একজন সজ্জন মানুষের আকস্মিক চলে যাওয়া

জহির উদ্দিন বাবর

প্রতিটি চলে যাওয়াই কষ্টের। তবে কিছু কিছু চলে যাওয়া মেনে নিতে একটু বেশিই কষ্ট হয়। একজন যেকোনো বয়সে মারা যাক সেটাকে ইসলাম ‘অকাল’ মৃত্যু বলে না। তবুও কিছু কিছু মৃত্যুকে মেনে নেয়া অসম্ভব কঠিন ব্যাপার। ড. আব্দুল মুনিম খানের চলে যাওয়াটাও তেমনি। তাকে যারা চিনেন, জানেন কেউই এ চলে যাওয়াকে সহজে মেনে নিতে পারছেন না। যদিও আল্লাহর ফায়সালার ওপর কারও কোনো হাত নেই।

২৯ জুন সকাল ১০টার দিকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বিশিষ্ট এ স্কলার ও শিক্ষাবিদ চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তার আকস্মিক এ চলে যাওয়ার খবর স্বজনদের যেমন কাঁদিয়েছে, তেমনি শোকাহত করেছে চেনা-পরিচিত আর ভক্ত-অনুরাগীদের। একজন শিক্ষাবিদ, লেখক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হিসেবে তার অনুসারী-অনুরাগীর সংখ্যা অগণিত। তাদের সবার কাছেই এই মৃত্যুটি বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো মনে হয়েছে। এই মৃত্যুর খবরে সবাইকে আফসোস করতে দেখা গেছে।

ড. আব্দুল মুনিমের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত চেনা-জানা খুব একটা ছিল না। ঘনিষ্ঠভাবে ওঠাবসার সুযোগও তেমন হয়নি। কয়েকবার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে। তবে তাকে আমি যেমন অনেক দিন ধরে চিনি, তিনিও হয়ত আমাকে চিনতেন। এজন্য যে কয়বার দেখা হয়েছে তার আন্তরিকতা দেখে বিমুগ্ধ না হয়ে পারিনি। অত্যন্ত সজ্জন ও অমায়িক মানুষ ছিলেন। কথা বলতেন হাসিমাখা মুখে। চেহারায় একটা আভিজাত্য আর ব্যক্তিত্বের ছাপ ছিল।

 সবশেষ গত এপ্রিলে জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ। একটি অনলাইন নিউজপোর্টাল তাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কয়েকজন লেখক-উদ্যোক্তাকে সম্মাননা দিয়েছিল। এর মধ্যে ড. আবদুল মুনিম খান ছিলেন, সঙ্গে ছিলাম আমিও। সেদিন তিনি মঞ্চে ছিলেন। আমি ছিলাম সামনের সারিতে মুখোমুখি বসা। সৌজন্য কথাবার্তা ছাড়া সেদিন আর তেমন কোনো আলাপ হয়নি। কে জানত, সেটাই তার সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ!

সেদিন তিনি বাংলাদেশের ওপর একটি লম্বা ইতিবাচক বক্তব্য দিয়েছিলেন। আমরা দেশ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করলেও তিনি অনেক আশাবাদী ছিলেন। কেন আশাবাদী সেটাও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ঘোরার পরিপ্রেক্ষিতে তুলে ধরেছিলেন। বেশ ভালো লেগেছিল সেই বক্তব্যটি।

গত কয়েক বছর আগে আমাদের ইসলামী লেখক ফোরামের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তিনি এসেছিলেন। সেখানেও তিনি লেখকদের উদ্বুদ্ধ করার মতো চমৎকার কথা বলেছিলেন। ফোরামের যেকোনো প্রয়োজনে তাঁকে স্মরণ করতে বলেছিলেন। তার সেদিনের উদারতায় সত্যিই আমরা বিমুগ্ধ হয়েছিলাম। এত শিক্ষিত ও জ্ঞানী একজন মানুষ, তবুও তার মধ্যে ছিল না কোনো অহংকার।

বিশেষ করে তিনি আলেম-উলামার সঙ্গে খুব ভালোভাবে মিশতেন। আলেমদের সঙ্গে সম্পর্কটা তিনি মূলত পারিবারিকভাবেই পেয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আ ন ম আব্দুল মান্নান খান ছিলেন তার বাবা। তিনি নিজেও মাদরাসায় পড়াশোনা করেছেন। এজন্য তিনি ইসলামবিষয়ক লেখালেখিতেই বেশি সাচ্ছন্দবোধ করতেন।

দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী দৈনিক প্রথম আলোতে প্রতি শুক্রবারে তিনি ধর্মীয় কলাম লিখতেন। অনেক বছর ধারাবাহিকভাবে তিনি ই লেখাটি লিখেছেন। রমজানে প্রতিদিন লিখতেন। তার লেখায় ভারসাম্য ছিল। ইসলাম বিষয়ে কোনো পক্ষ বা গোষ্ঠীকে আঘাত করে তিনি লিখতেন না।

কোনো গোষ্ঠী বা বলয়ের পক্ষে সূক্ষভাবে কলম ধরতেন না। কোনো পক্ষ অসন্তুষ্ট হতে পারে তার থেকে এমন কোনো লেখা চোখে পড়েনি। লেখায় ইসলামের মূল স্পিরিটটি তুলে ধরতেন দারুণভাবে। প্রথম আলো ছাড়াও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন। এছাড়া বিভিন্ন টেলিভিশনেও ধর্মীয় আলোচনায় অংশ নিতেন। কোনো কোনো অনুষ্ঠান সঞ্চালনাও করতেন।

ড. আব্দুল মুনিমের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায়। তিনি ঢাকা সরকারি আলিয়া থেকে কামেল পাস করার পর ঢাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন। ডক্টরেটও করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সবশেষ তিনি দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা (ইউনিক) উত্তরা, ঢাকার ফ্যাকাল্টি অব লিবারেল আর্টসের ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাস বিভাগের অ্যাডভাইজার ছিলেন।

এছাড়াও এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যাপনা করেছেন।

তিনি একাধারে একজন শিক্ষক, গবেষক, লেখক, আলোচক ও সমাজচিন্তক ছিলেন। একাত্তরের মার্চে তার জন্ম। সে হিসেবে বাংলাদেশের সমান বয়স তার। পঞ্চাশের কোটা স্পর্শ করার আগেই তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তার এ চলে যাওয়া যত কষ্টের আর আফসোসেরই হোক, তিনি আর আসবেন না এটা চিরন্তন সত্য। পৃথিবীর অমোঘ বিধান এটাই, যারা চলে যায় আর ফিরে আসে না। আমরা শুধু তার জন্য দোয়া করতে পারি, আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন।

*

*

Top