কাশ্মীরিদের স্বাধীনতা আন্দোলন আরও বেগবান হবে

তারা এই বলে কান্নাকাটি করছেন যে, আমাদের ধোঁকা দেয়া হয়েছে। নিজেদের মজলুম প্রমাণিত করার জন্য তারা চোখের অশ্রু ঝরাচ্ছেন। কিন্তু এই অশ্রুর পেছনে ধোঁকার এক দীর্ঘ বহর লুকিয়ে আছে। আর সেই ধোঁকা লোক-দেখানো অশ্রু ঝরানো ব্যক্তিরা স্বজাতির সঙ্গে করেছেন। তারা হলেন ফারুক আবদুল্লাহ ও তার ছেলে ওমর আবদুল্লাহ। তারা এই প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন যে, কাশ্মিরীদের সঙ্গে জুলুম করা হয়েছে।

প্রকৃত সত্য হলো, বেশির ভাগ কাশ্মিরী কখনও ৩৭০ ধারাকে স্বীকারই করেনি। কারণ এই দফার দ্বারা ফারুক আবদুল্লাহর বাবা শেখ মুহাম্মদ আবদুল্লাহ অধিকৃত কাশ্মীর আর ভারতের মধ্যে একটি ‘অবৈধ’ সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল নিজের শাসন পাকাপোক্ত করা। ৩৭০ ধারা মূলত ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু এবং শেখ আবদুল্লাহর মধ্যে একটি চুক্তি। শেখ আবদুল্লাহ কাশ্মিরীদের সন্তুষ্ট রাখতে ৩৫ ধারাকেও আইনে যুক্ত করান এবং বাইরের লোকদের জন্য কাশ্মীরে জমি কেনার পথ বন্ধ করেন।

 ৩৭০ ও ৩৫ ধারার বিলুপ্তি মূলত ভারতের পক্ষ থেকে ওই কাশ্মীরিদের জন্য ধোঁকা যারা ভারতের আশ্বাসের ওপর ভরসা করে স্বজাতির সঙ্গে গাদ্দারি করেছিলেন। শেখ মুহাম্মদ আবদুল্লাহকে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ স্বজাতির সঙ্গে ধোঁকাবাজি না করতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি কায়েদে আজমের কথা শুনেননি। তিনি বরং নেহেরুর সঙ্গে মিলে কাশ্মীরিদের ভারতের গোলাম বানিয়ে রাখেন। ইতিহাস কায়েদে আজমকে বারবার সত্য এবং শেখ আবদুল্লাহকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে।

আজ যখন ভারত সরকার নিজেদের মিথ্যা ও ধোঁকাবাজ প্রমাণ করে দিলো তখন শেখ মুহাম্মদ আবদুল্লাহ এবং তার পরিবারের আসল চরিত্র তুলে ধরা জরুরি। কারণ এই পরিবার শুধু কাশ্মীরিদেরই নয় পাকিস্তানকেও ধোঁকা দিয়েছে।

 শেখ মুহাম্মদ আবদুল্লাহ তার আত্মজীবনীতে আল্লামা ইকবালের সঙ্গে নিজের সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করেছেন কিন্তু কায়েদে আজমের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা এড়িয়ে গেছেন। এটি একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা যে, কাশ্মীরিদের বর্তমান যে স্বাধীনতা আন্দোলন এর নিয়মতান্ত্রিক সূচনা করেছিলেন আল্লামা ইকবাল ১৯৩১ সালে। ওই বছরের ১৩ জুলাই শ্রীনগরে মুসলমানদের শহীদ হওয়ার প্রতিবাদে পরদিন ১৪ আগস্ট যে সভা অনুষ্ঠিত হয় সেটা ছিল আল্লামা ইকবালের নেতৃত্ব। সেই সভায় তিনি কাশ্মীরিদের স্বাধীনতার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৩২ সালে অল জম্মু-কাশ্মীর মুসলিম কনফারেন্স প্রতিষ্ঠিত হয়। যারা মূল উদ্দেশ্য ছিল শাসক গোষ্ঠীর মুখোশ উন্মোচন করে দিয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা।

এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, ১৯৩৩ সালে শেখ আবদুল্লাহ আকবর জাহান নামে এক ব্রিটিশ নারীকে বিয়ে করেন। আকবার জাহান ছিলেন এক ব্রিটিশ গোয়েন্দার সাবেক স্ত্রী। তার বাবা হ্যারি নিডোজ লাহোর ও শ্রীনগরের ‘নিডোজ হোটেলের’ মালিক ছিলেন। লাহোরে ‘নিডোজ’ হোটেলের জায়গায় এখন ‘আওয়ারি হোটেল’ হয়েছে। সেই হোটেলে টিআই লার্নস এসে থাকতেন এবং করম শাহর পক্ষ নিয়ে আফগানিস্তানের তৎকালীন শাসক আমানুল্লাহ খানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতেন। সেখানেই আকবর জাহানের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ এবং বিয়ে হয়। কলকাতার একটি পত্রিকায় যখন তার ষড়যন্ত্রের খবর ফলাও করে প্রচার করা হয় তখন ওই ব্রিটিশ গোয়েন্দা পাকিস্তান ছেড়ে চলে যান। তিনি পাকিস্তান ছাড়ার পরপরই আকবার জাহান তাকে তালাক দিয়ে শেখ আবদুল্লাহকে বিয়ে করেন।

ব্রিটিশ ওই নারীকে বিয়ে করার পরপর শেখ আবদুল্লাহর চিন্তাধারা পাল্টে যায়। ১৯৩৯ সালে তিনি মুসলিম কনফারেন্স ছেড়ে প্রতিষ্ঠা করেন ন্যাশনাল কনফারেন্স। ১৯৪৪ সালে কায়েদে আজম শ্রীনগরে গেলে মুসলিম কনফারেন্স তার সম্মানে সংবর্ধনার আয়োজন করে। শেখ আবদুল্লাহ তখন কায়েদে আজমকে ন্যাশনাল কনফারেন্সের পক্ষ থেকেও সংবর্ধনা গ্রহণের দাওয়াত দেন। কায়েদে আজম উভয়ের দাওয়াতই গ্রহণ করেন।

ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তখন কায়েদে আজম শেখ আবদুল্লাহকে আহ্বান জানান, তিনি যেন কংগ্রেস ত্যাগ করেন এবং পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দেন। কে এইচ খোরশেদের একটি সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, কায়েদে আজম শেখ আবদুল্লাহকে বলেন, ‘ফিরে আসুন এবং মুসলিম কনফারেন্সের নেতৃত্ব দিন।’ এই পরামর্শ শুনে শেখ আবদুল্লাহ চিৎকার দিয়ে উঠলেন এবং বললেন, ‘বাইরের লোকদের কাশ্মীরের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে নাক গলানোর কোনো অধিকার নেই। মিস্টার জিন্নাহর উচিত কাশ্মীর থেকে চলে যাওয়া।’

যখন পাকিস্তান হয়ে গেল তখন কায়েদে আজম শেখ আবদুল্লাহর কাছে ডা. মুহাম্মদ দীন তাসির এবং সরদার শওকত হায়াতসহ কয়েকজনের একটি প্রতিনিধি দল পাঠালেন। কিন্তু শেখ আবদুল্লাহ তাদের সঙ্গে বেয়াদবিমূলক আচরণ করে তাদের বিদায় করেন। এমনকি সরদার শওকত হায়াতকে গ্রেফতারের হুমকিও দেন। যখন মহারাজা হরি সিং ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরকে সংযুক্ত করতে তথাকথিত চুক্তি করে বসেন তখন শেখ আবদুল্লাহর অবস্থান অনেকটা দুর্বল হয়ে যায়। এ সময় তিনি নেহেরুর সঙ্গে আঁতাত করে কৌশলে কাশ্মীরের শাসনক্ষমতা দখল করেন। তিনি নিজের শাসন টিকিয়ে রাখতে নেহেরুকে এই বলে প্রভাবিত করতেন যে, আমার সঙ্গে পাকিস্তান সরকার যোগাযোগ করছে। ১৯৫২ সালে তিনি নেহেরুর সঙ্গে দিল্লি চুক্তিতে সই করেন। সেখানে ভারতীয় সংবিধানে ৩৭০ ধারা যুক্ত করে জম্মু-কাশ্মীর আলাদা প্রদেশের মর্যাদা পায়।

