আকুল প্রাণের ব্যাকুল মিনতি

imag3446পৃথিবীর সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার সূচনাপর্ব থেকে প্রেম ও ভালোবাসার বন্ধন চলে আসছে। প্রেমের ছোঁয়া না পেলে সৃষ্টিরাজিতে প্রাণের স্পন্দন আসতো না। সহজাত, শাশ্বত ও চিরন্তন এই উঞ্চ ভালোবাসার কারণেই স্রষ্টা তার সৃষ্টিরাজিকে কুশলী শিল্পীর নিপুণ তুলিতে সুশোভিত ও সুষমামণ্ডিত করেছেন। প্রতিটি সৃষ্টির মাঝেই প্রেমের অনুরাগ ও মায়ার বন্ধন কার্যকর আছে। বিশেষত সৃষ্টির সেরা জীব মানবের মাঝে এর উপস্থিতিটা একটু মোটাদাগে ধরা পড়ে। তাই তো শাশ্বত সেই প্রেমের কাছে মানুষ কাতর, পরাভূত, সর্বোতভাবে সমর্পিত।

মানুষের দুর্দমনীয় এই প্রেমের উৎসটা কোথায়? অদৃশ্য সেই আকর্ষণটা কী যার জন্য মানুষ সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে সদা প্রস্তুত। রক্তের সম্পর্ক প্রেম ও ভালোবাসার একটি স্থুল কারণ মাত্র। একের প্রতি অন্যের অনুগ্রহ, সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব, সিফাত ও গুণাবলীই প্রেম ও ভালোবাসার মূল উৎস, মৌলিক কারণ। এ সবই মূলত একের প্রতি অপরকে আকৃষ্ট করে। সৃষ্টি করে তার হৃদয়ে ভালোবাসার জোয়ার, প্রেমের উঞ্চতা। প্রেম ও ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপন করার মতো মৌলিক গুণের শতভাগ উপস্থিতি কোনো মানুষের মধ্যে নেই। অপূর্ণতা ও সীমাবদ্ধতার দোষে যে দুষ্ট, তার মধ্যে এর আশা করাও অলিক। এই মৌলিক কারণগুলোর শতভাগ উপস্থিতি একমাত্র মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সত্তার মাঝে বিদ্যমান। কারণ তিনি সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে, সর্বময় ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব তাঁর আয়ত্তে। এজন্য প্রকৃত প্রেম নিবেদনের  উপযুক্ত পাত্র তিনিই। তাঁর প্রেমের সুধা থেকেই প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন সম্ভব।

hajj0x480মানুষ যখন আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সিফাত ও গুণাবলীর ইলম ও জ্ঞান অর্জন করে মারেফাত ও সত্যিকার পরিচয় লাভে ধন্য হয়, তখন তার প্রতি অন্তরে জন্ম নেয় এক অপার্থিব প্রেম ও অনুরাগ, মহব্বত ও ভালোবাসা। পার্থিব জগতের প্রেমাস্পদের বিরহ যাতনা মানুষকে যেমন অস্থির ও চঞ্চল করে তোলে, প্রেমাস্পদের মিলন-আকাঙ্ক্ষায় সে যেমন থাকে উন্মুখ, আল্লাহপ্রেমিক প্রতিটি মানুষের অবস্থাও হয়ে পড়ে তদ্রুপ। প্রেমিক চায় তার প্রেমাস্পদের সঙ্গে ভালোবাসার সরোবরে অবগাহন করতে, তাকে অতি আপন করে কাছে পেতে। প্রেমাস্পদকে পাবার জন্য প্রেমিক কোনো কষ্ট-যাতনার পরোয়া করে না। কোনো আরাম-আয়েশ, সুখ-স্বাচ্ছন্দের অভিলাসী হয় না।

