কাতার সংকট: মুসলিম উম্মাহর দুর্ভাগ্যের করুণ চিত্র

জহির উদ্দিন বাবর
Qatar_zahirbaborমধ্যপ্রাচ্যের ছোট্ট অথচ অন্যতম ধনী দেশ কাতার। সম্প্রতি সৌদি আরবের নেতৃত্বে ৯টি দেশ কাতারের প্রতি অবরোধ আরোপ করেছে। দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। কাতারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠনগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করে। তবে সৌদি আরব ও তার মিত্রদের চোখে হামাস ও ইখওয়ানুল মুসলিমিন সন্ত্রাসী সংগঠন হলেও সাধারণ মুসলিমরা তাদেরকে সন্ত্রাসী সংগঠন মনে করে না। নিজেদের অধিকার আদায়ে বিপ্লবী সংগঠন হিসেবেই জানে। সুযোগ থাকলে সব মুসলমানই তাদের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।

কাতার অবরোধের পেছনে মূলত সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের বৈরী সম্পর্কের বিষয়টি কাজ করেছে। বরাবরই ইরান-সৌদি আরবের মধ্যে তুমুল বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজ করে। ইরানের বিশেষ আনুকূল্য পেয়ে থাকে কাতার। এজন্য কাতারের প্রতি সৌদি আরবের এই শ্যেনদৃষ্টি।

এ পর্যন্ত কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে ৯টি দেশ। এগুলো হচ্ছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিসর, ইয়েমেনের সৌদি অনুগত সরকার, লিবিয়ার একাংশের সরকার, মালদ্বীপ, মৌরিতানিয়া ও সেনেগাল। এর মধ্যে কয়েকটি দেশে কার্যকর সরকার নেই। অবশ্য সৌদি আরবের এসব পদক্ষেপে নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। অপর দিকে, সরাসরি কাতারের পাশে দাঁড়িয়েছে ইরান ও তুরস্ক। অন্য প্রভাবশালী মুসলিম দেশগুলো এ ধরনের আহ্বানে সাড়া দেয়নি। কাতারকে বিচ্ছিন্ন করার এই প্রচেষ্টা সমর্থন করেনি ইরাক। দেশটি বলছে- সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমন কাজ সমর্থন করে না দেশটি।

সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন দেশগুলো ধারণা করেছিল কাতারের ওপর অবরোধ আরোপের ফলে দেশটি খাদ্য সংকটে পড়বে এবং ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এর ফলে শেষ পর্যন্ত কাতার দাবি মেনে নিয়ে সৌদি আনুগত্য স্বীকার করে নেবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে কাতার সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে- দেশটিতে খাদ্য সংকটের কোনো আশঙ্কা নেই। ইরান ও তুরস্ক থেকে যেমন খাদ্য পাঠানো হচ্ছে, তেমনি জিসিসির আরেক সদস্য ওমান থেকে নৌপথে খাদ্যের জাহাজ কাতারে যাচ্ছে। সর্বশেষ মরক্কো ঘোষণা দিয়েছে দেশটি কাতারে খাদ্য পাঠাবে। অপরদিকে, ফিফার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে এখন পর্যন্ত কাতারে বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন সম্ভব হবে না এমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।

কাতারের ওপর অবরোধ নিয়ে সৌদি আরবের জন্য সবচেয়ে হতাশাজনক দিক হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৫ জুন অবরোধ আরোপের পর টুইট করে এই অবরোধকে সন্ত্রাসবাদ দমনে তার বিশাল সাফল্য হিসেবে দাবি করলেও এখন পর্যন্ত তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সে পথে হাঁটেননি। ট্রাম্পের সাথে পেন্টাগনের অবস্থানেরও যথেষ্ট পার্থক্য ছিল। সর্বশেষ মার্কিন জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ জানিয়েছেন কাতারের সাথে আরব দেশগুলোর এই বিরোধে মিলিটারি অপারেশনের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিম ম্যাটিস বলেছেন, কাতারের ওপর অবরোধ আরোপের এই ঘটনা জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। সবাই মিলে এক সাথে বসে এর সমাধান করা উচিত।
সর্বশেষ কাতারের সঙ্গে সম্পর্কিত ৫৯ জন ব্যক্তি ও ১২টি সংস্থাকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে তালিকা প্রকাশ করেছে সৌদি জোট। এ নিয়েও রয়েছে নানা কথা। তালিকায় ১৯ নম্বরে থাকা ব্যক্তি আল্লামা ইউসুফ আলকারজাভি। আড়াই মাস আগেও তিনি সৌদি আরবে সম্মানিত অতিথি হিসেবে মক্কায় এক সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন, সৌদি গ্র্যান্ড মুফতির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। মরহুম বাদশাহ আবদুল্লাহর কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন সৌদি আরবের সর্বোচ্চ পুরস্কার বাদশাহ ফয়সাল পদক। এ ছাড়া আরব আমিরাতের মাকতুম শাসক পরিবারের দেওয়া সম্মাননা এবং এক মিলিয়ন দিরহামের পুরস্কারও পেয়েছেন কারজাভি। সারা বিশ্বে কারজাভিকে একজন শ্রেষ্ঠ আলেম হিসেবে জানে।

