পয়লা বৈশাখ এখন আমাদের জাতীয় জীবনের অন্যতম উৎসবের দিন। বাংলা নববর্ষের এই দিনটিকে কেন্দ্র করে মাতামাতি এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। সারা বছর বাঙালিয়ানার খবর না থাকলেও একদিনের বাঙালি হওয়ার মেকি প্রতিযোগিতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আর এটা উস্কে দিচ্ছে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া। এসব উন্মাদনায় ইন্ধন যোগায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর স্পন্সর। উদ্দেশ্যমূলকভাবে মুসলিম অধ্যুষিত এই অঞ্চলটিতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বিজাতীয় কালচার চালুর চেষ্টা করে আসছে অনেক দিন ধরে। তথাকথিত আধুনিকতা, নগ্নতা ও বেলেল্লাপনা যেখানে সেখানেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। আমাদের দেশের মোবাইল কোম্পানিগুলো এক্ষেত্রে কয়েক ধাপ এগিয়ে। ভিনদেশি কালচার আমদানির ক্ষেত্রে মোবাইল কোম্পানিগুলোর কোনো জুড়ি নেই। পয়লা বৈশাখকেন্দ্রিক উন্মাদনা ছড়িয়ে দেয়ার পেছনে প্রধানত ভূমিকা স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর; আর তাদের স্পন্সর হিসেবে কাজ করছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। এতে দিন দিন নির্বাসনে যাচ্ছে ইসলামী ভাবধারা এবং পূত-নিখুঁত সংস্কৃতি। পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে যে বেলেল্লাপনা শুরু হয়েছে তা পশ্চিমা নগ্ন কালচারকেও হার মানায়।
১২০৩ খৃস্টাব্দ মোতাবেক ৬০০ হিজরিতে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বঙ্গ বিজয় করেন। তখন এদেশে একমাত্র হিজরি সনের প্রচলিত ছিল। এরপর প্রায় ৩৬৩ বছর পর্যন্ত ভারতবর্ষে এ তারিখের প্রচলন বহাল থাকে। সেকালে জমিতে ফসল উৎপাদনের সময়কালকে ভিত্তি করে খাজনা আদায় করা হতো। এ ক্ষেত্রে হিসাব করা হতো হিজরি সনের। কিন্তু হিজরি সন চন্দ্রমাসভিত্তিক হওয়ায় তা কোনো ফসলি মৌসুম মেনে চলতো না। তাই খাজনা আদায়ের হিসাব নিকাশ সংরক্ষণে গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি হয়। তখন ছিল মোঘল বাদশা সম্রাট আকবরের শাসনামল। তার শাসনামলের ২৯ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর এ সমস্যা সমাধানের পন্থা নিয়ে কথা ওঠে। এর আশু সমাধান বের করতে আকবর তার রাজসভার রাজজ্যোতিষ বিজ্ঞ পণ্ডিত ফতেহউল্লাহ সিরাজীকে নির্দেশ দেন। তিনি সম্রাটের নির্দেশ অনুযায়ী সৌরমাসভিত্তিক ফসলি সন প্রণয়ন করেন। সম্রাট আকবর সিংহাসনে আরোহন করেছিলেন ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৫৫৬ খৃস্টাব্দ মোতাবেক ২৮ রবিউস সানী ৯৬৩ হিজরি। সম্রাটের সিংহাসনে আরোহনের এ স্মৃতিকে চিরভাস্বর করে রাখতে ফতেহউল্লাহ ১৫৫৬ সালের ১১ এপ্রিলকে পয়লা বৈশাখ ধরে ৯৬৩ সনকে মূল ধরে ফসলি সন গণনা শুরু করেন। ১৫৮৫ খৃস্টাব্দে এই ফসলি সন ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। পরবর্তী সময়ে এ ফসলি সনই বাংলা সাল বা বঙ্গাব্দ নাম ধারণ করে। এখানে বঙ্গাব্দের সঙ্গে হিজরি সনের নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। ৯৬৩ হিজরিতে জন্মলাভ করে ৯৬৩ বছর ধরে গণনা শুরু অর্থাৎ জন্ম থেকেই বাংলা সালের বয়স ৯৬৩ বছর। তাই হিজরি সনকে বাংলা সনের ভিত্তি বলা চলে। যেহেতু চন্দ্রবর্ষ ও সৌরবর্ষের মধ্যে ১১ দিনের পার্থক্য রয়েছে এজন্য এ দুটির মধ্যে সমতা রাখা সম্ভব হয়নি।
এ থেকে স্পষ্ট যে, বাংলা সন মুসলিম সংস্কৃতিরই অঙ্গ। এ হিসেবে পয়লা বৈশাখ উদযাপনও মুসলিম সংস্কৃতি অনুযায়ী হওয়াই বাঞ্চনীয়। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশে পয়লা বৈশাখ নামে যে সংস্কৃতি চালু আছে তা ইসলামের সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর চিরায়ত সংস্কৃতির প্রতি অবজ্ঞা করে বিজাতীয় এই সংস্কৃতি দেশ, জাতি ও ধর্মের জন্য সুফল বয়ে আনবে না। আনুষ্ঠানিকভাবে পয়লা বৈশাখ পালন করতে হলে ইসলামী সংস্কৃতি ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর চাহিদাকে বিবেচনায় রাখার কথা ছিল। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতির কোথাও এর কোনো বালাই নেই।
দুই