তেমনি প্রকৃত খোদাপ্রেমিকরা চায় তার প্রেমাস্পদ আহকামুল হাকিমীনের একান্ত সান্নিধ্য, উঞ্চ ভালোবাসা। তাঁর দীদার ও দর্শন লাভের জন্য সে তখন হয়ে ওঠে আকুল, পাগলপারা। ইহকালের জীবন শেষ হওয়ার পর আখেরাতে তাঁর দীদার ও দর্শন তো অনিবার্য। কিন্তু প্রেমকাতর মানুষের পক্ষে এতদিনের অপেক্ষা করা কি সম্ভব? আর এই পার্থিব জগতে স্রষ্টার দীদার ও দর্শনও তো অসম্ভব। তবে প্রেমাতুর মানুষ কিভাবে নিবারণ করবে তার ইশক ও প্রেমের উত্তাপ, আত্মার অনন্ত এ পিপাসা? প্রেমাস্পদকে কাছে না পেলে প্রেমাস্পদের সঙ্গে সম্পর্কিত যেকোনো বস্তুই হতে পারে তার এ অনন্ত পীপাসা নিবারণের একান্ত অবলম্বন। কেননা প্রেমিক চোখে এমন প্রতিটি বস্তুই পবিত্র ও সুন্দর হয়ে ধরা দেয় যার ক্ষীণতম সম্পর্কও রয়েছে তার প্রেমাস্পদের সঙ্গে। লায়লার প্রেমে মাতোয়ারা মজনু লায়লার বিরহে কাতর হয়ে উদভ্রান্তের মতো ঘুরছিলেন পথে প্রান্তরে। লায়লার শুভ্র পায়রাটি তখন ডানা মেলে এসে বসল মজনুর পাশের দেয়ালে। মজনু তখন আনন্দে উদ্বেলিত ও ভাবাতুর হয়ে পায়রাকে উদ্দেশ্য করে বলছে, ‘হে পায়রা! তুমি গান গাও, তোমার গান আমার কাছে সুমিষ্ট লাগবে। কারণ তুমি তো এসেছ আমার প্রেমাস্পদের আঙ্গিনা থেকে, যেখানে গান করলে আমার প্রেমাস্পদ তোমার গান শুনে।’

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অন্তর্জামী। তিনি তাঁর প্রেমপিপাসু বান্দাদের আকুল প্রাণের ব্যাকুল মিনতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত। এজন্য প্রেমাতুর বান্দাদের জন্য কিছু স্থুল ও জড়বস্তু নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, যা কোনো না কোনো দিক থেকে সেই মহান সত্তার সঙ্গে সম্পর্কের পবিত্রতায় মহিমান্বিত, সেখানে সদা বর্ষিত হচ্ছে আল্লাহ পাকের করুণা ও রহমতের বারিধারা। বায়তুল্লাহ ও তার সঙ্গে সম্পর্কিত আল্লাহর নিদর্শনসমূহই সেই অবলম্বন, যার সংস্পর্শে এসে আল্লাহপ্রেমিকদের হৃদয়ের উত্তাপ কিছুটা প্রশমিত হতে পারে। প্রেম ও উচ্ছ্বাসের তৃপ্তির জন্যই হাজীরা প্রতি বছর ভিড় জমায় আল্লাহর ঘর বায়তুল্লাহ শরিফে। হজের নানাবিদ লক্ষ্য ও তাৎপর্য রয়েছে। তবে এটাই হলো হজের নিগূঢ় ও প্রধানতম তাৎপর্য। প্রেমিক ও প্রেমাস্পদের বিরহ যাতনা প্রশমনই এর সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য।

প্রতি বছর লাখো মুসলমান ছুটে যায় পবিত্র মক্কা নগরীতে মাশুকে হাকীকির নির্দশনসমূহের সান্নিধ্য পেতে, ইসলামের আহকাম পবিত্র হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে। হজের নানা আহকামে প্রেমিক ও প্রেমাস্পদের মধ্যকার অকৃত্রিম সম্পর্কের পরিচয় যেমন ফুটে উঠে তেমনি স্রষ্টার প্রতি সৃষ্টির নিঃশর্ত আনুগত্য প্রকাশ পায়। আল্লাহর ঘরের মেহমানরা যখন সেলাইবিহীন এক প্রস্ত শুভ্র কাপড়ে জড়িয়ে ইহরাম বাঁধেন তখন তা তাদেরকে নিত্যদিনের সাজসজ্জা ও চাকচিক্যের সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করে নিয়ে যায় প্রেম ও বিশ্বাসের নতুন জগতে। ইহরামের এই অনাড়ম্বর অথচ মহিমান্বিত আচ্ছাদন হাজীকে সচেতন করে তুলে সে এখন আহকামুল হাকীমীনের দরবারে হাজির। প্রেমাস্পদের মিলন আকাঙ্ক্ষায় উন্মুখ প্রেমিকের নিজ সাজসজ্জার প্রতি যতœবান হওয়ার সুযোগ কোথায়? সে মুহূর্তটা তো হলো আত্মবিস্মৃতির। উসকো-খুশকো চুল নিয়ে ধুলি ধূসরিত অবস্থায় সে হাজির হবে তার প্রেমাস্পদের দরবারেÑএটাই তো প্রেমের দাবি। হজে এ দাবি যথার্থভাবেই পূর্ণতা পায়।

