আমাদের প্রিয় মুফাসসির সাহেব হুজুর রহ.

জহির উদ্দিন বাবর
সাধারণ মানুষের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে পুরো কুরআনে কারিমের তাফসির সম্পন্ন করার রেকর্ড এই অঞ্চলে আছে বলে জানা নেই। বিরল সেই রেকর্ডটি যিনি গড়েছিলেন তিনি হলেন আমাদের প্রিয় মুফাসসির সাহেব হুজুর খ্যাত আল্লামা শামছুল ইসলাম রহ.। ঐতিহাসিক শহীদি মসজিদে প্রতি শনিবার বাদ মাগরিব চিরচেনা গলায় তাঁকে তাফসির করতে দেখেছি বহু বছর। আমরা যখন জামিয়া ইমদাদিয়ায় পড়ি তখন বাদ মাগরিব তাফসিরে বসার অনুমতি ছিল না। তবুও ছাত্রদের অনেককে লুকিয়ে লুকিয়ে সেই তাফসিরে বসতে দেখেছি। এই তাফসির মাহফিলটি ছিল মূলত সাধারণ মুসল্লিদের জন্য। কিন্তু কয়েক দিন বসে দেখেছি মাদরাসাপড়–য়াদের জন্যও অনেক খোরাক রয়েছে এতে। এছাড়া হুজুরের সাবলীল উপস্থাপনার কারণে তাফসিরের সেই মজলিসটি সবাইকে চুম্বকের মতো টানতো।
ছাত্রজীবন পেরিয়ে আসার পর সেই তাফসিরের মজলিসে বসার আর সুযোগ হয়নি। তবে শনিবার বাদ মাগরিব শহীদি মসজিদের আশপাশে গেলে ভেসে আসতো হুজুরের ভাঙা ভাঙা গলার চিরচেনা সেই সুর। দেখতাম বিপুলসংখ্যক মুসল্লি তীর্থের কাকের মতো বসে আছে। মসজিদের উত্তর পাশে তাফসির শুনতে বিপুলসংখ্যক নারীরও সমাগম হতো। পরবর্তী সময়ে শুনেছি, হুজুর ধারাবাহিকভাবে পুরো কুরআনের তাফসির সম্পন্ন করেন। শুধু খতম বাকি ছিল। এ উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠান করার তামান্না ছিল কুরআনের একনিষ্ঠ এই খাদেমের। কিন্তু আল্লাহর ফায়সালা, সেই অনুষ্ঠান করার আগেই তাঁকে চলে যেতে হলো মাওলা পাকের ডাকে সাড়া দিয়ে। শুনে ভালো লাগছে, হজরতের কাক্সিক্ষত সেই অনুষ্ঠানটি হচ্ছে। সেখানে তাঁর শূন্যতা প্রচ-ভাবে অনুভূত হবে। আশা করি কবরে শুয়ে শুয়ে কুরআনি এই খেদমতের ফুয়ুজ ও বারাকাত ইনশাআল্লাহ কেয়ামত পর্যন্তই তিনি পেতে থাকবেন।
দুই.
হজরত শামসুল ইসলাম রহ. ব্যক্তিত্বের দিক থেকে অনেক উঁচুমাপের একজন মানুষ ছিলেন। হবিগঞ্জের বাহুবলের একটি খান্দানি পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর কয়েকজন ভাই জাগতিকভাবে বেশ প্রতিষ্ঠিত বলে জানি। তিনি জীবনের সিংহভাগ কাটিয়েছেন কিশোরগঞ্জে। এখানকার মাটি ও মানুষের সঙ্গে ছিল তাঁর আত্মার সম্পর্ক। ইলমি দিক থেকে জাহাজতুল্য ছিলেন, কিন্তু তাঁর চলাফেরা ও আচরণে সেটা টের পাওয়া যেতো না। একদম সাদাসিধে চলাফেরা করতেন। শোলাকিয়া রোডের বাসায় তাঁকে সবসময় হেঁটে যেতেই দেখেছি। শহরের মদিনা কিংবা তাজ হোটেলে একজন সাধারণ মানুষের মতোই তাঁকে চা নাস্তা সারতে দেখেছি।
তাঁর গোটা জীবনটাই অনন্য। কুরআন ও হাদিসের জন্য পুরো জীবন তিনি ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। দেশের অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইমদাদিয়ায় তিনি বহু বছর ধারাবাহিকভাবে তিরমিজি ও মিশকাত শরিফ পড়িয়েছেন। দরসে নেজামির অন্তর্ভুক্ত এই দুটি কিতাব যারা পড়ান তাদের ইলমি অবস্থান নিয়ে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতিটি মাদরাসায় সাধারণত তুখোড় মুহাদ্দিসরাই এই কিতাবগুলো পড়িয়ে থাকেন। শাহ সাহেব হুজুর রহ.-এর জীবদ্দশায় তিনি শহীদি মসজিদে জুমা পড়াতে না পারলে শামছুল ইসলাম রহ.কে ঐতিহ্যবাহী এই মিম্বরে দেখেছি। কিশোরগঞ্জসহ গোটা ময়মনসিংহ অঞ্চলে ওয়াজ ও তাফসির মাহফিলে তিনি অতিথি থাকতেন।


সবদিক বিচারেই অনন্য উচ্চতায় ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব ও ইলমি অবস্থান। তিনি মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় কতটা স্থান করে নিতে পেরেছিলেন সেটার অনুভব করা গেছে বিশাল জানাজা দেখেই। ঐতিহাসিক শোলাকিয়ার মাঠে হাতেগোনা যে জানাজাগুলো স্মরণীয় হয়ে থাকবে বহুকাল এর মধ্যে অন্যতম তাঁর জানাজাটি। একজন মানুষের জীবনের অর্জন ও সাফল্যের বিষয়টি জানাজা দেখেও টের পাওয়া যায়। এতো বিপুলসংখ্যক মানুষের হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা নিয়ে যিনি ওপারে গেলেন নিঃসন্দেহে তিনি উচ্চ মর্যাদায় আসিন হবেন।
সারল্য এবং সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়ার গুণটি হুজুরের মাঝে বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছি। এতো বড় একজন মানুষ, এতো ইলমের অধিকারী, কিন্তু এর কোনো প্রকাশ চলনে-বলনে ঘটত না। সবার সঙ্গে মিশতেন, কথা বলতেন, মানুষকে আপন করে নিতেন। এজন্য ছাত্ররা ছিল তাঁর জন্য নিবেদিত। শহরের সাধারণ মানুষও তাঁকে খুব পছন্দ করতো। তিনি কিশোরগঞ্জ শহরের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। এ কারণেই তিনি এই শহরের মানুষদের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন, যার বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখেছি শোলাকিয়া মাঠের জানাজায়। আল্লাহ তাঁর কবরকে নুর দ্বারা ভরে দিন। তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউসের মেহমান হিসেবে কবুল করুন। আমিন।

*

*

Top