মানুষের জীবনাচার ও জীবনযাত্রার প্রণালীই সংস্কৃতি। সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জিত আচার-ব্যবহার, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা, নীতি-প্রথা, আইন-খাদ্যাভাস ইত্যাদির সমষ্টিতে সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। মানুষের সামাজিক সব চাহিদাই সংস্কৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সংস্কৃতি মানুষের অস্তিত্বকে রক্ষা করে। মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর সংস্কৃতি নেই। এজন্য সংস্কৃতি আমাদের অহংকার। আমাদের সংস্কৃতি আমাদের অস্তিত্ব ও বিকাশে প্রভাবময়। যে সমাজের সংস্কৃতি যত উন্নত ও গতিশীল সে সমাজ ও জাতি তত বলিষ্ঠ ও সুসংহত। সুষ্ঠু সংস্কৃতির বিকাশই একটি সমাজ ও জাতিকে মহীয়ান করে তোলে।
আমাদের এই ভূখ-টি বহুমাত্রিক সংস্কৃতির চর্চায় যুগ যুগ ধরে বৈচিত্র্যময়। এতসব বিচিত্র সংস্কৃতি পাশাপাশি সহাবস্থান করে চলছেÑএমনটা পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে জানা নেই। আর যাই হোক বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিক থেকে আমরা গর্বিত জাতি। ভূখ-, ভাষা ও ধর্মÑএ তিনের উপাদানে সংস্কৃতির যে মূল স্তম্ভ¢ গড়ে উঠে তা এখানে বিশেষভাবে কার্যকর। আমাদের সংস্কৃতিতে ভূখ- ও ভাষাÑএ দুটি উপাদানকে ছাপিয়ে গেছে ধর্ম। এজন্য আমাদের সংস্কৃতির পরতে পরতে এ উপাদানটির প্রভাব একটু বেশিই পরিলক্ষিত হয়। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধর্মীয় বোধ ও বিশ্বাসের ধারক। এজন্য তাদের সংস্কৃতিটাও ধর্মীয় আবেশে আবর্তিত হয়েছে। আর যেহেতু ধর্মবিশ্বাসে এদেশের সিংহভাগই মুসলিম তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রচ্ছন্নতায় হলেও দেশীয় সংস্কৃতিতে ইসলামের একটা চ্ছটা ও স্ফূরণ অনুভব করা যায়। বাইরের আমদানি করা তথাকথিত নাগরিক ও শহুরে সংস্কৃতির বিচ্ছিন্ন কিছু প্রসঙ্গ বাদ দিলে আবহমান কাল থেকে চলে আসা গ্রাম-বাংলার সংস্কৃতিতে ইসলামী মূল্যবোধ ও ভাবধারার ছাপটা মোটাদাগে ধরা পড়ে।
সংস্কৃতি মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সুস্থ জীবন যাপনের ক্ষেত্রে সংস্কৃতির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সংস্কৃতির সুষ্ঠু চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমে মন ও মননের বিকাশ ঘটে। সংস্কৃতির উৎপত্তি ও বিকাশের ধারায় ধর্মের অবস্থানকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখা যাবে না। যে ধর্মের ওপর ভিত্তি করে সংস্কৃতির উৎপত্তি সেটা সে ধর্মেরই সংস্কৃতি। প্রত্যেক ধর্মেরই নিজস্ব কিছু সংস্কৃতি থাকতে পারে। নিজস্ব সংস্কৃতির মাধ্যমেই সেই ধর্মের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্রবোধের প্রকাশ ঘটে। এর আবরণেই বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর পরিচয় পর্বটাও সম্পন্ন হয়ে যায়। সে হিসেবে বাংলাদেশে বাস করে যারা বাংলায় কথা বলে এবং ইসলামী অনুশাসন মেনে চলে তাদের সংস্কৃতিকে বাংলাদেশের মুসলিম সংস্কৃতি বলতে হবে। এটা শুধু মুসলমানদের সাথেই বিশেষায়িত নয়। বাংলাদেশের হিন্দু বা বৌদ্ধ সংস্কৃতিও হতে পারে। সংস্কৃতি থেকে হিন্দু, বৌদ্ধ বা মুসলিম বাদ দিয়ে শুধু বাঙালি বা বাংলাদেশি সংস্কৃতি বললে সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান ধর্ম বাদ পড়ে যায়। এর দ্বারা সংস্কৃতিকে খাটো করা হয়। বর্তমানে আমাদের দেশে বাঙালি সংস্কৃতি নামে যে সংস্কৃতির চর্চা বা প্রচলন ঘটছে তাতে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির আধিক্যই বেশি। এটাকে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দেয়া এক ধরনের অবিচার। পয়লা বৈশাখ আমাদের জাতীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিনটিকে তথাকথিত বাঙালি সংস্কৃতি হিসেবে না ধরে বাংলাদেশের মুসলিম সংস্কৃতি বলাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত। কেননা বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন প্রবর্তনের পেছনে অবদান মুসলমানদেরই। মুসলমানদের প্রয়োজনে মুসলিম সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করেই এর উৎপত্তি। সুতরাং পয়লা বৈশাখ উদযাপন করতে হলে সেটা এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বোধ ও বিশ্বাসের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই পালন করতে হবে।
একদিনের বাঙালি হওয়ার মেকি প্রতিযোগিতা
Tags