কেন লেখেন লেখক!

cms.sblog.netএকজন লেখক কেন লেখেন? এই জগতসংসারে তো আরো অনেক কাজ আছে। লেখালেখিতে কেন মগ্ন থাকেন লেখকেরা। কীসের নেশায় এ জগতে খেয়ে-না খেয়ে বুদ হয়ে পড়ে থাকেন? উত্তরটা সবার কাছে হয়ত একরকম না। মোটাদাগের প্রাপ্তি আর রাতারাতি বড় কিছু হয়ে যাওয়ার জন্য কেউ লেখেন না-এটা বলা যায় সবার ক্ষেত্রে। কারণ লেখালেখি করে ভাত-জোটানো কঠিন। বর্তমান এই করপোরেট জগতে লেখালেখির কদর আগের চেয়ে অনেকটা বেড়েছে। তা সত্ত্বেও লেখকের বৈষয়িক প্রাপ্তিটা অন্য দশটা পেশার মতো না। শুধু লেখে

জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন এমন লেখকের সংখ্যা বাংলাদেশে দু’চারজন আছেন কিনা সন্দেহ। সহযোগী পেশা হিসেবে লেখালেখি করেন এমন লেখকের সংখ্যাই বেশি। তার মানে জীবিকা নির্বাহের অন্য ব্যবস্থা থাকলেই কেবল লেখকেরা এই জগতে টিকে থাকতে পারেন। শুধু কলম চালিয়ে জীবনসংগ্রামের কসরত ততটা ফলপ্রসূ নয়। এই বাস্তবতার কষাঘাতে জর্জরিত কত সম্ভাবনাময় কলমের কালি যে শুকিয়ে গেছে তা বলা মুশকিল।

লেখালেখি পেশা নাকি নেশা-এই তর্ক অনেক পুরোনো। সেই তর্কে না গিয়েও বলা যায়, দুইটার সমন্বয়েই লেখালেখি। জীবনবাস্তবতায় লেখালেখিকে পেশা হিসেবে হয়ত বেছে নেয়া সম্ভব হয় না। তাই অনেকটা নেশা হিসেবেই এই জগতে বিচরণ করেন লেখকেরা। প্রাপ্তির বিচার করলে লেখকের পাওয়াটা হতাশাব্যঞ্জক। একজন ডিগ্রিধারী কর্মকর্তা সামান্য কলমের খোচায় যে টাকাপয়সা কামাই করেন একজন লেখক ফর্মার পর ফর্মা লিখেও তা পারেন না। অন্য দশটা পেশার শ্রমিকেরা শ্রম দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাইনা পেয়ে যান। আর একজন কলমশ্রমিকের শ্রমের দাম পেতে লেগে যায় বছরের পর বছর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ন্যূনতম হারে পাওয়া গেলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শ্রম অনুযায়ী মাইনা পাওয়া যায় না।

একজন লেখক কলমের ডগায় ভাবনার যে স্ফূরণ ঘটান, স্বপ্নের যে ডালি সাজান, জীবনবাস্তবতার যে ভুবন আঁকেন তার ওপর নির্ভর করে কত লোকের যে জীবনজীবিকার সংস্থান হয় এর কোনো হিসাব নেই। প্রকাশক থেকে শুরু করে হকার-বাইন্ডার পর্যন্ত সবাই লেখকের ‘প্রসবিত’ ভাণ্ডার নিয়ে নড়াচড়া ও রূপান্তর করে নিজেদের রুটি-রুজির ব্যবস্থা করেন। কম্পোজম্যান থেকে শুরু করে বাইন্ডার পর্যন্ত একটি প্রকাশনার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত কারো মাইনা বাকি থাকে না। কারো শ্রমের অবমূল্যায়ন হয় না। কিন্তু একজন লেখক কি তাঁর শ্রমের যথাযথ মূল্য পান। দুয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বঞ্চিন হন লেখক। অথচ সবার জীবন-জীবিকার অবলম্বন তৈরি করে দিয়েছেন লেখক। এটা শুধু এখন না, প্রায় সব যুগেই অবহেলা ও অবমূল্যায়নের শিকার লেখকরা।

