অসহিঞ্চু ফেসবুক প্রজন্ম

Zahirbabor.com 1সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক যেন দিন দিন আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠছে। একটু পরপর ফেসবুকে ঢু না মারলে আমাদের অনেকের পেটের ভাত হজম হয় না। নাগরিক জীবনে আমাদের মধ্যে অসামাজিকতা ছেয়ে যাচ্ছে দিন দিন। পশ্চিমা কালচারে অভ্যস্থ হয়ে যাওয়ায় আমাদের সামাজিক বন্ধনগুলোও এখন অনেকটাই নড়বড়ে। আর এই নড়বড়ে সামাজিক বন্ধনকে জোড়া লাগানোর জন্যই মূলত জুকারবার্গ আবিষ্কার করেন ফেসবুক। একই শহরে বাস করেও মাসের পর মাস চলে যায় একজনের সঙ্গে অন্যজনের সাক্ষাৎ নেই। ফেসবুক অন্তত প্রতিটি মুহূর্ত হাই-হ্যালোর সুযোগটুকু করে দিয়েছে। আমাদের দেশে মোবাইল ইন্টারনেট সহজলভ্য হয়ে যাওয়ায় ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে হু হু করে। বাংলাদেশে বর্তমানে এক কোটির বেশি ফেসবুক ব্যবহারকারী আছেন। তাদের বেশির ভাগই বয়সে তরুণ। বর্তমান সময়ের ¯স্লোগান হলো- ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট না থাকলেও অন্তত ফেসবুকে একটি অ্যাকাউন্ট অবশ্যই থাকা চাই। এই সময়ে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট নেই এমন মানুষকে চরম সেকেলে হিসেবে গণ্য করা হয়।

নিঃসন্দেহে ফেসবুক আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোৎকৃষ্ট আবিষ্কার। বিজ্ঞানের আবিষ্কার ভালো না মন্দ সেটা নির্ভর করে এর ব্যবহারের ওপর। ফেসবুকের ভালো অনেক দিক আছে। তবে মন্দ দিকগুলো দিন দিন এতটাই প্রকট হয়ে উঠছে যে ফেসবুকের ভালো দিকগুলো ম্রিয়মান হয়ে যাচ্ছে। ফেসবুককে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বললেও দিন দিন তা অসামাজিক হয়ে উঠছে। ফলে ফেসবুক দ্বারা লাভের চেয়ে ক্ষতির পাল্লাটাই ভারী হচ্ছে। সম্প্রতি পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাংলাদেশে ফেসবুক-টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বন্ধের পক্ষে মত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, চীনে ফেসবুক-টুইটার নেই, এজন্য তারা উন্নতি করেছে। আমাদের দেশেও ফেসবুক-টুইটার বন্ধ করে দিলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে। অতি আবেগী ফেসবুকাররা পরিকল্পনামন্ত্রীর এই যুক্তিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেও অনেকটাই বাস্তব। এখন না হলেও আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ফেসবুকের ক্ষতিকর দিকগুলো আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে যাবে।

মোটাদাগে বললে ফেসবুক হলো মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের একটা মাধ্যম। সুখ-দুঃখ, আনন্দ, ভালোলাগা, ভালোবাসা, নিত্যনতুন খবরাখবর লেনদেনের একটা ঊর্বর প্লট। কিন্তু যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের ব্যাপারে একটি প্রশ্ন জোরালো হয়ে উঠছে-এই ফেসবুক নতুন প্রজন্মকে কোথায় নিয়ে যাবে? আর প্রশ্ন উঠবেই বা না কেন? ছেলেটির পড়াশোনার মন নেই, কারণ সে ফেসবুকে পড়ে থাকে। ফেসবুকে মেয়েটির আপত্তিকর ছবি বা ভিডিও প্রকাশ। অবশেষে অপমানে লজ্জায় মেয়েটির আত্মহত্যা। কেবল এ ধরনের সংবাদই নয়। দেশের নেতা-নেত্রীদের হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে ফেসবুকে। ধর্মীয় শীর্ষ ব্যক্তিদের নামে আপত্তিকর ছবি প্রকাশ করে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে। নানা গুজব ও উস্কানির মাধ্যমে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির ক্ষেত্রেও ফেসবুক প্রভাব ফেলছে।

