কিসে ঠেকবে ধর্ষণের তুফান!

জহির উদ্দিন বাবর
Tufan1সম্প্রতি বগুড়ার একটি ধর্ষণের ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এক কলেজছাত্রীকে ধর্ষণ করেন সরকারি দলের স্থানীয় নেতা তুফান সরকার। ধর্ষণের ঘটনা ফাঁস করায় তুফান সরকারের স্ত্রী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন মিলে ওই ছাত্রী ও তার মাকে ধরে এনে মারধর করে মাথা ন্যাড়া করে দেন। মুহূর্তের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে মা-মেয়ের ন্যাড়া মাথার ছবি। গণমাধ্যমে উঠে আসে সেই কাহিনি। দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে এই ঘটনা। বগুড়া শ্রমিক লীগের প্রভাবশালী নেতা তুফানকে অবশেষে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার স্ত্রী, শ্বশুর-শাশুড়ি, স্ত্রীর বড়বোন এবং তুফানের বড়ভাই আওয়ামী লীগ নেতা মতিন সরকারকেও গ্রেপ্তার করা হয়। তাদেরকে দল থেকে বহিষ্কারও করে সরকারি দল। এরপর থেকে প্রতিদিনই সংবাদপত্রে আসছে তুফান-মতিন দুই ভাইয়ের বিস্ময়কর উত্থানের কাহিনি। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় রাতারাতি কীভাবে জিরো থেকে হিরো হয়ে যাওয়া যায় এর উদাহরণ স্থাপন করেছেন বগুড়ার সরকার দলীয় এই দুই নেতা তুফান ও মতিন।

তুফানের ঘটনার পরপর দেশজুড়ে ধর্ষণের যেন মহোৎসব চলছে। প্রতিদিনই ঘটেছে ডজন ডজন ধর্ষণ-গণধর্ষণের ঘটনা। সামাজিক এই অপরাধটি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে দেশের সচেতন মহল। সংবাদপত্রের কলাম, বিশ্লেষণ, টেলিভিশনের টক-শোগুলোতে প্রধান আলোচনার বস্তু এখন ধর্ষণ। নব্বইয়ের দশকে নাসরিন ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা তৎকালীন সরকারকে এতোটাই বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছিল যে, শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলনের ধাক্কায় সরকার বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু এখন প্রতিদিন অগণিত ‘নাসরিন’ ধর্ষিত হলেও নেই সামাজিক ও রাজনৈতিক সেই আলোড়ন। ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধকেও আমাদের সমাজ এখন ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা হিসেবেই দেখে।

দিন দিন ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধির রূপ ধারণ করছে। ধর্ষণের নিত্য নতুন চিত্র আমাদের সামনে আসছে। এক দেড় বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৭০ বছরের বৃদ্ধা ধর্ষণের ঘটনাও ঘটছে। কোথাও ধর্ষণের পাশাপাশি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। শিশু-প্রতিবন্ধী, স্কুলছাত্রী কেউই বাদ যাচ্ছে না ধর্ষণের ভয়াবহ এই অনাচার থেকে। যারা এসবের সঙ্গে জড়িত তারা এই সমাজের প্রভাবশালী। অধিকাংশই সরকারি দল ও প্রশাসনের ছত্রছায়ায় এসব অপকর্ম ঘটিয়ে যাচ্ছে। ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র সবার মধ্যে ভাবনার উদ্রেক হয়েছে কীভাবে ঠেকানো যাবে ধর্ষণের এই তুফান। কোন পদ্ধতি অবলম্বন করলে নিশ্চিত করা যাবে নারীদের নিরাপত্তা। অপরাধের এই ভয়াবহতা এখনই দমন করা না গেলে তা দিন দিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। তখন তথাকথিত সভ্য এই দুনিয়ার অসভ্যতা আইয়ামে জাহিলিয়াতকেও হার মানাবে।

দুই.
ধর্ষণ ঠেকানোর পদ্ধতি নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। টক-শোগুলোতে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা ইনিয়ে-বিনিয়ে নানা জ্ঞানের কথা বলছেন। ধর্ষণের জন্য তারা প্রধানত চিহ্নিত করেছেন সাংস্কৃতিক চর্চার অভাবকে। কথিত এই বুদ্ধিজীবীদের মতে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা ঠিক মতো হলে ধর্ষণ কমে যাবে। তাদের এই যুক্তি খুবই হাস্যকর। ধর্ষণের সব আয়োজন অবারিত করে দিয়ে যতই ধর্ষণের বিরুদ্ধে চিৎকার করুক তা ঠেকানো কখনও সম্ভব নয়। সংস্কৃতির নামে আমাদের দেশে চলছে অপসংস্কৃতি। আমাদের সমাজে ‘পর্দাহীনতাকে’ মনে করা হয় সুস্থ সংস্কৃতি। একজন নারী যত খোলামেলা চলাফেরা করে তাদের কাছে সেই নারীকে তত বেশি সুস্থ সংস্কৃতির ধারক মনে করা হয়। তাদের এই মনোবিকৃতির কারণেই অহরহ ঘটছে ধর্ষণের ঘটনা।

