাজনীতি এখনও পরিচালিত হয় মসজিদ-মাদরাসাকেন্দ্রিক। বেশির ভাগ দলেরই মূল জনশক্তি কোনো না কোনো মাদরাসা। সারা দেশ থেকে নানা মত ও পথের মানুষের সন্তানেরা রাজধানীর মাদরাসাগুলোতে পড়তে আসে। কিন্তু ওই মাদরাসাটি কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের বলয়ে হলে ওই ছাত্রটিকেও বাধ্যতামূলক এই দলটির কর্মী হয়ে যেতে হয়। কোনো ইস্যুতে মিটিং-মিছিলের প্রয়োজন হলে তাকে নামতে হয় রাজপথে। ওই দলটির মূল জনশক্তি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। তারা কেউ বুঝে আবার কেউ বাধ্যতামূলকভাবে দলীয় কর্মী হয়ে মাদরাসা পরিচালক বা কর্তৃপক্ষের রাজনীতির হাতিয়ার হন। এর বাইরে জনসাধারণের মধ্যে ইসলামী দলগুলোর নেই তেমন কোনো প্রভাব। কেউ কেউ পীর হিসেবে মুরিদদেরও দলীয় কর্মী মনে করেন। কিন্তু নির্বাচনের সময় ওই পীরের মুরিদেরাও ওই দলকে ভোট দেয় না। কারণ পীর সাহেব মুরিদদেরকে দলীয় কর্মী মনে করলেও মুরিদরা ভাবেন ভিন্ন। জীবনে নানা অন্যায়-অপকর্ম করার পর আত্মপোলব্ধি থেকে একজন পীর ধরে মুক্তির পথ খুঁজেন সাধারণ মানুষেরা। কিন্তু ইসলামী বিপ্লব, খেলাফত বা শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কোনো গরজ ওই মুরিদেরা উপলব্ধি করেন না। তারা মনে করেন, রাজনীতি মানে প্রচলিত রাজনীতি; ক্ষমতায় যাওয়ার প্রতিযোগিতা। আর পীর-মুরিদির বিষয়টি তো ভিন্ন।
সাধারণ মানুষদের সঙ্গে ইসলামী দলগুলোর তেমন কোনো যোগসূত্রতা নেই। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের ভাগীদারও হয় না ইসলামী দলগুলো। শুধু ধর্মীয় কোনো ইস্যু তৈরি হলেই ইসলামী দলগুলো সরব হয়। অন্যথায় তেমন কোনো কার্যক্রমই থাকে না এ দলগুলোর। সাধারণ মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক নানা সমস্যার ব্যাপারে মাথা ঘামান না ইসলামী দলের নেতারা। ইসলাম সম্পর্কে কেউ কটূক্তি করলে ইসলামী দলগুলো বক্তৃতা-বিবৃতিতে যেভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে সেটা দেখা যায় না তেল-গ্যাসসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানো হলে বা দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে কোনো কালো চুক্তি করলে। নাগরিক কোনো সমস্যা বা দেশবিরোধী কোনো চুক্তি হলে এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো কি ইসলামী দলগুলোর কার্যপরিধিতে পড়ে না? আলেম-ওলামা এবং মাদরাসা সংশ্লিষ্ট মানুষের সংখ্যা কত পার্সেন্ট? বড়জোর ১০ পার্সেন্ট হতে পারে। বাকি ৯০ পার্সেন্টের কথা চিন্তা করা কি ইসলামী রাজনীতির দায়িত্ব নয়? জনসাধারণের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার সঙ্গে নিজেদের একাত্ম না করতে পারলে ইসলামী দলগুলো এদেশের রাজনীতিতে কখনও সুবিধা করতে পারবে না। চলমান সংকট থেকে উত্তরণের জন্য তাদেরকে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। নিছক টুপি-দাড়িওয়ালা নেতাকর্মী নিয়ে দেশে ইসলামী বিপ্লব করার অলিক স্বপ্ন থেকে তাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে।
বর্তমানে সারা বিশ্বেই চলছে ইসলামফোবিয়া। পরিকল্পিতভাবে ইসলাম থেকে জনমনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমাদের বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এখানেও ইসলামের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করার পাঁয়তারা অব্যাহত আছে। এই মুহূর্তে ইসলামী ধারার রাজনীতি করতে হলে জনমনে ইসলাম সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের দেশের ইসলামী ধারার রাজনৈতিক দলগুলো তা করতে পারেনি। ইসলামে যে একটি রাষ্ট্রনীতি আছে সেটাই অজানা বেশির ভাগ মানুষের। কোনো ইসলামী দল ক্ষমতায় গেলে দেশের শাসনতন্ত্র কী হবে; নারীদের ব্যাপারে তাদের অবস্থান কী; অর্থনৈতিক রূপরেখা কেমন হবে; অমুসলিমদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করা হবে এর সুস্পষ্ট কোনো ধারণা ইসলামী দলগুলো জনগণকে দিতে পারেনি। যেকোনো সমস্যার সর্বোৎকৃষ্ট সমাধান যে ইসলামে রয়েছে সেটা সাধারণ মানুষকে জানাতে ব্যর্থ হয়েছে ইসলামী দলগুলো। এজন্য নির্বাচনগুলোতে ইসলামী দলের প্রার্থীরা ভালো করতে পারেন না। কিছু ব্যতিক্রম বাদে ইসলামী দলের হয়ে এককভাবে নির্বাচন করলে বেশির ভাগ প্রার্থী জামানত হারান। অথচ এদেশে ইসলামপ্রিয় মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। ইসলাম ও আলেম-ওলামাকে ভালোবাসেন বেশির ভাগ মানুষ।
সময় এসেছে ইসলামী রাজনীতি নিয়ে নতুন করে ভাবার। ইসলামী রাজনীতি করতে হলে সময় ও প্রেক্ষাপটকে সামনে নিয়ে নতুন কর্মকৌশল ঠিক করতে হবে। একসময় মহীরুহতুল্য ব্যক্তিত্ববান আলেমরা ইসলামী ধারার রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাদের ব্যক্তিত্বের কারণে অনেক কিছু সম্ভব হয়েছে। এখন আর সেই নেতৃত্ব নেই। এখন যারা ইসলামী রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের যোগ্যতা থাকলেও ব্যক্তিত্বের ভারত্ব আগের মতো নেই। তাই তাদের কাজ করতে হবে কৌশলে। লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার সঙ্গে সামনে এগুতে হবে। গতানুগতিক ধারায় চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে লক্ষ্যহীন এই রাজনীতি আরও নিষ্প্রভ, আরও বেশি অকার্যকর এমনকি অস্তিত্ব হারাবে।

Related posts

*

*

Top