ফেসবুকের মাধ্যমে প্রকট আকার ধারণ করছে পরিবারতন্ত্রের বিলুপ্তি এবং পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। স্বামী-স্ত্রী পারস্পরিক বিশ্বাসের জায়গাটিতেও আঘাত করছে ফেসবুকের ব্যবহার। এর ফলে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের প্রতি সন্দেহবাতিক হয়ে উঠছে। গবেষণা সংস্থা ‘আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব পেডিয়াট্রিকস’-এর তথ্য বলছে, ফেসবুক এবং অন্যান্য সোশাল নেটওয়ার্কে অধিক সময় কাটানো তরুণদের জন্য স্থায়ী হতাশা বা মানসিক রোগের কারণ হতে পারে। ফেসবুক কেন মানুষের মধ্যে বিষণ্নতা তৈরি করছে সে বিষয়ে গবেষণা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাহ ভ্যালি ইউনিভার্সিটির গবেষকরা। তারা দেখেছেন, সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটে বেশি সময় পার করা মানেই মনের বিষণ্নতা বেড়ে যাওয়া। গবেষণার ফল বলছে, জীবন নিয়ে বেশিরভাগ ফেসবুক ব্যবহারকারীই হতাশ। অধিকাংশের ধারণা, তাদের চেয়ে বন্ধুরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছেন। এ কারণে হীনম্মন্যতায় ভোগেন তারা।

দুই.

Zahirbabor.com 2বিশাল বিস্তৃত অনিয়ন্ত্রিত একটি মাধ্যম ফেসবুক। এখানে কেউ কাউকে নিয়ন্ত্রণ করার নেই। যার যা খুশি তাই লিখছেন, শেয়ার করছেন। আর এই অবাধ স্বাধীনতা ফেসবুক ব্যবহারকারীদের স্বেচ্ছাচারিতার দিকে ধাবিত করছে। নেতিবাচক কিছু লিখলেই সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। লাইক-কমেন্টের বন্যা বইয়ে যাচ্ছে। আপনি কোনো নীতিকথা, পজেটিভ কোনো আলোচনা করলে এতে তেমন সাড়া পাবেন না। এজন্য ফেসবুকারদের মধ্যে নেতিবাচক বিষয় শেয়ার করার প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যায়।

দৈনন্দিন জীবনে মানুষ নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মুখোমুখি হন। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার নানা উপলক্ষ আসে। আগের দিনে তা বন্ধু-বান্ধব ও আপনজনের সঙ্গে শেয়ার করে মন পাতলা করতেন। তবে তা চাইলেই পারতেন না; সময়-সুযোগের দরকার হতো। কিন্তু এখন আর কোনো বিষয় শেয়ার করার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। প্রতি মুহূর্তেই ‘ফিলিং অমুক’, ‘ফিলিং তমুক’ দেদারছে ফেসবুকে শেয়ার চলছে। বুঝে-না বুঝে ভক্ত-অনুরাগী এবং অদেখা বন্ধুরা তাতে লাইক-কমেন্ট করে যাচ্ছেন। তথাকথিত ফেসবুক সেলিব্রেটি হলে তো কথাই নেই। তার ফিলিংকে ঘিরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ফালতু প্যাচালে মেতে উঠে ফেসবুক মাতালরা। অনেকে ফিলিং প্রকাশ করতে গিয়ে কাণ্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয়ও দেন। হয়ত তার কোনো আপনজন মারা গেছেন, সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফেসবুকে বিষয়টি শেয়ার করে দিলেন। আবার বিভিন্নজনের কমেন্টের উত্তরও দিয়ে যাচ্ছেন। নিকটাত্মীয় কাউকে দাফন করতে নিয়ে যাচ্ছেন সেটাও ফেসবুকে শেয়ার। দাফন সম্পন্ন সেটাও ফেসবুকে বলে দিচ্ছেন। এগুলো কোনো সুস্থ ম¯স্তিষ্কের মানুষের কাজ হতে পারে না। এভাবে ফেসবুক মানুষের সহজাত আবেগ-অনুভূতিগুলোও ভোঁতা করে দিচ্ছে। আপনজন মারা যাওয়া শোকে যেখানে কাতর হওয়ার কথা সেখানে অনেকেই ফেসবুকীয় মশকরায় লিপ্ত হন।