কিন্তু পরবর্তী সময়ে নেহেরুর কাছে শেখ আবদুল্লাহ আরও বেশি অধিকার দাবি করেন। তখন নেহেরু তাকে কারাগারে পাঠান। কারাগার থেকে শেখ আবদুল্লাহ পাকিস্তান সরকারের কাছে একটি পত্র লিখেন। তাতে তিনি লিখেন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীর ইস্যুটি উত্থাপন করলে তিনি পাকিস্তানের পক্ষে মত দেবেন। এই ‘ব্ল্যাকমেইলিংয়ের’ কারণে ১৯৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে তাকে মুক্তি দেয়া হয়।

কিন্তু এপ্রিল মাসে আবার গ্রেফতার করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দেয়া হয়। সেই মামলায় চার পাকিস্তানিকেও আসামি করা হয়।

শেখ আবদুল্লাহ ভারতকে পাকিস্তানের নামে ব্ল্যাকমেইল করেন এবং কাশ্মীরিদের কাছে হিরো হয়ে যান। ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে একটি চুক্তির পর পুনরায় তিনি কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সালে তার ইন্তেকালের পর ছেলে ফারুক আবদুল্লাহ কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী হন। ফারুক আবদুল্লাহও এক ব্রিটিশ নারীকে বিয়ে করেন। ফারুক আবদুল্লাহর পর তার ছেলে ওমর আবদুল্লাহ কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী হন।

এই পরিবার আজ অশ্রু ঝরাচ্ছে এই কষ্টে যে, ভারত সরকার তাদের ধোঁকা দিয়েছে। প্রকৃত সত্য হলো, এই পরিবার সাধারণ কাশ্মীরিদের সঙ্গে ধোঁকাবাজি করেছে। ১৯৪৭ সালে শেখ আবদুল্লাহ নেহেরুকে সমর্থন না দিলে আজ কাশ্মীর স্বাধীন থাকত। সময় ও অবস্থা দ্বারা এটা প্রমাণিত, সাইয়েদ আলি গিলানি, ইয়াসিন মুলক, মির ওয়ায়েজ ওমর ফারুক, আছিয়া আন্দারাবি, শিব্বির শাহসহ অন্যান্য স্বাধীনচেতা নেতারা সঠিক ছিলেন। আর ফারুক আবদুল্লাহর মতো লোকেরা ছিলেন ভুল। যারা আজও ভারতীয় আইনের প্রতি গদগদ। ফারুক আবদুল্লাহর অপদস্থতা মূলত ‘ভারতপ্রেমী’ কাশ্মীরিদের অপদস্থতা। ৩৭০ ধারার বিলুপ্তি মূলত কাশ্মীরের চলমান স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরও বেগবান করবে এবং ভারতের শাসনকে করবে দুর্বল। আর মোদি ভারতের ‘ভেজা বেড়াল’ প্রমাণিত হবেন।

হামিদ মির: পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক

(৮ আগস্ট দৈনিক জংয়ে প্রকাশিত কলামটি উর্দু থেকে অনুবাদ করেছেন: জহির উদ্দিন বাবর)

Related posts

*

*

Top