কাতার একটি ছোট্ট দেশ। আয়তন মাত্র ১১ হাজার বর্গকিলোমিটার। লোকসংখ্যা ২০ লাখ। এর মধ্যে ১৮ লাখ বিদেশি। অফুরন্ত ধনঐশ্বর্য রয়েছে তার। ‘গ্লোবাল ফাইন্যাস ম্যাগাজিন’ এবারও কাতারকে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশের টাইটেল দিয়েছে। তরল গ্যাস আর তেল রফতানি করে বিশ্ববাজারে। আলজাজিরা টেলিভিশন আর কাতার এয়ার ওয়েজের জন্য এ ক্ষুদ্র দেশটাকে বিশ্বের সবাই চেনে। দেশ ছোট্ট হলেও কাতার সক্ষমতা ও সামর্থ্যের দিক থেকে অনেক এগিয়ে। তাছাড়া যেভাবে কাতার তার পাশে কয়েকটি শক্তিশালী মুসলিম দেশকে পেয়েছে তাতে কাতারকে সহজেই দমানো সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।

দুই
মূলত কাতারের ওপর এই অবরোধ মুসলিম বিশ্বের জন্য দুর্ভাগ্যের করুণ চিত্র। পবিত্র রমজানে যেখানে এক মুসলমান আরেক মুসলমানের সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে সেখানে একটি মুসলিম দেশের খাদ্য সরবাহ বন্ধ করে দেয়া কোনো মুসলিম শাসকের জন্য সমীচীন হতে পারে না। মূলত এটা মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম শাসকদের মধ্যে উম্মাহচিন্তা না থাকার বিষয়টি প্রমাণ করে। তারা মুসলিম উম্মাহর সমৃদ্ধি ও এগিয়ে চলার ভাবনার পরিবর্তে নিজেদের শাসনক্ষমতা সুসংহত করার দিকেই বেশি মনোযোগী।

সম্ভাবনার আরব রাষ্ট্রগুলোর শাসকদের ইসলাম ও মুসলমানদের নিয়ে কোনো ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। তাদের ব্যক্তিজীবনে নেই ইসলামের তেমন কোনো বালাই। নিজেদের অন্তরমহলে নানা অপকর্মে লিপ্ত থাকেন বলে জনশ্রুতি আছে। পশ্চিমা কৃষ্টি-কালচারও ইতিমধ্যে আরবের অনেক দেশে স্থান করে নিয়েছে। শাসকেরা নিজেদের সুরক্ষার জন্য জনগণের ওপর নিপীড়নের খড়গ সবসময় চালু রাখেন। বিশ্বের নানা প্রান্তে মুসলমানরা নির্যাতিত-নিপীড়িত হলেও তাদের মুখে ‘টু’ শব্দ বের হয় না। ফিলিস্তিনের গাজাসহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে মুসলমানদের রক্ত ঝরলেও তাদের সরব কোনো প্রতিবাদ চোখে পড়ে না। এমনকি ইসলাম ও মুসলমানদের চিরশত্রু ইসরাইল ও ইহুদিদের সঙ্গে কোনো কোনো আরব শাসকের সম্পর্ক আছে বলেও জানা যায়। মুসলিম উম্মাহর জন্য এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় আর কী আছে।

আরব শাসকেরা পরস্পরকে উৎখাতের জন্য পশ্চিমাদের সহযোগিতায় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার প্রমাণও ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে। মুসলিম উম্মাহর স্বার্থ দেখবে সত্যিকারের এমন কোনো সংগঠন বা সংস্থারও কোনো অস্তিত্ব নেই। ওআইসি ও আরব লিগ নামক দুটি অকার্যকর, অথর্ব প্রতিষ্ঠান রয়েছে মুসলমানদের। এ পর্যন্ত সংস্থা দুটি মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে জোরালো কোনো ভূমিকা পালন করেছে এমন নজির পাওয়া যায় না। এজন্য আজ এই দুটি সংস্থার অস্তিত্ব আদৌ প্রয়োজন আছে কি-না সে সম্পর্কে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অথচ কাতার সংকটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারতো এই দুটি সংস্থা। মুসলিম শাসকদের মধ্যে যতদিন উম্মাহচিন্তা না জাগবে, স্বকীয়তার বোধোদয় না হবে ততদিন এ জাতির কপালে দুর্ভাগ্যজনক ট্রাজেডি আসতেই থাকবে।

Related posts

*

*

Top