দুই.
অবজ্ঞা ও বঞ্চনার কথা জেনেও লেখক অব্যাহতভাবে লেখে যান। কারণ এটা এমন এক ভুবন যার মজা শুধু এর বাসিন্দারাই ভোগ করেন। পৃথিবীর কোনো প্রাপ্তির সঙ্গে লেখালেখির প্রাপ্তিকে তুলনা করা যায় না। একটি লেখার জন্ম দিয়ে লেখক যে প্রশান্তি ভোগ করেন তার তুলনা করার মতো কোনো উদাহরণ এই মুহূর্তে খুঁজে পাচ্ছি না। লেখক যখন তাঁর আপন ভুবনে বিচরণ করেন তখন পার্থিব কোনো উঞ্চতা এর সঙ্গে তুল্য নয়। পৃথিবীর সব মানুষ যখন আরামের ঘুমে বিভোর লেখক তখন কলম-খাতা অথবা কী-বোর্ডের সঙ্গে মিতালী করছেন। প্রেমিক-প্রেমাস্পদের মিতালী ও ভালোবাসার চেয়ে তা আরো বেশি গাঢ়, গভীরভাবে নিষিক্ত। একজন লেখকের চিন্তার ফসল, স্বপ্নের বাস্তব রূপ যখন ছাপার হরফে বের হয় তখন আনন্দের কোনো সীমা-পরিসীমা থাকে না। যত বড় লেখকই হোন না কেন নিজের লেখা ছাপার অক্ষরে দেখলে আনন্দ বোধ করেন না; ভেতরে ভেতরে খুশিতে গদগদ হয়ে যান না এমন লেখক খুঁজে পাওয়া যাবে না। লাখ লাখ টাকা নিজের অ্যাকাউন্টে যুক্ত হওয়ার চেয়ে একটি বই প্রকাশ হওয়া একজন লেখকের কাছে বেশি আনন্দের।

ঝকঝকে-তকতকে ছাপার হরফে নিজের লেখা বইয়ের কাঁচা গন্ধ সুঁকে অপার্থিব স্বাদ অনুভব করেন লেখক। এই অনুভূতিটুকুর সঙ্গে পৃথিবীর অন্য কোনো প্রাপ্তির তুলনা চলে না। লেখালেখির ফলাফল সুদূরপ্রসারী। মানুষের কোনো কীর্তিই এতো দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ইমাম গাযালী রহ. পৃথিবী থেকে গত হয়েছেন প্রায় হাজার বছর আগে। কিন্তু তাঁর লিখনী এখনও দেদীপ্যমান আলো হয়ে পথের সন্ধান দিচ্ছে পৃথিবীবাসীকে। আমাদের নিকট অতীতে হযরত থানভী রহ. ইন্তেকাল করেছেন অর্ধশতাব্দীকালের বেশি সময় আগে। তাঁর লেখা বিশাল ভাণ্ডার এখনো উপমহাদেশের মুসলমানদের জীবনচলার পাথেয়। চার দশকের বেশি সময় আগে গত হয়েছেন ছদর সাহেব হুজুর খ্যাত আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.। পাঠকদের কাছে এখনও তিনি রোজ রোজ হাজির হচ্ছেন নতুন আঙ্গিকে, ভাবনার নতুন দিগন্তে। আমাদের দেশে অসংখ্য যোগ্যতাসম্পন্ন আলেম গত হয়েছেন; যাঁরা ছিলেন জাতির দিকপালতুল্য। কিন্তু লেখালেখির অঙ্গনে তাঁদের কোনো ভূমিকা ছিল না। ফলে তাঁরা আজ বিস্মৃতির আঁধারে তলিয়ে গেছেন। লেখা মানুষকে অমর করে রাখে; মৃত্যুর পরও এ থেকে লাভবান হতে থাকেন একজন লেখক।

এজন্য পেশা আর নেশা যাই বলেন, লেখকের প্রাপ্তিটা অন্য দশটা পেশার চেয়ে আলাদা। জীবনে কোনোদিন দেখা-সাক্ষাৎ নেই; নেই কোনো যোগাযোগ। তবুও একজন লেখকের সঙ্গে পাঠকের গড়ে ওঠে গভীর সম্পর্ক। লেখককের ভাবনা ও স্বপ্নবুনন পাঠকের অন্তরকে গভীরভাবে ছুঁয়ে যায়। আত্মিক এই সম্পর্কের কারণে অচেনা-অজানা পাঠকও লেখকের জন্য কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করেন; শুভকামনা জানান। অন্য কোনো পেশার মানুষ কি এরকম ব্যাপকভাবে মানুষের হৃদয়রাজ্যে নিজের স্থান করে নিতে পারেন? লেখকের কলমের অপরিমেয় শক্তি জাতিকে একদিকে ধাবিত করতে পারে। লেখকের কলমের সম্মোহনী শক্তির কারণে দিকভ্রান্ত জাতি সঠিক পথের সন্ধান যেমন পেতে পারে; তেমনি কখনও কখনও নিজের অজান্তেই চলে যেতে পারে ভুল পথে। এজন্য জাতির চালকের আসনে বসা লেখকদের ওপর নির্ভর করে একটি জাতির ভবিষ্যৎ। তাই লেখকের কাছে জাতির প্রত্যাশা ইতিবাচক পদক্ষেপ; কোনো নেতিবাচকতা কাম্য নয়।

Related posts

*

*

Top