সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকা বর্তমানে বিশ্বের একমাত্র ‘সুপার পাওয়ার’ হওয়ার দাবিদার। বর্তমান বিশ্বে একচ্ছত্র মোড়লিপনা করছে দেশটি। বিশেষত ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অঘোষিত ক্রুসেডের নেতৃত্বে রয়েছে আমেরিকান প্রশাসন। কোটি কোটি বিলিয়ন ডলার প্রতি বছর ব্যয় হয় সামরিক খাতে। আরববিশ্বের তেলসম্পদ থেকে আহরিত অর্থ দিয়ে কেনা অস্ত্র তারা কাজে লাগাচ্ছে মুসলিম নিধনে। আমেরিকার একচ্ছত্র ক্ষমতার কাছে প্রাকৃতিক সম্পদে বলীয়ান আরব রাষ্ট্রগুলোর প্রধানেরাাও বিড়ালের মতো মিউমিউ করে। আপাত চোখে আমেরিকাকে মোকাবেলার মতো সামর্থ্য কোনো মুসলিম দেশের নেই। এজন্য তারা যে কোনো অন্যায় সিদ্ধান্ত মুসলিম বিশ্বের ওপর চাপিয়ে দেয়ার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। কিন্তু এই আমেরিকার ভেতরের ভয়াবহ দুরাবস্থার কথা জানলে মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটু হলেও আশার সঞ্চার হয়। ঋণের বোঝা ও দারিদ্রের কষাঘাতের সঠিক চিত্রটি দেখলে সহজেই অনুমান করা যায় আমেরিকা আজ কত অসহায়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, সুপার পাওয়ারের দাবিদার আমেরিকার এই দাম্ভিকতা শেষ হয়ে যাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান আমেরিকার পতনের প্রহরই গুণছে।
তৃতীয় বিশ্বের মানুষের কাছে আমেরিকা একটি স্বপ্নের দেশ। সবাই সে দেখে একবার যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। এ স্বপ্ন দেখার কারণ হলো, সবাই মনে করে শুধু সামরিক দিক থেকেই নয়, অর্থনীতি, উপার্জন, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা-সংস্কৃতির দিক থেকেও আমেরিকা সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র। পিছিয়ে থাকা এবং দরিদ্র দেশের জনগণের কাছে আমেরিকা ‘পৃথিবীর স্বর্গ’ বলেই গণ্য। যেখানে নেই দারিদ্রের কোনো চিহ্ন, ক্ষুধার কোনো আভাষ এবং নেই রোগ-বালাইয়ের কোনো পাত্তা। তারা মনে করেন, আমেরিকায় হয়ত দুধ ও মধুর নদী প্রবাহিত হয়। ক্ষুধা, দারিদ্র্র, অন্যায়-অন্যায্য বলতে কোনো জিনিস আমেরিকায় আছে সেটা তারা বিশ্বাসই করতে চায় না।
গত কয়েক বছর আগেও আমেরিকা সম্পর্কে এ ধারণা অনেকাংশেই সঠিক ছিল। কিন্তু বর্তমানে তা আর নেই। এক সময় আমেরিকায় দারিদ্র্র ও বেকারত্বের মতো জিনিস খোঁজে পাওয়া কঠিন ছিল। কিন্তু সে যুগ হারিয়ে গেছে। তৃতীয় বিশ্বের এসব সমস্যা আজ একমাত্র পরাশক্তি আমেরিকাকেও জর্জরিত করে দিচ্ছে। আমেরিকায়ও এখন দারিদ্রের পদচিহ্ন দেখা যায়। কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে আমেরিকার অবস্থাও দুই যুগ আগের রাশিয়ার মতো হয়ে গেছে, যে কারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
এছাড়াও এর আরো কিছু কারণ আছে। অর্থনীতিবিদরা এর আসল কারণ হিসেবে আমেরিকান সরকারের অবাস্তব পদক্ষেপ এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পলিসিকেই চিহ্নিত করেছেন। সারা বিশ্বের ওপর নিজেদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা এবং এই কর্তৃত্বকে অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়ার হীন কৌশল অবলম্বন করে আসছে আমেরিকা। নিজেদের এই বাসনা চরিতার্থ করার জন্য আমেরিকা পারমাণবিক অস্ত্র থেকে শুরু করে চালকবিহীন যুদ্ধবিমান পর্যন্ত ব্যবহার করছে। টুনকো ছুতোয় তারা ইরাক ও আফগানিস্তানকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। এখনো তারা ইরানসহ কয়েকটি দেশের ওপর নিজেদের শ্যেনদৃষ্টি ফেলে রেখেছে। সারা বিশ্বে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার এই উন্মাদনার কারণেই আমেরিকার অর্থনীতিতে ভয়াবহ ধ্বস নেমেছে। এখন আমেরিকা সারা বিশ্বের সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত দেশ। তাদের ঋণের বোঝা দিন দিন শুধু বাড়ছেই।
কোটি কোটি আমেরিকান দারিদ্রসীমার নিচে
