আশা জাগানিয়া তারুণ্য, চাই সতর্ক পথচলা

zahirbabor22প্রত্যেক মানুষের ভেতরেই একটা শিল্পমন কাজ করে। মানুষ যদি ভেতরের শিল্পিত এ মনকে উপযুক্ত পরিচর্যা করে তবেই তা মোহ ও মাধুর্যের মাদকতায় অন্যকে আকৃষ্ট করে। সাহিত্য শিল্পেরই একটি যৌলুসপূর্ণ ধারা যা মানুষকে মোহিত করে অতি সহজে। শিল্প-সাহিত্যের এই অঙ্গনটি বরাবরই শক্তির আধার। একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বায়নের যুগে এ শক্তিতে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। বর্তমান বিশ্বে এ কথা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, লাখ লাখ সৈন্য যা না করতে পারে তা দু’চারটি প্রচার মিডিয়া ও পত্র-পত্রিকা দ্বারা করা সম্ভব। বর্তমান বিশ্বকে পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে মিডিয়া। মিডিয়ার অফুরন্ত শক্তির দ্বারাই বিশ্ব তাগুতি শক্তি প্রতিনিয়ত মানুষের বোধ, বিশ্বাস ও শাশ্বত মূল্যবোধে আঘাত হানছে। শৈল্পিক মিশেলের কারণে তাদের সেই আঘাত অধিক ক্রিয়াশীল।
আমাদের বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের দিকে তাকালে নষ্ট ধারার প্রাধান্যই নজরে ভাসবে। বোধ ও বিশ্বাসে যারা আবিলতা লালন করে তারাই এখানে আধিপত্য বিস্তার করে আসছে। কারণ বিশ্বাস ও মূল্যবোধের কাছে যারা দায়বদ্ধত তারা নিজস্ব কোনো বলয় ও প্লাটফর্ম গড়ে তুলতে পারেননি। ফলে যারা আদর্শকে লালন করতে চায়, বিশ্বাস ও মূল্যবোধ যাদের প্রত্যাশিত তারা প্রতিনিয়ত নিজেদের বিবেক ও চেতনার কাছে পরাজিত হচ্ছেন। সার্বিকভাবে ক্ষতি হচ্ছে আদর্শিক ধারার, সুস্থ ও শালীন প্রবাহের।
দুই.
সম্প্রতি মাদরাসাপড়ুয়া তরুণদের একটি বড় অংশ শিল্প-সাহিত্যের পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রয়াস চালাচ্ছে। লক্ষ্য করেছি, স্বপ্নালো এই তারুণ্যের মধ্যে প্রত্যয় আছে, আছে অসম্ভবকে সম্ভব করার ইস্পাতদৃঢ় মনোবল। তারুণ্যের গণ্ডি পেরিয়ে আসা শ্রেণীটি যা কল্পনা করারও সাহস পেতো না, আজকের তারুণ্য তা বাস্তবে করে দেখাচ্ছে। শিল্প ও সাহিত্যের বিচিত্র ভুবনে আজকের মাদরাসাপড়ৃয়া তরুণদের যে উপস্থিতি তা সত্যিই আশাব্যঞ্জক। অতীতের সব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে তারা সময়ের পথ ধরে সামনে এগুচ্ছে। উল্টো স্রোতে নাও বেয়ে চলা চাট্টিখানি কথা নয়। তারুণ্যসুলভ সাহস, প্রত্যয় ও অজেয় স্পৃহা না থাকলে এটা কখনও সম্ভব হয়ে উঠে না। আশার কথা হলো, মাদরাসাপড়ুয়া প্রিয় তরুণদের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত একটা উত্তরণ ঘটেছে। শিল্প-সাহিত্যের ভুবনে তাদের প্রত্যয়দীপ্ত পথচলা দেখলেই তা অনুমান করা যায়।
আমাদের সমাজের সামগ্রিক চিত্রটা সামনে আনলে তরুণদের অবস্থা খুব ভালো বলা যাবে না। নানা উপসর্গ আজকের তারুণ্যকে প্রায় জর্জরিত করে ছেড়েছে। হতাশা ও বিচ্যুতি আজকের তরুণদের ব্যাপকহারে আক্রান্ত করছে। স্বপ্ন পোষার ও লালন করার হিম্মত তরুণরা হারিয়ে ফেলেছে অনেক আগেই। এ অবস্থায় অপেক্ষাকৃত সুশীল, সুনিয়ন্ত্রিত ও সম্ভাবনাময় তারুণ্য যারা মাদরাসায় পড়াশোনা করছে কিংবা অন্য কোনো প্রভাবে সুস্থ ধারায় টিকে আছে-তারা অবশ্যই প্রশংসা ও সহযোগিতা পাওয়ার যোগ্য। প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তারুণ্যের এ শ্রেণীটি অনেক কিছু করে দেখাতে পারবে বলে আমাদের বিশ্বাস। পরিপার্শ্বের সরাসরি ও সূক্ষ্ম প্রভাবে তরুণরা বেশি প্রভাবিত হয়। ঊর্বর এই জমিনে দানাদার বীজ রোপন করতে পারলে বাম্পার ফলনের আশা করা যায়। আবার পরিচর্যা ও দেখভালের অভাবে আগাছাও সেভাবেই সম্ভাবনার জমিনে ঝঞ্ঝাট হয়ে আবির্ভূত হয়।
