মানুষের জীবনাচার ও জীবনযাত্রার প্রণালীই সংস্কৃতি। সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জিত আচার-ব্যবহার, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা, নীতি-প্রথা, আইন-খাদ্যাভাস ইত্যাদির সমষ্টিতে সংস্কৃতি গড়ে উঠে। মানুষের সামাজিক সব চাহিদাই সংস্কৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সংস্কৃতি মানুষের অস্তিত্বকে রক্ষা করে। মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর সংস্কৃতি নেই। এজন্য সংস্কৃতি আমাদের অহংকার। আমাদের সংস্কৃতি আমাদের অস্তিত্ব ও বিকাশে প্রভাবময়। যে সমাজের সংস্কৃতি যত উন্নত ও গতিশীল সে সমাজ ও জাতি তত
বলিষ্ঠ ও সুসংহত। সুষ্ঠু সংস্কৃতির বিকাশই একটি সমাজ ও জাতিকে মহীয়ান করে তোলে।
আমাদের এই ভূখ-টি বহুমাত্রিক সংস্কৃতির চর্চায় যুগ যুগ ধরে বৈচিত্র্যময়। এতসব বিচিত্র সংস্কৃতি পাশাপাশি সহাবস্থান করে চলছেÑএমনটা পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে জানা নেই। আর যাই হোক বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিক থেকে আমরা গর্বিত জাতি। ভূখ-, ভাষা ও ধর্মÑএ তিনের উপাদানে সংস্কৃতির যে মূল স্তম্ভ¢ গড়ে উঠে তা এখানে বিশেষভাবে কার্যকর। আমাদের সংস্কৃতিতে ভূখ- ও ভাষাÑএ দুটি উপাদানকে ছাপিয়ে গেছে ধর্ম। এজন্য আমাদের সংস্কৃতির পরতে পরতে এ উপাদানটির প্রভাব একটু বেশিই পরিলক্ষিত হয়।
এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধর্মীয় বোধ ও বিশ্বাসের ধারক। এজন্য তাদের সংস্কৃতিটাও ধর্মীয় আবেশে আবর্তিত হয়েছে। আর যেহেতু ধর্মবিশ্বাসে এদেশের সিংহভাগই মুসলিম তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রচ্ছন্নতায় হলেও দেশীয় সংস্কৃতিতে ইসলামের একটা চ্ছটা ও স্ফূরণ অনুভব করা যায়। বাইরের আমদানি করা তথাকথিত নাগরিক ও শহুরে সংস্কৃতির বিচ্ছিন্ন কিছু প্রসঙ্গ বাদ দিলে আবহমান কাল থেকে চলে আসা গ্রাম-বাংলার সংস্কৃতিতে ইসলামী মূল্যবোধ ও ভাবধারার ছাপটা মোটাদাগে ধরা পড়ে। সহজ ও সরলপ্রাণ গ্রাম্য লোকেরা তাদের প্রভাতটা শুরু করে স্রষ্টার মহিমার সামনে সেজদায় অবনত হয়ে। ভোরের স্নিগ্ধ-কোমল জান্নাতি পরিবেশে প্রতিটি ঘর থেকে কুরআন তেলাওয়াতে সুমিষ্ট সুর যখন বাতাসে মৌ মৌ করতে থাকে তখনই সূর্য তার আলোকবিভায় উদ্ভাসিত করে তোলে পুরো জমিন। স্রষ্টার গুণকীর্তনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা। প্রতিটি কাজে-কর্মে প্রভুকে স্মরণ করার রেওয়াজ এখনও প্রচলিত। সত্যনিষ্ঠা, পরোপকার, আতিথেয়তা, সহমর্মিতাবোধ, পরমত সহিঞ্চুতা, বিনয় ও নম্রতা, দেশাত্মবোধ, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতাÑ এ ধরনের যত ইসলামী শিক্ষা আছে সবগুলোর প্রতিই তারা আন্তরিক ও নিবেদিতপ্রাণ। ইসলামের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিংবা সামাজিক কাঠামো বিনষ্ট করে এমন যেকোনো কর্মকা- ও প্রয়াসকে তারা ঘৃণা করে, এর প্রতিরোধে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। সুস্থ, শালীন ও বাঞ্ছিত ধারায় সমাজের সহজাত যে গতি তা এদেশের ধর্মপ্রাণ জনসাধারণের নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতার ফসল।
আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির এই যে সুষ্ঠু বিকাশ তা কি এমনিতেই হয়ে গেছে? এর নেপথ্যে রয়েছে সাধনা ও প্রয়াসের দীর্ঘ পরিক্রমা। এককালে পীর-ওলীরা এদেশের জনসাধারণের মধ্যে ইসলামের বীজটিকে সযতেœ রোপন করেছেন। তাদের রোপিত বীজটির অঙ্কোরোদগমন এবং স্নিগ্ধ-সজীব বৃক্ষরূপে গড়ে তোলার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করেছেন হাক্কানী ওলামায়ে কেরাম। এসব আলেমের ত্যাগ, সাধনা ও ইখলাসের বদৌলতেই আজকের বাংলাদেশের সংস্কৃতির চিত্রটা অনেকটাই পরিশীলিত, নিখাদ শুভ্রতায় পরিপুষ্ট। তথাকথিত আধুনিক বিশ্বে সাংস্কৃতিক অধঃপতন যে পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে, সে তুলনায় বাংলাদেশের সংস্কৃতির বৃহৎ অংশটা এখনও সুষ্ঠু ও শালীন বলেই মনে হবে। ওলামায়ে কেরামের অব্যাহত প্রচেষ্টার ফলেই এ সুফলটুকু আমরা পাচ্ছি।
আমাদের সংস্কৃতিতে ওলামায়ে কেরামের যে প্রভাবটা তা খোলা চোখে তত বড় করে ধরা পড়ে না। কিন্তু একটু গভীরভাবে বিশে¬ষণ করলে, সূক্ষ্মভাবে দেখলে এদেশের সংস্কৃতিতে তাদের প্রভাবটাই মূখ্য। আলেমরা সংস্কৃতি নিয়ে তেমন একটা হাঁকডাক করেন না, সংস্কৃতি নিয়ে চলমান ব্যবসার সঙ্গেও আলেমদের সম্পর্ক নেই। তাই এ অঙ্গনে আলেমদের প্রভাব ও ছাপটা সবার কাছে পরিষ্কার নয়। হাক্কানী ওলামায়ে কেরাম নিরবচ্ছিন্নভাবে জনসাধারণের ইসলাহ ও হেদায়াতের জন্য কাজ করছেন। নিভৃতচারী এ সাধকেরা নীরবে নিভৃতে খানকায়, মসজিদ-মাদরাসার হুজরায় বসে লোকদেরকে আল্ল¬াহমুখী-পরকালমুখী করছেন। মানুষের ভেতরের পশুপ্রবৃত্তি দূর করে মনুষত্ববোধ জাগ্রত করছেন। মাঠে-ময়দানে, গ্রামে-গঞ্জে হেদায়াতী বয়ান, ওয়াজ-নসিহত করে করে জীবনচলার পাথেয় যোগাচ্ছেন। এক কথায় একজন আদর্শ নাগরিক তৈরির জন্য নৈতিক ও জাগতিক যে শিক্ষা তা অকাতরে বিলিয়ে যাচ্ছেন আলেমসমাজ। আমাদের সমাজ ও পারিপার্শ্বিকতা বিকৃতি ও পতনের আঁধারে যেন তলিয়ে না যায় এর জন্য যে ব্যাকুলতা ও আকুল প্রয়াসÑএটাই তো সাংস্কৃতিক প্রভাবের ক্ষেত্রে মূখ্য বিষয়। আর গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টির প্রতিই আলেমদের সুতীক্ষè নজর এবং সার্বক্ষণিক প্রয়াস। সুতরাং একথা বললে কি অত্যুক্তি হবে যে, আমাদের সংস্কৃতিতে আলেমদের প্রভাবই মূখ্য?
ওলামায়ে কেরাম স্বচ্ছ, নিষ্কলুষ ও সাদাসিধে জীবনে অভ্যস্ত। জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য অনৈতিক পন্থা অবলম্বন কিংবা বে-পরোয়া হয়ে যাওয়া কোনো প্রকৃত আলেমের ক্ষেত্রে কল্পনাও করা যায় না। ফেরেশতাসুলভ এ জীবনাচারের জন্যই হাক্কানী আলেমরা সমাজের সর্বশ্রেণীর কাছে ভক্তি ও শ্রদ্ধায় অনন্য। বিপথগামী একজন লোকও আলেমের সামনে পড়লে শ্রদ্ধায় কাতর হয়ে যায়, ভক্তিতে গদগদ করতে থাকে। নিজের অনৈতিক ও অসমর্থিত জীবনাচারের জন্য মনে মনে লজ্জিত হয়, সম্বিত ফিরে পায়। ক্ষেত্র বিশেষে এ প্রভাবের কারণেই একদিন তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। এভাবে সমাজের বিভিন্ন স্তরে আলেমদের প্রভাবময় যে অবস্থান তাতে কি সংস্কৃতি প্রভাবান্বিত হচ্ছে না? আলেমদের এ কৃতিত্বটুকু মেনে নিতে কুণ্ঠিত হওয়া কি সমীচীন?