ঐক্যে প্রাপ্তি, অনৈক্যে বিনাশ অবশ্যম্ভাবী

জহির উদ্দিন বাবর
‘ঐক্য’ শব্দটি ছোট্ট হলেও এর শক্তি অনেক বেশি। ঐক্য থাকলে যেকোনো অসম্ভবকে যেমন সম্ভব করা যায় তেমনি অনৈক্যের কারণে অনেক সম্ভাবনাও কাজে আসে না। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম নেই যা ঐক্য ছাড়া সফল হয়েছে। ঐক্যে সামান্য চিড় ধরলেই অধিকার হারাতে হয়েছে-এমন ঘটনায় ইতিহাসের পাতা ভরপুর। জাতি, সমাজ, দেশ, গোষ্ঠী, পরিবার সবখানেই ঐক্যের দ্বারা সাফল্যের দেখা মিলে। আবার অনৈক্যের কারণে মুখোমুখি হতে হয় পতন ও সমূহ ক্ষতির। অধিকারহারা কোনো জাতি-গোষ্ঠী যখন অধিকার সচেতন হয় এবং তাদের মধ্যে ঐক্যের কোনো ভাটা না থাকে সে জাতি-গোষ্ঠীকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারে না। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্যায়ে অধিকার আদায়ের সব আন্দোলন সফল হয়েছে ঐক্যের কারণে। আবার অনৈক্যের কারণে অনেক প্রাপ্তি থেকেও আমরা বঞ্চিত হয়েছি বারবার। জাতিগতভাবে আমাদের যে জায়গাটিতে পৌঁছার কথা ছিল সেখানে পৌঁছতে না পারার একমাত্র কারণ অনৈক্য।

পারস্পরিক ঐক্য ও বিভক্তি মুসলিম জাতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। হজরত আবু মুসা আশআরি রা বলেন, রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: ‘এক মুমিন অন্য মুমিনের জন্য দেয়াল স্বরূপ। এর এক অংশ অপর অংশকে শক্তিমান করে।’ এ কথা বলার সময় তিনি (নবীজি) এক হাতের আঙ্গুলি অন্য হাতের আঙ্গুলির ফাঁকে ঢুকিয়ে দেখান। [বুখারি ও মুসলিম]

সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি রহ. বায়তুল মুকাদ্দাস পুনরুদ্ধারের জন্য ওই সময় চূড়ান্ত বিজয়ের প্রস্তুতি নেন, যখন মুসলমানদের পারস্পরিক বন্ধন সুদৃঢ় হয় এবং নেতৃস্থানীয় মুসলিমরা একই প্ল¬াটফর্মে জড়ো হন। ইতিহাসের ঘটনাবলি বিশ্লে¬¬ষণ করলে একথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যতক্ষণ মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির সুদৃঢ় বন্ধন, পারস্পরিক সহযোগিতাবোধ কাজ না করেছে ততক্ষণ তারা কোনো একটি যুদ্ধেও জয়লাভ করতে পারেনি। মুসলমানরা যখন প্রত্যেকেই নিজস্ব মত-পথ ও চিন্তাধারায় খেয়ালি বিচরণ করে; নিজেদের মধ্যে সৃষ্ট মতপার্থক্য শত্রুতার রূপ নেয়; তখন সফলতার আর কোনো প্রচেষ্টাই কাজে আসে না। তখন সবক্ষেত্রে মুসলমানদের হতে হয় অপদস্থ। পরাজয়ের গ্ল¬ানি ছাড়া তাদের ভাগ্যে আর কিছুই তখন জুটে না।

দুনিয়াতে আজ মুসলামানদের রয়েছে বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠী। পৃথিবীর এক চতুর্থাংশ তাদের। তবু দুনিয়ার অন্যান্য শক্তির কাছে তারা আজ নত। মুসলমানরা আজ লাঞ্ছিত ও নিষ্পেষিত হচ্ছে দেশে দেশে। তাদের দেখে বিদ্রুপের হাসি হাসছে বাতিল শক্তি। কিন্তু মুসলমানদের এই অবস্থা হলো কেন? এর একমাত্র কারণ মুসলিম উম্মাহর ভেতরে ঢুকে গেছে অনৈক্যের বীজ। মুসলিম বিশ্ব আজ শতধা বিভক্ত। তাদের খ- খ- শক্তি নির্জীব হয়ে আছে। প্রত্যেকে তাদের নিজস্ব মতের পূজায় লিপ্ত। ফলে কোনো ঐক্যচেষ্টাই সাফল্যের মুখ দেখছে না।

আফসোস ও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, আমরা দিন দিন ভাঙা ও ধ্বংসের দিকে এগুচ্ছি; অথচ স্থাপন ও গড়ার অলিক স্বপ্ন দেখছি। যখন শত্রুরা সবাই ঐক্যবদ্ধ; চলছে ইসলাম নির্মূলের সম্মিলিত প্রয়াস; বাতিল চক্র নিজেদের লক্ষ্য অর্জনে এগোচ্ছে দৃঢ়গতিতে, তখন মুসলমানরা আত্মকলহে লিপ্ত। হালকা এবং সাধারণ জিনিসকে কেন্দ্র করে চলছে অঘোষিত লড়াই। অথচ মুসলমান পরস্পরে ভাই ভাই। সে হিসেবে পারস্পরিক সম্পর্ক হওয়া উচিত ছিল ভ্রাতৃত্বের, সম্প্রীতি ও মাধুর্যের। প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নয়। কে কাজ করলেন এর চেয়ে দেখা উচিত কী কাজ করেছেন। ভালো কাজ হলে এর স্বীকৃতি দেওয়া, ব্যক্তি যে কেউই হোক। ইসলাম ও গঠনমূলক সামাজিক কাজের প্রতি সর্বাত্মক সহযোগিতা জরুরি। কিন্তু যখন কাজের চেয়ে কর্তা বেশি গুরুত্ব পায়; প্রত্যেক কাজকে নিজের অবদান মনে করা হয় এবং খ্যাতির আশা থাকে, তখনই ঘটে বিপত্তি।