কারও সামনে এনে তেঁতুল রেখে দিলে তা দেখে জিহ্বায় পানি চলে আসাটায় স্বাভাবিক। কারও জিহ্বায় পানি না এলে তার সুস্থতা ও স্বাভাবিক অবস্থা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করার যথেষ্ট কারণ আছে। একজন নারী তার রূপের ডালি সাজিয়ে পরপুরুষের সামনে খোলামেলা আসবে আর সেই ডালি দেখে আড়ালে-আবডালে পুরুষেরা লোভাতুর হবে না সেটা কখনোই সম্ভব নয়। সুযোগসন্ধানী পুরুষ সামান্য সুযোগ পেলে নোংরা মনোবাসনা চরিতার্থ করবে এটাও স্বাভাবিক। কারণ কুপ্রবৃত্তি মানুষকে প্রতি মুহূর্তে বিপথগামিতায় উদ্বুদ্ধ করে। এজন্য প্রকৃতিগতভাবেই নারীদের সেভাবে চলার রেওয়াজ চলে আসছে যেভাবে চললে পুরুষের লোভাতুর দৃষ্টি তাদের ওপর পড়বে না। ইসলামি অনুশাসন বাদ দিলেও কোনো সভ্য সমাজ নারীর অশালীন চলাফেরাকে সমর্থন করে না। চিরাচরিত সামাজিক বিধানটুকু ভালোভাবে মেনে চললেও নারীরা নিগৃহীত হওয়া থেকে অনেকাংশে রক্ষা পেতে পারে।

নারীরা শালীনতা রক্ষা করে চললে ধর্ষণের মতো ঘটনা আর ঘটবে না এমনটা হয়ত বলা যাবে না। তবে নারীরা তাদের মর্যাদা বুঝে দৈনন্দিন জীবনে শালীনতার মাত্রা রক্ষা করে চললে এ ধরনের ঘটনা অনেকাংশে যে কমে যাবে সেটা বলা যায় জোর গলায়। আর ইসলামি অনুশাসন মেনে চললে সেখানে নারীদের নিরাপত্তার শতভাগ গ্যারান্টি আছে। ইসলামি অনুশাসনে শুধু নারীকে পর্দাবৃত করেই তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেনি; পাশাপাশি পুরুষকেও দৃষ্টি অবনত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইসলাম একদিকে নারীকে বলছে তার রূপ-সৌন্দর্য পরপুুরুষের সামনে প্রকাশ না করতে; অপরদিকে পুরুষকে বলেছে পরনারীর দিকে ভিন্ন চোখে না তাকাতে। এক্ষেত্রে নারী-পুরুষ তাদের সীমালঙ্ঘন করলে কী পরিণতি হবে সেটাও বলে দিয়েছে ইসলাম। সর্বোপরি তাকওয়া নামক অতন্ত্র এক প্রহরী নিয়োজিত করে দিয়েছে নারী-পুরুষ সবার মনে। কেউ এই গুণটি অর্জন করলে সবধরনের বিপথগামিতা থেকে রক্ষা পাবে অতি সহজেই।

তিন.
Tufan2আজ আমাদের সমাজের ভয়াবহ চিত্রের জন্য প্রধানত দায়ী মূল্যবোধের অবক্ষয়, ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব এবং তাকওয়া বা খোদাভীতির অনুপস্থিতি। একটা সময় ছিল পারিবারিকভাবেই মানুষ এমন কিছু গুণ অর্জন করতো যা তাকে অবক্ষয়ের হাত থেকে ফিরিয়ে রাখত। সে সময় মানুষ এতো শিক্ষিত না হলেও পরিবার ও সমাজ থেকে যা শিখত তা পরবর্তী জীবনের পাথেয় হিসেবে কাজ করতো। কিন্তু মৌলিক সেই শিক্ষাটা আজ আর আমাদের সমাজেই নেই বললেই চলে। পারিবারিক বন্ধন দিন দিন শিথিল হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে ভয়াবহভাবে। বৈষয়িক প্রাপ্তির দিকে সবাই ছুটছে পাগলা ঘোড়ার মতো। সমাজ অবক্ষয়ের কোন গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই।