ফেসবুকের তরুণ প্রজন্মকে অসহিঞ্চু ও হতাশাগ্রস্ত করে তুলছে। কোনো ক্ষোভ, খেদ আর বঞ্চনার কথা এখনকার তরুণরা মনের ভেতরে পোষণ করে রাখতে পারে না। এসব ঝেড়ে ফেলার উপযুক্ত জায়গা মনে করে ফেসবুককে। কারও সঙ্গে দেখা হলো, তিনি হাসিমুখে কথা বললেন না; সুতরাং ফেসবুক স্ট্যাটাসে তাকে ইচ্ছেমতো ঝারলাম। কেউ কোনো বিষয়ে ঠকালো, আর দেরি নেই ফেসবুকে তার চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে ছাড়বো। কারও সঙ্গে কোনো বিষয়ে মতানৈক্য সৃষ্টি হলো, তাকে ঘায়েল করার জন্য আছে ফেসবুক। প্রতিপক্ষ কেউ কোনো দোষ করলো, বাস্তবে কিছু পারি আর না পারি ফেসবুকে তার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে দিলাম। কাউকে আমার পছন্দ না, সুযোগ পাইলে ফেসবুকে তাকে বাঁশ দিয়ে দিলাম। এভাবে ফেসবুকে চলছে চরিত্র হননের অবাধ প্রতিযোগিতা।

নানা বয়সের, বিভিন্ন স্তরের মানুষেরা ফেসবুকে আছেন। বাস্তবে যার ধারেকাছেও যাওয়া সম্ভব নয় ফেসবুকে তিনিও বন্ধু। তাই বলে সবাইকে বন্ধুত্বের একপাল্লায় মাপা কোনো বুদ্ধিমত্তার কাজ নয়। আপনার ফ্রেন্ডলিস্টে আপনার শিক্ষক বা সমপর্যায়ের মানুষেরাও আছেন; আবার আছেন ক্লোজ বন্ধুরাও। উভয়ের সঙ্গে তো একই আচরণ হতে পারে না। ফেসবুকে কিছু লেখা বা শেয়ার করার আগে একবার ভাবুন তো, আমি যা লিখছি তা উভয় ধরনের বন্ধুদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা। আমার বক্তব্য ইচড়েপাকামি হয়ে যাচ্ছে না তো! আমার কথাগুলো উদ্ধত্যপূর্ণ ও বেয়াদবির সীমারেখা অতিক্রম করছে কি! ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাচ্ছে না তো! ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে আমি বাচাল হিসেবে পরিচিত হচ্ছি না তো! ফেসবুক স্ট্যাটাসগুলো আমার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হচ্ছে তো! মনে রাখবেন, ফেসবুক হলো একটি খোলা প্রান্তর, এখানে আপনি লাইক-কমেন্ট যাই করুন এটা আপনার বন্ধু, এমনকি বন্ধুর বন্ধুদের কাছেও চলে যাচ্ছে। এজন্য প্রতিটি পদক্ষেপ গুনেবেছে হিসাব করে দেওয়া উচিত। সে কাজটা কি আমরা করছি!

নিজেদের আভ্যন্তরীণ ছোটখাটো বিভেদগুলো উস্কে দেওয়ার সবচেয়ে কার্যকরী মাধ্যম ফেসবুক। জীবন-সংসারে বিভেদ ও মতানৈক্য থাকবেই। একই পরিবারের একাধিক সদস্যের মধ্যে বিভেদ-ঝগড়া থাকে; সহোদর ভাই-বোনদের মধ্যেও ঝগড়াঝাটি হয়, সুতরাং সমাজে চলতে নানা মত-পথের লোকদের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়াটাই স্বাভাবিক। জগৎ-সংসারে সমস্যা যেমন আছে, তেমনি আছে এর সমাধানও। সেটা যুগ যুগ ধরে যেভাবে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে হয়ে আসছে এখনও তেমনটাই হওয়ার কথা। ফেসবুকের মতো একটি অবারিত ও অনিয়ন্ত্রিত জায়গা কেন হবে এসব ঝগড়া ও মতপার্থক্যের চর্চাকেন্দ্র? আপনাকে জীবনে দেখেনি, আপনার সঙ্গে যার কোনো জানাশোনা নেই, আপনার গণ্ডি সম্পর্কেও হয়ত তিনি কোনো ধারণা রাখেন না, সেই লোকও তো ফেসবুকে আপনার বন্ধু। আপনি আপনার দুর্বলতাগুলো সেই লোকটির কাছে প্রকাশ করে দিচ্ছেন কেন? এর দ্বারা আপনি নিজেই তো ছোট হয়ে যাচ্ছেন। নিজের অজান্তেই ফেসবুকের কারণে আপনার শত্রুসংখ্যা বাড়াচ্ছেন।