আমেরিকা প্রথমবারের মতো স্বীকার করেছে, কয়েক বছর ধরে বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ায় দারিদ্রের পরিমাণ দ্রুত বাড়ছে। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৭ সাল থেকে অব্যাহত মন্দার প্রভাবে ২০১০ সালে এসে আমেরিকায় চার কোটি ৬২ লাখ (৪.৬২ মিলিয়ন) লোক দারিদ্র দেশগুলোর জনগণের মতো দারিদ্রসীমার নিচে বাস করছে। এই রিপোর্টেই বারাক ওবামা সরকারের অর্থনৈতিক অবস্থার প্রকৃত চিত্রটি ফুটে উঠে।
এ প্রতিবেদনে বলা হয়, বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতির শিকার আমেরিকার আর্থসামাজিক অবস্থার দিন দিন অবনতি হচ্ছে। ২০০৭ থেকে শুরু হওয়া দারিদ্রের হার শুধু বাড়ছেই। ২০০৯ সাল থেকে ২০১০ সালে দারিদ্রের হার বাড়ে ১%। কিন্তু পরের বছরগুলোতে তা সামষ্টিকভাবে ১৫.১% হারে বেড়েছে। এর মানে হলো, শতকরা ছয়জন আমেরিকান দারিদ্রসীমার নিচে বাস করছে। এই রিপোর্ট বলে দেয়, ২০১০ সালে রেকর্ডকৃত আমেরিকান গরিব মানুষের সংখ্যা বিগত অর্ধশতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
মধ্যবিত্ত আমেরিকানদের বার্ষিক আয়ও ব্যাপকভাবে কমেছে। বর্তমানে মাথাপিছু গড় আয় ৪৯ হাজার ৪৪৫ ডলার। আমেরিকান নাগরিকদের আয় কাতার, কুয়েত, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব-আমিরাতের মতো অনেক ছোট দেশের মধ্যবিত্ত লোকদের আয়ের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। এছাড়া স্বাস্থ্য বিমা থেকে বঞ্চিত আমেরিকানদের সংখ্যাও পাঁচ কোটির ওপরে।
প্রতিবেদনে প্রকাশিত আমেরিকার আর্থসামাজিক অবস্থার এই চিত্র আগামী কয়েক বছরে পাল্টে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ ৯% হারে বেকারত্ব বাড়ছে। এতে অর্থনৈতিক সংকট আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আরেকটি আশঙ্কার বিষয় হলো, আমেরিকায় আবার বর্ণবাদী রাজনীতির সূচনা হতে যাচ্ছে। আগে থেকে আমেরিকা শাসন করা শ্বেতাঙ্গ রাজনীতিকরা বলছেন, “আমরা আগেই বলেছিলাম, কৃঞ্চাঙ্গদের হাতে ক্ষমতা দিও না। তারা প্রশাসনিক যোগ্যতা রাখে না। কিন্তু কেউ আমাদের কথায় কান দেয়নি। তবে এখন সবাই বুঝে গেছে এক কৃঞ্চাঙ্গ (ওবামা) দেশে কী সর্বনাশ করেছে।”
আমেরিকার বর্তমান অবস্থা হলো ওই হাতির মতো, যার খাওয়ার জন্য এক ধরনের দাঁত আবার দেখানোর জন্য আরেক ধরনের দাঁত। এ উদাহরণটি দুনিয়ার ‘মা-বাবা’ আমেরিকার ওপর পুরোপুরিই প্রয়োগ হয়। হলিউডের ফিল্ম, টেলিভিশন চ্যানেল এবং মিডিয়ায় আমেরিকার গুণগানে গরিব দেশের জনগণ এতদিন আমেরিকানদের দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী মানুষ বলে মনে করে আসছে। কিন্তু এটা শুধুই কল্পনা। আমেরিকার ফিল্ম ও মিডিয়ায় তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার প্রকৃত চিত্র কখনোই উঠে আসে না। বাস্তবতা হলো, আমেরিকা ওই দেশগুলোর একটি যেখানে দীর্ঘদিন ধরে দারিদ্রের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। প্যারিস থেকে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ৩৪টি উন্নত দেশের মধ্যে দারিদ্রের হারে শুধু তিনটি দেশ চিলি, ইসরাইল ও মেক্সিকো আমেরিকা থেকে এড়িয়ে আছে।
‘ভুল পথে আমেরিকা’
দেশের অর্থনৈতিক দৈন্যদশার কারণে দিন দিন আমেরিকার নাগরিকদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। রাজনৈতিক দল অর্থাৎ ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকানদের প্রতি বর্তমানে তাদের কোনো আস্থা নেই। ৮০ ভাগ আমেরিকান মনে করে তাদের দেশ ভুল পথে এগুচ্ছে। বাকি ২০ ভাগ মনে করে অর্থনৈতিক সংকট সত্ত্বেও দেশ সঠিক পথেই এগুচ্ছে। তবে এরাও বলতে পারে না অবনতিশীল আর্থসামাজিক অবস্থা থেকে উত্তরণ কিভাবে সম্ভব। মধ্যবিত্তদের জন্য দিন দিন আমেরিকায় বসবাস অসম্ভব হয়ে উঠছে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস থেকে শুরু করে ওষুধপথ্য পর্যন্ত তাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে মেডিকেল বিমা তুলে নেয়ায় তারা আরো হতাশ হয়েছে। দারিদ্রের কারণে অনেক আমেরিকান চিকিৎসাও করাতে পারছে না। সূত্র: ইন্টারনেট