ওপারেও ভালো থেকো তাজুল

Tazul Zahirbaborতাজুল আমার সহকর্মী ও বন্ধু। ১০ নভেম্বর সোমবার বিকেলে চলে গেছে না ফেরার দেশে। তার চলে যাওয়াটা আকস্মিক না হলেও মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। প্রায় দুই বছর ধরে ক্লোন ক্যানসারে ভুগছিল তাজুল। ধুকে ধুকে সে যে মৃত্যুর মুখে চলে যাচ্ছিল তা বছরখানেক আগেই টের পাওয়া গেছে।  তবে অনেক ক্যানসার রোগী স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার নজির আছে। তাজুলের ক্ষেত্রেও ধারণা ছিল তেমনটাই। সাধ্যমতো চিকিৎসার কোনো ত্রুটি করেননি তার মা-বাবা। একমাত্র ছেলের চিকিৎসায় সর্বস্ব বিলীন করে তারা চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে স্রষ্টার অমোঘ নীতির কাছে। পৃথিবীর সব চলে যাওয়াই কষ্টের। তবে মায়াময় এই পৃথিবীর রূপ-রসে সিক্ত হওয়ার আগেই ২৫/২৬ বছরের একজন যুবকের চলে যাওয়া সহজে মেনে নেয়ার মতো নয়। কিন্তু মানুষের জীবন তো এই ঠুনকো ভিতের ওপরই দাঁড়িয়ে। আর এই জীবন নিয়েই তো আমরা কত বড়াই-অহমিকা করি।

তাজুলের সঙ্গে আমার পরিচয় ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময়ে। সেন্টার ফর মিডিয়া রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিংয়ে (এমআরটি) সাংবাদিকতা কোর্স করার সময়। এমআরটির চতুর্থ ব্যাচে আমরা ছিলাম প্রায় ৩৫ জন। বেশির ভাগই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাজুল আর জিয়া হক ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। তারা দুজন খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। জিয়া স্বল্পভাষী ও ভাবুক প্রকৃতির হলেও তাজুল ছিল উচ্ছ্বল, আমুদে প্রকৃতির। প্রথম দিনের পরিচয় থেকে তাকে সবসময়ই হাসিমুখে দেখেছি। তার কথায় ছিল চুটকি, মাতিয়ে রাখতে পারতো বেশ। এমআরটির ক্লাসের ফাঁকে যারা বিনোদনে সবাইকে মাতিয়ে রাখতো তাদের একজন ছিল তাজুল। ওই সময়ই তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কটাও গাঢ় হয়ে যায়। আমাদের চায়ের আড্ডায় প্রায়ই যোগ দিতো তাজুল।

এমআরটি কোর্স শেষে আমরা ১০ জন নির্বাচিত হলাম ইন্টার্নশিপের জন্য। একটি দৈনিকে আমাদের ইন্টার্নি। তাজুলও ছিল সেই ১০ জনের মধ্যে। প্রতিদিন বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে আসতো তাজুল আর জিয়া। আমি আর মাসউদুল কাদির যেতাম একসঙ্গে। তাদের সঙ্গে প্রায়ই দীর্ঘ আড্ডা হতো, কথা হতো নানা বিষয়ে। তাজুল কবিতাও লিখতো। পড়াশোনার পরিধিও ছিল বেশ বিস্তৃত। সমাজ ও রাজনীতি নিয়েও তার পর্যবেক্ষণ ছিল আলাদা।

ইন্টার্নশিপ শেষে আমি বার্তা টুয়েন্টিফোরে যোগ দিই। আর তাজুল পুরানা পল্টনে একটি নিউজ পোর্টালে কাজ করতো। পুরানা পল্টনে আমার অবস্থান হওয়ায় প্রায়ই বিকেলে তাজুলের সঙ্গে দেখা হতো। অখ্যাত একটি নিউজপোর্টালে স্বল্প বেতনের  চাকরিটি ছিল নিছক অভিজ্ঞতার জন্য। পল্টনের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে চায়ের আড্ডায় তাজুল প্রায়ই বলতো একটি ভালো মিডিয়া কাজের ইচ্ছার কথা। তাজুলের স্বপ্ন ছিল ভালো একজন সাংবাদিক হওয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগে পড়লেও গণমাধ্যম ছিল তার আকর্ষণের জায়গা।