হাজী তার অবয়ব ও আচরণেই শুধু নিজের আনুগত্যের প্রকাশ ঘটায় না, জবানের স্বীকৃতিও দিয়ে থাকেন। ইহরাম বাঁধার পর থেকে তার মুখে জারী হয়ে যায় একটি জিকিরÑলাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক…। ‘প্রভু হে বান্দা হাজির! সমস্ত প্রশংসা ও নেয়ামত তোমার। রাজত্ব ও ক্ষমতা তোমারই। তোমার কোনো শরিক নেই।’ প্রেমাস্পদ মহান রাব্বুল আলামিন ইবরাহিম আ.-এর জবানিতে তাঁর দরবারে আগমনের যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, এই তালবিয়া যেন সেই আহ্বানেরই স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দান, আল্লাহর সম্মুখে নিজেকে সমর্পণ ও আত্মনিবেদনের চূড়ান্ত প্রকাশ।

আত্মবিলোপই প্রেমের মূল কথা। প্রেমাস্পদের আনুগত্যই প্রেমিকের একমাত্র জীবনব্রত। প্রেমাস্পদের মাঝে নিজেকে যে বিলীন করে দেয় সেই সত্যিকারের প্রেমিক। হাজীদের কাবা ঘরে তওয়াফ, সাফা-মারওয়ায় দৌড়াদৌড়ি, মিনায় অবস্থান, কংকর নিক্ষেপ, আরাফা-মুযদালিফায় অবস্থানÑএসব কর্মকাণ্ডে প্রেমের এই রূপটিই উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। বাহ্যিক অবলোকন কিংবা যৌক্তিক মানদণ্ডে এসবের হয়ত তেমন কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু মানুষ আকল ও বুদ্ধির শাসন উপেক্ষা করে আনুগত্য, আত্মবিলোপ ও স্বতঃস্ফূর্ত সমর্পনের প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়েই এ নির্দেশনাগুলো পালন করে থাকে। আল্লাহর ঘরের মেহমানদের তখন একটা অনুভূতিই কার্যকর থাকে, এটা আমার প্রেমাস্পদ, আমার মাহবুব আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নির্দেশ।

urlহজের প্রতিটি আহকামে হাজী সাহেবরা তাদের নিটোল, নিষ্কলুষ ও অকৃত্রিম প্রেমের প্রকাশ ঘটিয়ে থাকে। প্রতিটি মুহূর্তে যে নিজের তপ্ত হৃদয় থেকে উৎসারিত কাতর প্রার্থনা জানায় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নিকট। নিবেদন করে তার প্রেম আকুতি গ্রহণের, তাকে আপন করে নেয়ার। প্রেমিক তার প্রেমাস্পদের সঙ্গে গোপন অভিসারে মিলিত হওয়ার দুর্বার স্পৃহা ও বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস নিয়ে যেমন ঘুরে বেড়ায় পথে প্রান্তরে, তেমনি হাজী সাহেবরাও তাদের মাওলায়ে হাকীকির প্রেমে আকুণ্ঠ নিমজ্জিত ও মাতোয়ারা হয়ে ছুটে চলে মক্কার আনাচে-কানাচে। কখনও বায়তুল্লাহয়, কখনও মিনায়, কখনও আরাফার ময়দানে আবার কখনও মুযদালিফায় খোদাপ্রেমের পসরা সাজিয়ে বসে। হজের দিনগুলোতে প্রেমের উচ্ছ্বাসে মুখর হাজী সাহেবদের প্রাণান্তকর আকুতি ও ব্যাকুল মিনতি একটাইÑপ্রেমাস্পদ প্রভুকে কিভাবে আপন করে পাওয়া যায়, তাঁর সন্তুটি কিভাবে অর্জন করা যায়। এজন্য খোদাপ্রেমের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনে হজের কোনো বিকল্প নেই। একমাত্র হজের মাধ্যমেই এই স্থুল দুনিয়ায় প্রেমাস্পদ প্রভুর সবচেয়ে কাছে পৌঁছা সম্ভব।

প্রেম ও উচ্ছ্বাসে ভরা আকুতি নিয়ে যে প্রেমিক ছুটে চলছে প্রেমাস্পদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার দীপ্ত বাসনায়, শুভ হোক তার এ যাত্রা। পথহারা সামর্থ্যহীন যে প্রেমিক প্রেমাস্পদের বিরহে হৃদয়জ্বালায় কাতরাচ্ছে, সাফল্য আসুক তার প্রেমে-প্রভু হে! মিনতি তোমার দরবারে এটাই।

Related posts

*

*

Top