তিনি ছিলেন একজন সাহসী, বলিষ্ঠ ও আপসহীন সিপাহসালার। তাঁর সাহসের কাছে নথি স্বীকার করতো বড় বড় অপশক্তি। যেটা তিনি ন্যায়ানুগ মনে করতেন তাতে অটল থাকতেন বলিষ্ঠভাবে। কোনোকিছু অন্যায় মনে করলে হুঙ্কার ছাড়তেন বাঘের মতো। অপশক্তি যত বড়ই হোক পরোয়া করতেন না তিনি। গোটা আলেমসমাজে তাঁর মতো সাহসী আর কেউ ছিলেন না। বিগত কয়েক দশকে এমন সাহসী কোনো আলেম অতীত হয়েছেন বলেও আমাদের জানা নেই। তিনি মুফতি ফজলুল হক আমিনী। দেশ-বিদেশে একবাক্যে যিনি ‘মুফতি আমিনী’ নামে পরিচিত। ১২.১২.১২ তারিখের প্রথম প্রহরে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
মুফতি আমিনী এ দেশের একজন শীর্ষ আলেম ছিলেন। হাজারো আলেমের মধ্যে মূল্যায়িত হতেন ভিন্নভাবে। সব সময় আলোচনায় থাকতেন। মিডিয়ায় সরব উপস্থিতি থাকতো তাঁর। বাম-ডান সব মিডিয়াই তাঁকে বেশ গুরুত্ব দিতো, যেমনটা অন্য কোনো আলেমের ক্ষেত্রে হতো না। কারণ তাঁর কথায় ছিল বারুদের মতো শক্তি। হুঙ্কার ছাড়তেন বাঘের মতো। রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তিটি থেকে নিয়ে প্রশাসনের প্রতিটি পর্যায়ে ক্রিয়া করতো তাঁর কথা। সবাই জানতো, কিছু বললে বাস্তবে তা করার ক্ষমতা তাঁর আছে। এজন্য অপশক্তিগুলো সব সময় তাঁর ভয়ে তটস্থ থাকতো। চরমভাবে তাঁর ওপর প্রতিঘাত করার চেষ্টা করতো। একশ্রেণীর মিডিয়া সব সময় লেগে থাকতো তাঁর পেছনে। সুযোগ পেলেই তাচ্ছিল্য, টিপ্পনি কাটতো। তবে এতে তিনি দমে যেতেন না। প্রতিপক্ষের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করেই অটল থাকতেন নিজ মিশনে।
স্বাধীনতাপরবর্তী এদেশের ইসলামী আন্দোলন-সংগ্রামে মুফতি আমিনী ছিলেন প্রায় অপরিহার্য। তাঁর সাহসী উচ্চারণ ছাড়া কোনো আন্দোলন চাঙ্গা হতো না। আন্দোলনের মঞ্চে সবাই খুঁজে ফিরত মুফতি আমিনীকে। প্রতীক্ষায় থাকতো তাঁর বলিষ্ঠ আহ্বানের। যেকোনো আন্দোলন-সংগ্রামকে সফল করার ম্যাজিক জানা ছিল তাঁর। তিনি কোনো আন্দোলনের ডাক দিলে তা সাধারণত সফল হতোই। এজন্য আন্দোলনের ময়দানে মুফতি আমিনীই ছিলেন সবার আস্থার জায়গা। তিনি ডাকলে দল-মত নির্বিশেষে সবাই ছুটে আসতেন। দেশ ও জাতির স্বার্থে কোনো আন্দোলনের সূচনা করলে একসময় তাতে এসে সবাই যোগ দিতেন। জীবদ্দশায় অনেকে আমিনীর গুরুত্ব না বুঝলেও তাঁর ইন্তেকালের পর সবাই বুঝছেন। প্রচণ্ডভাবে অনুভব করছেন তাঁর শূন্যতা।
বাবরী মসজিদ লংমার্চে আমিনীর ভূমিকা ছিল উজ্জ্বল। নাস্তিক-মুরতাদবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে নিয়ে যান তিনি। এই আন্দোলনে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন। নিজ জেলা ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায় এনজিওদের লাগামহীন আচরণে গর্জে ওঠেন সাহসী এই যোদ্ধা। ২০০১ সালে হাই কোর্টের ফতোয়া বিরোধী রায়ের প্রতিবাদে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন তিনি। ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে ঈমানী স্পৃহায় গর্জে ওঠা আমিনীর হুঙ্কার আজো চোখে ভাসে। তৎকালীন সরকারের রোষানলে পড়ে শীর্ষ আলেমদের মধ্যে আমিনীকেও তখন জেলে যেতে হয়। উত্তাল সেই দিনগুলোতে চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি কারো সঙ্গে আপস করেননি। বাতিলের সঙ্গে আপস করা তার অভিধানে ছিল না। এক্ষেত্রেই আমিনী ছিলেন অন্য দশজন আলেমের চেয়ে ব্যতিক্রম।
