অনলাইন পত্রিকার জবাবদিহিতা চাই, তবে…

zahirbabor.comঅনেক দিন ধরেই অনলাইন পত্রিকাগুলোর একটি নীতিমালা তৈরির কথা শোনা যাচ্ছে। মোটাদাগে প্রায় সবাই এই নীতিমালার পক্ষে। নীতিমালায় কী থাকতে পারে এ বিষয়ে অনেক আলোচনা-পর্যালোচনাও ইতোমধ্যে হয়েছে। সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় অনলাইন পত্রিকাগুলোর সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকও করেছে; যদিও এই বৈঠক নিয়ে আছে নানা কথা। ভুঁইফোঁড় অনলাইনের সম্পাদকেরাই ওই বৈঠকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। শীর্ষ অনলাইনের বেশির ভাগ সম্পাদক ছিলেন না সেই বৈঠকে। সবশেষ গত ৯ নভেম্বর সরকার হুট করে এক তথ্য বিবরণীতে জানিয়েছে, ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে অনলাইন পত্রিকাগুলো নিবন্ধনের আবেদন করতে হবে। তথ্যবিবরণীতে বলা হয়, দেশের অনলাইন পত্রিকার প্রকাশকদের পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা এবং অপসাংবাদিকতা রোধ করার লক্ষ্যে সরকার অনলাইন পত্রিকা নিবন্ধন কার্যক্রম চালু করেছে। এ লক্ষ্যে নির্ধারিত নিবন্ধন ফরম ও একটি প্রত্যয়নপত্র বা হলফনামা পূরণ করে তথ্য অধিদপ্তরে জমা দিতে হবে। বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকার দাখিল করা তথ্য যাচাই করে তথ্য অধিদপ্তর নিবন্ধন দেবে।

অনলাইন সংবাদমাধ্যমের নামে এখন একটি নৈরাজ্য চলছে-এটা কারও অস্বীকার করার উপায় নেই। ব্যাঙের ছাতার চেয়েও দ্রুতগতিতে এখন অনলাইন পত্রিকা জন্ম নিচ্ছে। সাংবাদিকতার ‘স’ জানেন না এমন ব্যক্তিও এখন দিব্যি অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক হয়ে যাচ্ছেন। এক দেড় হাজার টাকা খরচ করে একটি ডোমেইন কিনে; কোনো রকম একটি সাইট তৈরি করে দেদারছে অন্যের নিউজ কপি-পেস্ট চলছে। অফিস, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং জনবল কোনোটাই নেই; দুই চারজন বসে বসে নিজের পিসিতে কপি-পেস্ট করে করে পত্রিকা চালাচ্ছে। এগুলো যারা করছেন তাদের বেশির ভাগেরই নেই সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্র সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা। অন্য কোনো চাকরি নেই, হাতে প্রচুর সময় আছে অথবা টাকা আছে এক দুইজন লোক বসিয়ে তথাকথিত অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক হয়ে যাচ্ছেন অনেকেই। এই সময়ে অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক হওয়া যেন সবচেয়ে সহজ কাজ।

ভুঁইফোঁড় অনলাইন পত্রিকাগুলো সাংবাদিকতার বারোটা বাজিয়ে ছাড়ছে। তাদের মধ্যে পেশাদারিত্বের ছিঁটেফোঁটাও নেই। নিজস্ব নিউজের কোনো উৎস নেই; পুরোটাই চলে অন্যের নিউজ কপি-পেস্ট করে। সাধারণ নিউজ তো কপি করেই; কোনো পত্রিকা বা পেশাদার অনলাইন একটি স্পেশাল নিউজ আপলোড করলেও কপি-পেস্টারদের কুনজর পড়ে এর ওপর। অন্যের ঘাম ঝরানো একটি নিউজ দুই মিনিটে কপি-পেস্ট করে নিজের নামে চালিয়ে দিতে তাদের একটুও বিবেকে বাঁধে না। এছাড়া এসব পত্রিকার মূল উপাদান হলো গুজব আর যৌন সুড়সুড়ি। তথাকথিত অনলাইন পত্রিকার নামে ‘আলতু-ফালতু’ ডটকমগুলো মনগড়া সব গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এক শ্রেণির অপরিণামদর্শী; হুজুগে এবং নিম্ন রুচির মানুষ অখ্যাত-অনির্ভরযোগ্য এসব সাইটের নিউজ অহরহ শেয়ার করে যাচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে যেকোনো গুজব ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এছাড়া যৌন সুড়সুড়িমূলক সংবাদ অন্ধকারের চোরাবালিতে নিয়ে যাচ্ছে তরুণ প্রজন্মকে।

অনলাইন নীতিমালা এখন সময়ের দাবি। প্রিন্ট পত্রিকার ডিক্লারেশন এবং নামের ছাড়পত্র নিতে হয়। তাহলে অনলাইন পত্রিকা কেন লাগামহীনভাবে প্রকাশের ব্যবস্থা থাকবে? অবশ্যই অনলাইনের কিছু নীতিমালা থাকা দরকার। এটা সবাই স্বীকার করবে। একটি সুষ্ঠু নীতিমালা হলে ভুঁইফোঁড় অনলাইনগুলোর দৌরাত্ম কমবে। এতে লাভবান হবে দেশের মূলধারার সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা। পেশাদার অনলাইন আরও হতে পারে; কিন্তু ভুঁইফোঁড় অনলাইন পত্রিকা আর একটিরও দরকার নেই। এ ব্যাপারে এখনই উদ্যোগ নেয়া জরুরি।

তবে, অনলাইন নীতিমালা এবং অনলাইন পত্রিকাগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার নামে ভিন্নমতের সংবাপত্রের কণ্ঠ রোধ করার চেষ্টা কখনও সমর্থনযোগ্য নয়। সরকার যদি অনলাইন নীতিমালার নামে ভিন্ন মতাদর্শী এবং বিরোধী পক্ষের মিডিয়াকে দমনের পাঁয়তারা করে সেটা কেউ মেনে নেবে না। হুট করে অনলাইন পত্রিকাগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসা; সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার লোকদের রিপোর্টের ভিত্তিতে পত্রিকাগুলোকে নিবন্ধন দেয়ার চেষ্টা জনমনে কিছুটা সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। এ ব্যাপারে সরকারকে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে অনলাইনের নামে অপসাংবাদিকতার যে চর্চা হচ্ছে সেটা রোধ করা উদ্দেশ্য হলে এর জন্য সরকারি উদ্যোগ প্রশংসনীয়; কিন্তু উদ্দেশ্য ভিন্ন হলে এটা হবে দেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে আরেকটি কালো অধ্যায়।

*

*

Top