মাদরাসাপড়ুয়াদের বিচরণের গণ্ডিটা আজ আর আগের মতো সঙ্কীর্ণ নয়। তাদের সামনে এমন অনেক ক্ষেত্র উন্মুক্ত হয়ে গেছে যেখানে এক সময় তাদের প্রবেশাধিকার ছিল না বললেই চলে। বিশেষত শিল্প-সাহিত্যের সুরভিত প্রাঙ্গণে আজকাল তাদের বিচরণ চোখে পড়ার মতো। মোটামুটি সব তরুণের মধ্যেই এ ক্ষেত্রটির প্রতি একটা দুর্বলতা আছে। সম্ভাবনাময় এ ক্ষেত্রটিতে নিজেদের যোগ্য করে গড়ে তোলার একটি জোরালো প্রয়াসও নির্বাচিতদের মধ্যে কার্যকর। তাদের বড় অংশটি শিল্প-সাহিত্যে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান কামনা করে। কিন্তু সে অঙ্গনে যোগ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কিংবা বিচরণ করার কার্যকরী কোনো প্রচেষ্টা বেশির ভাগ তরুণের মধ্যে দেখা যায় না। প্রাথমিক পর্যায়ের সাধনা দ্বারাই তারা প্রাপ্তির সর্বোচ্চটুকু পেতে চায়। কাজের চেয়ে ফলের, সাধনার চেয়ে প্রাপ্তির আশাটা বড় হওয়ার কারণে যথার্থ যোগ্য ও সম্ভাবনাময় তরুণ তাদের থেকে খুব একটা উঠে আসছে না।
writingতারুণ্যের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস ও আবেগকে সাধুবাদ জানাই। তবে তাদের মনে রাখতে হবে, এ অঙ্গনে টিকে থাকার প্রধান শর্ত হলো যোগ্যতা। অযোগ্য ও অথর্বরা আবেগ ও উচ্ছ্বাসের যত পরাকাষ্ঠাই প্রদর্শন করুক একদিন তারা ছিটকে পড়বে এ অঙ্গন থেকে। বিশেষত কোনো শিল্পাঙ্গনেই আবেগতাড়িত নামধারী শিল্পীর স্থান হয় না। শিল্পী তার শিল্পের কুশলতায় টিকে থাকবে শিল্পাঙ্গনে। উদ্বেগের বিষয় হলো, আমাদের ইসলামী ধারার শিল্পাঙ্গনে ধান্ধাবাজ, অযোগ্য ও অন্তঃসারশূন্য নামধারী কিছু শিল্পীর আবির্ভাব ঘটেছে। শিল্পকর্মের প্রতি নিবিষ্টতার চেয়ে শিল্পী হিসেবে খ্যাতি অর্জনই তাদের প্রধান টার্গেট। তবে আশার কথা হলো, বসন্তের এই কোকিলেরা শিল্পাঙ্গন থেকে ছিটকে পড়ে একদিন বিস্মৃতির আঁধারে তলিয়ে যাবে। সুতরাং প্রকৃত শিল্পীরা তাদের নিয়ে ভাববার তেমন কিছু নেই।
শিল্প ও সাহিত্য এমন একটা ক্ষেত্র যেখানে বাস্তবতা বড় নির্মম হয়ে সামনে আসে। যোগ্যতা ও সাধনা ছাড়া নিছক ফাঁপা ও ফাঁকা বুলির জোরে দাপিয়ে চলার সুযোগ এখানে নেই। যোগ্যতাহীন অসাড় ব্যক্তিরা এখানে টিকে থাকার কোনো অধিকার রাখে না। আমাদের চোখের সামনে অযোগ্য, অথর্ব ও অসাড়দের করুণ পরিণতি বরণ এবং বিস্মৃত হয়ে যাওয়া সে কথা বারবার প্রমাণ করেছে। এই বাস্তবতাটি যে তরুণ নিজের জীবনের জন্য যথার্থভাবে অবলম্বন করেছে তারাই এ অঙ্গনে নিজেদের মর্যাদাপূর্ণ একটা অবস্থানে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। এজন্য তরুণদের উচিত শর্টকাট ও চোরাগলির ঝুঁকিপূর্ণ কোনো পথ অবলম্বন না করে শিল্প-সাহিত্যের নিয়মতান্ত্রিক স্বীকৃত পথ ধরে সামনে এগিয়ে চলা। এ পথটুকু দীর্ঘ ও বন্ধুর হলেও নিরাপদ ও কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছার জন্য অত্যন্ত সহায়ক।
তারুণ্য যত পরিণতই হোক গাইড ছাড়া তার বিচ্যুতি অবশ্যম্ভাবী। নিয়ন্ত্রণহীনতার বাইরে ভাবার বয়স তারুণ্য নয়। নির্ভরশীলতা ও মুখাপেক্ষিতা তারুণ্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সে যত দক্ষই হোক নিজের পথ নিজে নির্ণয় করতে সক্ষম নয়। অক্ষমতার এ বোধটুকু সব তরুণের মধ্যে কার্যকর থাকতে হবে। এ বোধ থেকেই তাকে নিজের পথপ্রদর্শনের জন্য একজন দিশারী নির্বাচন করতে হবে। সঠিক দিশা না পেলে এ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে তাকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের শিকার হওয়াটা স্বাভাবিক। অতীত অভিজ্ঞতা আমাদেরকে বারবার এ সত্যতার প্রমাণ দিয়ে গেছে। তরুণরা যোগ্য ও দক্ষ হতে পারে, কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা ও দূরদৃষ্টি তাদের ততটা পাকাপোক্ত নয়-এটা মানতেই হবে। এজন্য যারা অভিজ্ঞতার পোড় খেয়ে একটি পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন তাদের পথনির্দেশনা দরকার।

Related posts

*

*

Top