রাজনৈতিক জীবনে মুফতি আমিনীর রয়েছে একটি বর্ণাঢ্য অতীত। শ্বশুর হাফেজ্জী হুজুরের হাত ধরে তিনি রাজনীতিতে আসেন। পরে তিনি নিজে দল প্রতিষ্ঠা করেন। অবিভক্ত ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব হিসেবে তিনি ছিলেন বেশ তৎপর। চারদলীয় জোটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ২০০১ সালের নির্বাচনে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া-২ আসন থেকে বিপুল ভোটে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবেও তিনি বেশ সুনাম অর্জন করেন। চারদলীয় জোট সরকারের শরিক থাকাকালেও বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি বরাবরের মতো ন্যায়ের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে কয়েক বার জোট ত্যাগের হুঁশিয়ারিও তিনি দেন।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর রোষানলে পড়েন মুফতি আমিনী। ‘ইসলাম পরিপন্থী’ নারী নীতির বাতিল দাবিতে তিনি একটি সফল হরতাল পালনের পর সরকারের শ্যেনদৃষ্টি পড়ে তার ওপর। এক পর্যায়ে তাঁর ছোট ছেলে হাসনাতকে অপহরণ করে আমিনীকে মানসিকভাবে দুর্বল করার অপচেষ্টা করা হয়। তবে সেই নাজুক মুহূর্তেও আমিনী তাঁর আদর্শ ও নীতি থেকে একবিন্দু সরে আসেননি। এক পর্যায়ে তাঁর ছেলেকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেও তাঁকে কার্যত বন্দী করে রাখা হয়। লালবাগ-বড় কাটারা মাদরাসা আর বাসা এর মধ্যেই সীমিত হয়ে পড়ে তার চলাচল। সার্বক্ষণিক পুলিশ প্রহরায় লালবাগ মাদরাসায় কাটতে থাকে তাঁর অসহনীয় দিনগুলো। সারা দেশে ওয়াজ-নসিহত, সভা-সেমিনার এবং নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে তিনি মানসিকভাবে অনেকটা বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন। তবে স্বভাবসুলভ সাহসী উচ্চারণ, সময়ে সময়ে হুঙ্কার যথারীতি অব্যাহত থাকে। এভাবে তাঁর কেটে যায় ২১টি মাস। ব্রেইন স্ট্রোকে মারা যাওয়ার ঘটনায় তাঁর এই গৃহবন্দিত্বকে দায়ী করছেন অনেকেই। তাঁর পরিবার এবং জোটের সহযোগীরা এটাকে হত্যাকান্ড আখ্যায়িত করে এর জন্য সরকারকে দায়ী করেছেন। বাহ্যত না হলেও পরোক্ষভাবে এই দায়ী করাটা অযৌক্তিক নয়।
যারা যেকোনো অন্যায়-অপকর্ম করার আগে ‘আমিনী’ নামক দেয়ালটির কথা ভাবতো তারা আজ অনেকটাই নির্ভার। সেই অপশক্তিগুলোর পথে আর কোনো বাধা রইল না। মুফতি আমিনীর শূন্যতা এদেশে তথাকথিত স্যেকুলারবাদী ও নাস্তিকদের আস্ফালন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক গর্জে ওঠার মতো সাহসী ও আপসহীন যোদ্ধা আর কেউ নেই। ইসলামি দলের সংখ্যা যেমন কম নয়, তেমনি অভাব নেই এসব দলের নেতার। কিন্তু আমিনীর মতো সাহসী উচ্চারণ করার মতো কাউকে আপাত দৃষ্টিতে চোখে পড়ে না। জানি না, এ শূন্যতা আদৌ কোনোদিন পূরণ হবে কি-না। এই জায়গাটি ফাঁকা রয়ে গেলে এদেশের ইসলাম ও মুসলমানদের ভবিষ্যত যে ভয়াবহ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মুফতি আমিনী আন্দোলন-সংগ্রাম ও রাজনীতির ময়দানে একজন বলিষ্ঠ সিপাহসালার ছিলেন শুধু তাই নয়, নানামুখী যোগ্যতার আধারও ছিলেন। আলেম হিসেবে অতি মেধাবী, বিচক্ষণ ও প্রাজ্ঞ ছিলেন। আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী এবং হজরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. নিজ হাতে তিলে তিলে গড়ে তুলেন তাকে। হাদিসের মসনদে, ওয়াজ-বক্তৃতার মঞ্চে, লেখালেখির অঙ্গনে, আদর্শ পাঠদানে সবক্ষেত্রেই মুফতি আমিনী ছিলেন বিরল প্রতিভা ও যোগ্যতার অধিকারী। সহজ-সরল, অমায়িক ও নির্ভেজাল একজন মানুষ ছিলেন তিনি। কাছে ভিড়লে তার উদার ব্যক্তিত্বের পরিচয় পাওয়া যেতো। দেশ-বিদেশে তার হাজার হাজার ছাত্র-ভক্ত-অনুরাগী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। তাঁর এই হঠাৎ চলে যাওয়াটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে সবার।