ফেসবুকে এই বিভেদ ও চরিত্র হনন চর্চা যে শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে হয় তাই নয়; দল ও গোষ্ঠী পর্যায়েও হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে লক্ষ্য করা যায় একটি হকপন্থি দলের কর্মীরা অন্য আরেকটি হকপন্থি দলকে ঘায়েল করার জন্য ফেসবুকে রীতিমতো জেহাদ ঘোষণা করে দেয়। কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কে এমন একজন বাজে কমেন্ট করে বসেন ওই ব্যক্তির তুলনায় তার কোনো অবস্থানই নেই। আবার কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী নামধারী হুজুগেপনা ব্যক্তিরা নিজেদের নেতাকে উপরে তোলার জন্য বাড়াবাড়ির আশ্রয় নেন। নিজের নেতাকে বড় করার জন্য অন্য দলের নেতাকর্মীদের ব্যাপারে আজেবাজে কমেন্ট করেন। এর দ্বারা যে প্রকারান্তরে নিজের নেতাকেই ছোট করছেন সেটা কি এই অপরিণামদর্শী ফেসবুকাররা বুঝেন? কোনো কোনো ইসলামি দলের ফেসবুক ঝগড়া দেখলে মনে হয় তারা এখানে যে এনার্জিটুকু ব্যয় করছেন সেটা মাঠ পর্যায়ে ব্যয় করলে এ দেশে ইসলামি শাসন অনেক আগেই কায়েম হয়ে যেতো।

ফেসবুককে কেউ কেউ দাওয়াতের ঊর্বর ভূমি বলে মনে করেন। বাস্তবে সেটা সম্ভবও। কিন্তু বর্তমানে ফেসবুক কি আসলেই কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে? এই না পারার দায় ফেসবুকের নয়, এটা আমাদের। আমরা এটাকে ভালো কাজেও ব্যবহার করতে পারতাম; কিন্তু করছি অকাজে, অপাত্রে। ফেসবুকটাকে আমরা আজ সস্তা আবেগ প্রকাশের মাধ্যম বানিয়ে নিয়েছি। এখানে অহেতুক ও অদরকারি নানা বিতর্ক উস্কে দিচ্ছি, নানা নেতিবাচক বিষয় শেয়ার করছি। এতে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য আর ঝগড়া-ফ্যাসাদ হচ্ছে; কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ইতিবাচক বিষয়গুলো শেয়ার করে তেমন সাড়া না পাওয়ায় নেতিবাচক বিষয়গুলোই শেয়ার করছি। এতে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন হচ্ছে, কোনো সুফল আসছে না।

অকাজে সময় নষ্ট করার একটি বড় মাধ্যম হলো ফেসবুক। যারা নেশার মতো ফেসবুকে পড়ে থাকেন তারা অনেক সম্ভাবনাকে গলাটিপে হত্যা করে দিচ্ছেন। আপনি হয়ত তথাকথিত ফেসবুক সেলিব্রেটি, ফেসবুকে একটি বিতর্কিত বিষয় উস্কে দিলেন, এ ব্যাপারে কোনো স্ট্যাটাস দিলেন; সঙ্গে সঙ্গে কমেন্টের বন্যা বইতে থাকবে। এবার প্রতিটি কমেন্টের প্রতিউত্তর দেওয়ার জন্য আপনাকে ফেসবুকে কানেক্ট থাকতে হবে। এটা চলবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আর আপনাকে লাইক-কমেন্ট পেতে হলে অন্যের স্ট্যাটাসেও লাইক-কমেন্ট করতে হবে। এর জন্য আপনার ব্যয় হবে আরও দীর্ঘ সময়। এভাবে ফেসবুক মাদকতায় আপনার কেটে যাচ্ছে দিনের বেশির ভাগ সময়। অথচ আপনি সম্ভাবনাময় তরুণ; লেখালেখিতে আপনার হাত ভালো; সমাজ সংস্কারে আপনার কাজ করার সম্ভাবনা আছে; আপনি একজন ভালো ও যোগ্য ছাত্র বা শিক্ষক; পড়াশোনায় আপনাকে অনেক সময় কাটানো দরকার। ফেসবুকের নেশায় আমরা আজ এতটাই বুদ হয়ে আছি যে, পড়াশোনা ও গবেষণার মতো কোনো সময়ই হাতে নেই। নীরবে নিভৃতে পড়াশোনা, লেখালেখি, মানুষ ও সমাজ গড়ার কাজের সঙ্গে তথাকথিত ফেসবুক সেলিব্রেটিদের তৎপরতার কোনো তুলনা চলে? আপনি নিজেই নিজের বিচার করুন।

