জহির উদ্দিন বাবর
গত ১৯ জুনের একটি খবর। বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবরটি ফলাও করে প্রচার হয়। রাজধানীর হাজারীবাগে ট্যানারির বিষাক্ত বর্জ্য দিয়ে মৎস্য ও পোলট্রির খাদ্য তৈরির ছয়টি কারখানা বন্ধ করে দেয় র্যাব। এর সঙ্গে জড়িত ১০ জনকে দুই বছর মেয়াদে বিনাশ্রম কারাদ- এবং ২৪ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
র্যাব জানায়, কারখানাগুলোর গুদাম থেকে মোট দুই হাজার ৮০০ টন বিষাক্ত মৎস্য ও পোলট্রি খাদ্য এবং খাদ্য উপাদান জব্দ করা হয়। এসব খাদ্যে বিষাক্ত উপাদান ছিল। এতে ক্যানসার হওয়ার মতো উপাদানের উপস্থিতিও রয়েছে। এ ছাড়া মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক আছে। এগুলো খেলে মাছ ও মুরগি মোটা হয় ঠিকই, কিন্তু এর মাধ্যমে মানবদেহে অত্যন্ত ক্ষতিকর উপাদান প্রবেশ করে।
আপাতদৃষ্টিতে খবরটি ছোট্ট হলেও পরিণতির কথা ভাবলে রীতিমতো আঁৎকে ওঠার মতো। বিষাক্ত এসব খাবার খাওয়ানো হচ্ছে মাছ ও পোল্ট্রি মুরগিকে। আর সেই মাছ ও মুরগি খাচ্ছি আমরা। সুতরাং পরোক্ষভাবে বিষাক্ত এসব খাবার আমাদের পেটেই যাচ্ছে। পরোক্ষভাবে খাবারের সঙ্গে আমরা বিষ গলদকরণ করছি। এর কারণে ক্যানসারসহ নানা মারণব্যাধি বাসা বাঁধতে পারে আমাদের শরীরে। র্যাবের জব্দকৃত বিপুল পরিমাণ এই খাবার খেয়ে কত লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হতো তা কি আমরা একবার ভেবেছি! অসৎ চক্রটি এবার র্যাবের হাতে ধরা পড়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। এ ধরনের কত অসৎ চক্র আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে যারা আমাদেরকে জেনেশুনে বিষ খাওয়াচ্ছে।
আজ যারা সামান্য একটু মুনাফার লোভে যে অসৎ কাজটি করছেন তারা কি একটু ভেবেছেন এটা কত জঘন্য কাজ! যিনি মাছ ও মুরগির খাদ্যে বিষাক্ত জিনিস ঢুকিয়ে দিচ্ছেন তিনিই আবার আরেকজনের বিষ মেশানো ফল, সবজি বা অন্য কোনো খাবার খাচ্ছেন। যিনি ফলে বিষ মেশাচ্ছেন তিনিই আবার বিষাক্ত খাবারের মাছ ও মুরগি খাচ্ছেন। এভাবে আমরা অন্যকে ঠকাতে গিয়ে মূলত নিজেই ঠকে যাচ্ছি। সামান্য পয়সার লোভে পড়ে যা করছি তা অনেক বড় আত্মঘাতী কাজ। প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গায় এসব আত্মঘাতী কাজ থেকে বিরত না থাকলে এই সমাজে বাস করা সবার জন্য কঠিন হয়ে যাবে- এটা কি একবার আমরা কেউ ভাবছি!
অসততার চেইন আজ আমাদের সমাজের সর্বত্র বিস্তৃত। আমরা নিজের সামান্য লাভের জন্য আরেকজনের মহাবিপদ ডেকে আনতেও কুণ্ঠিত হচ্ছি না। কীভাবে নিজে একটু ভালো থাকতে পারি সেই প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে গিয়ে নিজেকেই পরোক্ষভাবে বিপদে ফেলে দিচ্ছি। একজনের অসততা আরেকজনকে আক্রান্ত করছে। এভাবে আমরা বাহ্যত এক জায়গায় জয়ী হলেও অন্যদিকে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ছি।
বর্তমানে ভেজাল আর বিষাক্ত খাবারে ছেয়ে গেছে পুরো দেশ। কোনো খাবার আজ আর নির্বিঘেœ খাওয়া যাচ্ছে না। কোনো ব্র্যান্ড আর কোম্পানির ওপর ভরসা করতে পারছে না ভোক্তারা। সম্প্রতি হাইকোর্টে ৫২টি পণ্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যার মধ্যে অনেক নামকরা কোম্পানির তৈরি পণ্যও রয়েছে। এসব পণ্য আমরা বছরের পর বছর ধরে কিনছি। তাহলে কি এতদিন আমরা শুধু ঠকেছি! সঠিকভাবে যাচাই করলে এ ধরনের পণ্যের তালিকা নাজানি কতটা দীর্ঘ হবে!
কারও মধ্যে বিবেকবোধ থাকলে খাদ্য ও ভোগপণ্যে কেউ কোনোদিন ভেজাল দিতে পারে না। এটা জাতিকে পঙ্গু করে দেয়ার শামিল। পৃথিবীতে অনেক খারাপ জাতি আছে, তারা অন্তত এই জায়গাটিতে অসৎ হয় না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, জাতীয়ভাবে আমাদের অসততা এই ক্ষেত্রটিতেই বেশি ধরা পড়ে। এর ভয়াবহ পরিণতির শিকার আমরা এখনই হতে শুরু করেছি। দেশে নানা মারণব্যাধি ও রোগবালাই আতঙ্কিত হওয়ার মতো রূপ ধারণ করছে। এর পেছনে আমাদের এই আত্মঘাতী লোভ সবচেয়ে বেশি দায়ী। এখনই সমাজের সবাইকে এ ব্যাপারে সতর্ক না হলে ভবিষ্যতে আরও বড় মাশুল দিতে হবে।