আমার যোগদানের কয়েক মাস পর তাজুলও যোগ দেয় বার্তা টুয়েন্টিফোরে। সেটি ২০১১ সালের শেষ দিকের কথা। তখন থেকে তাজুল আমার সহকর্মী। পাশাপাশি ডেস্কে বসে আমরা কাজ করতাম। সেই সময়কার তুমুল জনপ্রিয় নিউজপোর্টালটিতে আমরা যে কয়জন কাজ করতাম তাদের মধ্যে বোঝাপড়াটা ছিল চমৎকার। নিউজরুমের পরিবেশটাও ছিল অসাধারণ। সবার মধ্যে একটি অন্যরকম হৃদ্যতা ছিল। নিউজের বাইরে দেশ, সমাজ, রাজনীতিসহ নানা বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক চলতো। এসব ক্ষেত্রে তাজুলের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। বিভিন্ন বিষয়ে স্রোতের বাইরে গিয়ে কথা বলে আড্ডাকে মাতিয়ে রাখতে পারতো সে। তাজুল ক্যাম্পাসে থাকলেও ক্যাম্পাসের খাবার খেতে পারতো না। সে নিজেই পাক করতো। অফিসেও নিয়ে আসতো খাবার। মাঝে মাঝে আমরাও ভাগ বসাতাম তার খাবারে।

বার্তা টুয়েন্টিফোর বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর অগোছালো অবস্থায় সম্পাদক সরদার ফরিদ আহমদের নেতৃত্বে আমরা পুরো টিম শুরু করি নতুন বার্তা ডটকম। অফিস প্রস্তুত না হওয়ায় মাসখানেক আমাদেরকে বিভিন্ন স্থানে অফিস করতে হয়েছে। সেগুনবাগিচার একটি প্রকাশনী অফিসে কয়েক দিন কাজ করার পর আমরা নতুন বারডেমের বিপরীতে ফরিদ ভাইয়ের ১১ তলার বাসায় অফিস করি। লিফটের কাজ তখনও শেষ হয়নি। হেঁটেই উঠতে হতো। অন্যরকম সেই সংগ্রামে আমাদের সহযাত্রী ছিল তাজুল। সে তার ল্যাপটপটি নিয়ে প্রতিদিন সময়মতো হাজির হয়ে যেতো।

কারওয়ানবাজারে নতুন বার্তা অফিস চালুর পরও তাজুল আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। সম্ভবত ২০১২ সালের নভেম্বর মাস। নতুন অফিসে যোগদানের কয়েক দিনের মধ্যেই তাজুল বাড়ি যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠল। এমনকি চাকরি ছেড়ে হলেও সে বাড়িতে যাবে বলে আমাদেরকে আলটিমেটাম দেয়। ফরিদ ভাইয়ের কাছ থেকে ছুটি নিয়েই তাজুল বাড়ি যায়। কয়েক দিন পর কাঁপা কাঁপা গলায় ফোন করে জানায় প্রাথমিক পরীক্ষায় জানা গেছে, তার ক্যানসার হয়েছে। ভয়ানক এই খবরটি আমাদের ভাবিয়ে তোলে। সহকর্মীরা সবাই তাজুলের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হন।

২০১২ সালের ডিসেম্বর থেকে নিয়ে ২০১৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ২৩ মাস তাজুল ক্যানসারের সঙ্গে বসবাস করেছে। তার প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে আশা-নিরাশার দোলাচলে। মাঝে মাঝেই তার ফেসবুকে আশাবাদী স্ট্যাটাস দেখেছি; আবার কখনও কখনও দেখেছি হতাশাজনক স্ট্যাটাস। অবর্ণনীয় কষ্টের কেমোথ্যারাপির ছবিও মাঝে মাঝে পোস্ট করতে দেখেছি। তাজুলের কষ্ট দেখে খুবই খারাপ লাগতো। কিন্তু কিছুই করার ছিল না আমাদের। চিকিৎসার সব কোর্সই সে সম্পন্ন করেছে। চিকিৎসক বাবা আর গৃহিনী মা তাদের একমাত্র ছেলের জন্য সবটুকু বিলিয়ে দিয়ে শেষ চেষ্টাটুকু চালিয়েছেন। কিন্তু কোনো চেষ্টাই শেষ পর্যন্ত কাজে আসেনি। সবাইকে কাঁদিয়ে অবশেষে চলেই গেল তাজুল। ওপারেও তাজুল ভালো থাকুক-সে প্রত্যাশা আমাদের সবার।

*

*

Top