বর্তমানে আমাদের অভ্যাস হলো, শুধু অন্যের দোষ-ত্রুটিই দেখি। অন্যের ভুলগুলো প্রকাশ করেই শান্তি পাই। নিজের ভুল কিছুই ধরা পড়ে না আমাদের রঙিন চশমায়। নিজের মধ্যে হাজার দোষ থাকার পরও অন্যের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে মজা পাই। নিজেরটি একমাত্র কাজ; অপরেরটি কিছুই না; এই ধারণা পোষণ করি আমরা। আমাদের ভাবসাব এমন যেন ইসলামের রক্ষক একমাত্র আমরাই। আমি থাকলে ইসলাম আছে, আমি না থাকলে ইসলাম নেই। নিজের মনমতো যাকে খুশি ইসলাম থেকে খারিজ করে দিচ্ছি, যাকে খুশি ইসলামে ঢোকাচ্ছি। এমনকি জান্নাত-জাহান্নামের ঠিকাদারিও যেন আল্লাহ আমাদের হাতে দিয়ে দিয়েছেন! আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে সেটা আরেকটু বেশি হচ্ছে।

বর্তমানে আমাদের মধ্যে মূল সমস্যা হচ্ছে আদর্শের সংকট। আমরা কাকে আদর্শ মানবো, কোন পথ ধরে এগিয়ে চলবো সেটা এখনও নির্ণয় করতে পারিনি। আমাদের কাজগুলো কুরআন-হাদিস নির্দেশিত পন্থায় হচ্ছে না। অথচ আমরা মিথ্যা অভিনয় করেই যাচ্ছি। ইসলামের কৃত্রিম কান্ডারি সেজে নিজেরাই ক্ষতি করে চলেছি ইসলাম ও মানবতার। আমাদের উদ্দেশ্য কখনও খ্যাতি ও নেতৃত্ব, কখনও নিজের দল ও মতের শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য, আবার কখনও নিজের জ্ঞান বা বুদ্ধির বিকাশ। অথচ আমরা নিজেদের ভাবছি পুঁত-পবিত্র! আর অন্যদের মনে করছি ভ্রষ্ট ও বিপথগামী! এটি সরাসরি ইসলামের সঙ্গে প্রতারণা। নিছক ব্যক্তিস্বার্থে ইসলামের অপব্যবহার। মুমিনদের রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তুলনা করেছেন একটি দেহের সঙ্গে। এক অঙ্গের অসুস্থতায় পুরো দেহই যেমন কাতর হয়ে পড়ে, ঠিক পৃথিবীর এক অঞ্চলের একজন মুসলমানের ব্যথাও অনুভব করতে হবে অন্য সব অঞ্চলের মুসলমানদের। তখনই এই ভ্রাতৃত্বের মর্যাদা রক্ষা হবে। হাদিস শরিফের ভাষ্য-তুমি মুমিনদের দেখবে- তারা পারস্পরিক দয়া-ভালোবাসা আর মায়া-স্নেহের বিষয়ে একটি দেহের মতো। দেহের এক অঙ্গ যখন আক্রান্ত হয়, তখন পুরো শরীরই অনিদ্রা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। [বুখারি] আল্ল¬াহ তায়ালাও নির্দেশ করেছেন মুসলমানদের সঙ্গে সদাচরণ করতে। এমনকি অমুসলিমদের সঙ্গেও ভালো ব্যবহার করতে বলেছেন। আল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা পবিত্র মসজিদ থেকে তোমাদের বাধা দিয়েছিল সেই সম্প্রদায়ের শত্রুতা যেন তোমাদেরকে সীমালঙ্ঘনে প্ররোচিত না করে। সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।’ [সুরা মায়েদা-২] এই আসমানি বার্তাই প্রমাণ করে ইসলাম একটি উদার, সহনশীল ও সার্বজনীন সম্প্রীতির ধর্ম। বিবেদ ও সংঘাতের এখানে কোনো স্থান নেই।

বর্তমানে আমরা নিজেদের মধ্যে অনৈক্যের কারণে কত অধিকার থেকে যে বঞ্চিত হচ্ছি এর কোনো হিসাব নেই। অনৈক্যের এই প্রবণতা দূর করতে হলে ব্যক্তিস্বার্থ থেকে ইসলামের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। অপরের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে মন্তব্য করা চলবে না। নিজে গঠনমূলক কাজ করতে হবে, অন্যের বিচ্যুতির পেছনে লেগে অহেতুক সময় নষ্ট করা যাবে না। যেসব জিনিস বিবেদ বা সংঘাত সৃষ্টি করতে পারে তা থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। সব সময় সহযোগিতামূলক মনোভাব পোষণ করতে হবে। এতে প্রতিষ্ঠিত হবে পারস্পরিক ঐক্য ও সংহতি। আর তখনই আমরা ফিরে পাবো নিজেদের অধিকার ও মর্যাদা। অন্যথায় কপালের দুর্গতি কোনোভাবেই ঠেকানো যাবে না।

লেখক: যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, ঢাকা মেইল; সম্পাদক, লেখকপত্র

*

*

Top