ফেসবুকের মাধ্যমে আমরা অনায়াসেই নিজের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো দিয়ে দিচ্ছি। দেশি-বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আগে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যে তথ্যগুলো সংগ্রহ করতো সেগুলো এখন আমরা দিব্যি ফেসবুকে তাদের হাতে তুলে দিচ্ছি। ভালো মনে করে আমরা অনেক বিষয় ফেসবুকে শেয়ার করছি, অনেক কর্মপরিকল্পনার কথা লিখছি, কিন্তু এটা যে আমাদের শত্রুপক্ষ অনায়াসে পেয়ে যাচ্ছে সে কথা কি ভাবছি? ফেসবুকের প্রধান আইন উপদেষ্টা আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র সাবেক আইনজীবী। ফেসবুকের সঙ্গে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সম্পর্ক গভীর। মুসলিম বিশ্বের অনেক তথ্য ফেসবুকের কল্যাণে সিআইএ নিয়ে যাচ্ছে। শুধু সিআইএ কেন, আমাদের দেশীয় গোয়েন্দারাও ফেসবুকে তৎপর। সম্প্রতি আইসিটি অ্যাক্ট নামে নতুন যে আইন প্রণয়ন হয়েছে তাতে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের আইনি ঝুঁকি আরও বেড়েছে। এজন্য ফেসবুকে যাচ্ছেতাই শেয়ার করার আগে একটু ভাবুন। গুজব, উস্কানিসহ নানা অভিযোগে যেকোনো সময় আপনি ফেঁসে যেতে পারেন।

ইন্টারনেট দুনিয়ার লাখ লাখ সাইটের মধ্যে ফেসবুক একটি। ফেসবুক সবচেয়ে জনপ্রিয় ওয়েবসাইট নিঃসন্দেহে, কিন্তু জ্ঞান-গবেষণা এবং কিছু শেখার জন্য এটি উপযোগী নয়। তথাকথিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এখন অসামাজিক বিষয়গুলোই বেশি চর্চিত হচ্ছে। জ্ঞান-গবেষণার জন্য লাখ লাখ সাইট আছে, চাইলে আপনি ইন্টারনেটের জ্ঞানসমুদ্রে বিচরণ করতে পারেন। অনলাইন আপনাকে নতুন কিছু শিখতে সহায়তা না করলে অফলাইনে থাকাই উত্তম। ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট নেই এমন অনেক বিদগ্ধজন আছেন যারা নীরবে-নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন। তথাকথিত ফেসবুক সেলিব্রেটিদের কাছে তারা সেকেলে হলেও তাদের কাজের মূল্যায়ন হবে যুগ-যুগান্তরে। আর আপনার ফেসবুকীয় সস্তা জনপ্রিয়তা ততদিনই থাকবে যতদিন এখানে সচল থাকবেন। ফেসবুকের সম্পর্ক হলো ‘গিভ অ্যান্ড টেক’-এর। আপনি কাউকে লাইক-কমেন্ট করলেই সে আপনাকে করবে। এসব লাইক-কমেন্ট যতই মিলুক, এগুলো ধুইয়ে তো আর পানি পান করা যাবে না। ফেসবুকে আপনি যত জনপ্রিয়ই হোন অফলাইনে গেলে আপনাকে কেউ মূল্যায়ন করবে না। কারণ ফেসবুকের ফাঁপা ও হাওয়ার ওপর জনপ্রিয়তা আর বাস্তব দুনিয়ায় বিচরণ এক নয়।

দিন দিন অপরিণামদর্শী, আবেগি ও হতাশাগ্রস্ত তরুণদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠছে ফেসবুক। এখানে গড়ার চেয়ে ভাঙনের সুর প্রকট। আশার চেয়ে হতাশার বাণী এখানে বর্ষিত হয় বেশি। এখানে দরকারি ও প্রয়োজনীয় বিষয় নয়, ফালতু ও সস্তা আবেগি বিষয়ের জয়জয়কার। ইচড়েপাকা, বেয়াদব ও ইতরপ্রকৃতির চরিত্রগুলো বাঙময় হয়ে উঠছে এখানে। এজন্য সম্ভাবনাময় ও কাজের লোকদের ফেসবুকের সংশ্রব যত কমানো যায় ততই মঙ্গল।

Related posts

*

*

Top