ধর্মীয় অনুশাসন তো আজ আমাদের সমাজে নেই বললেই চলে। কেউ একটু ধর্মকর্ম করলে তাকে বাঁকা চোখে দেখা হয়। পারিবারিকভাবে যারা ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলেন তাদেরকে কথিত সুশীল সমাজ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে গণ্য করে। আমাদের সমাজে ধর্মীয় শিক্ষার নিদারুণ অভাব রয়েছে। যারা দীনি শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন তারা নিজেরা ধর্মকর্ম মোটামুটি পালন করলেও সমাজের বড় অংশটির সঙ্গে তাদের নেই তেমন কোনো যোগসূত্রতা। দীনি শিক্ষায় শিক্ষিতরা যেমন সমাজের বড় অংশটিকে ‘ধর্মকর্মহীন’ মনে করে; তেমনি সমাজের বড় অংশটি দীনি শিক্ষায় শিক্ষিতদের সমাজের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করে। এভাবে তাদের উভয়ের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। সমাজের এই অবক্ষয়ের জন্য এই দূরত্বটা অনেকাংশে দায়ী।

একটি সমাজ ও রাষ্ট্র সুষ্ঠুভাবে চলার জন্য পূর্বশর্ত হলো সেই সমাজ ও রাষ্ট্রের সদস্যদের ভালো মানুষ হওয়া। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, আজ সমাজে সবচেয়ে বড় সংকট হলো ভালো মানুষের। মানুষের কোনো অভাব নেই, কিন্তু ভালো মানুষের অভাব প্রকট। বাহ্যিক অবয়বে, লেবাস-পোশাকে আমরা সবাই ভদ্রলোক; সবাই ভালো মানুষ। কিন্তু আমাদের ভেতরে লুকিয়ে আছে হিংস্ ও পশুসুলভ একটি চরিত্র। এই চরিত্রের কারণে আমাদের চারদিকের পরিবেশ দিন দিন বিষিয়ে উঠছে। নোংরা চরিত্রের ভয়াল বহিঃপ্রকাশ প্রায়ই ঘটছে। ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অন্যায় ব্যাধির আকার ধারণ করছে। এর জন্য আমরা আশপাশের বিভিন্ন কারণ নিয়ে আলোচনা করলেও কেউই ঘটনার মূলে যাচ্ছি না। চারিত্রিক সংশোধনের বিষয়টিতে জোর না দিয়ে অপ্রয়োজনীয় বা অপেক্ষাকৃত কম প্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে বেশি মাতামাতি করছি।

একজন মানুষ বাহ্যিকভাবে যত ভালো অবয়বেরই হোক, তার ভেতরে লুকিয়ে থাকতে পারে পশুপ্রবৃত্তি। দুনিয়ার সব বিধিনিষেধ আর আইন-আদালতের চোখ ফাঁকি দিয়ে যেকোনো সময় তার ভেতরে ভয়াবহভাবে জেগে উঠতে পারে সেই প্রবৃত্তি। শাস্তির ভয় কখনও সেই প্রবৃত্তিকে নিবারণ করতে পারবে না। প্রতিটি মানুষের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা সেই পশুত্বকে নিস্তেজ করে দেয়া বা নিয়ন্ত্রণে রাখার একমাত্র অস্ত্র হলো তাকওয়া বা খোদাভীতি। কারও ভেতরে আল্লাহর ভয় থাকলে সে কখনও অন্যায় পথে পা বাড়াতে পারে না। দুনিয়ার সব আইন-আদালতের চোখ ফাঁকি দেয়া সম্ভব, কিন্তু আহকামুল হাকিমিনের চোখ ফাঁকি দেয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। দুনিয়ার সবাই রক্তচক্ষুর ভয়ে চুপসে যেতে পারে; কিন্তু মহান স্রষ্টার দরবারে একদিন দাঁড়াতে হবে; জবাবদিহি করতে হবে-এই বোধ জাগরুক থাকলে কারও পক্ষে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধে জড়ানো কখনও সম্ভব নয়।

এজন্য ধর্ষণের চলমান এই তুফান ঠেকাতে সবার আগে জোর দিতে হবে সমাজের মানুষকে ভালো করার দিকে। প্রতিটি মানুষের অন্তরে তাকওয়ার বীজ ঢুকিয়ে দিতে পারলে অপরাধ প্রবণতা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কমে যাবে। তাকওয়া অর্জনের জন্য সর্বপ্রথম দরকার দীনের ইলম। কেউ যখন আল্লাহকে চিনবে; নবীকে জানবে; ইসলামের বিধিনিষেধ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবে তখনই তার মধ্যে জন্ম নেবে তাকওয়া। যখন সমাজে তাকওয়ার বাম্পার ফলন হবে তখন আর কোনো অনাচার ও অবক্ষয় সেখানে স্থান পাবে না। এটা শুধু কথার কথা না, ইসলামি অনুশাসনে চলা সমাজ পৃথিবীতে এমন নজির স্থাপন করেছে। সেই নজির আজও স্থাপন করা সম্ভব। আর এরজন্য আমাদেরকে ফিরতে হবে ইসলামের দিকে। কারণ ইসলামই পূর্ণাঙ্গ মুক্তির একমাত্র ঠিকানা।

Related posts

*

*

Top