বাংলাদেশের ইতিহাসে ইসলামের অন্যতম স্তম্ভের ব্যাপারে এত নগ্ন মন্তব্য সম্ভবত ইতোপূর্বে আর কেউ করেনি। অন্তত এমন হাই-প্রোফাইলের কেউ অতীতে ইসলামের ওপর এভাবে হামলে পড়ার দুঃসাহস দেখায়নি। আওয়ামী লীগের পোষ্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এদেশের ১৬ কোটি মুসলমানের হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। ঈমানের ছিঁটেফোটাও যাদের মধ্যে আছে মুসলিম নামধারী এই কুলাঙ্গারের বক্তব্যে তাদের অন্তরে রক্তক্ষরণ হয়েছে। ইসলাম, মহানবী সা., পবিত্র হজ, তাবলিগ জামাত সম্পর্কে তার কুৎসিত, কলুষিত ও চরম আপত্তিকর বক্তব্য মিডিয়ার কল্যাণে কোটি কোটি মুসলমান শুনেছেন, দেখেছেন। পৃথিবীর তাবৎ ঘৃণা তার ওপর ছুড়ে মারলেও মুসলমানদের অন্তর শান্ত হবে না। তাকে যে শাস্তিই দেয়া হোক অপরাধের তুলনায় তা কমই হবে।
সরকারের একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী থাকা অবস্থায় লতিফ সিদ্দিকী সুদূর নিউ ইয়র্কে বসে এদেশের কোটি কোটি মুসলমানের অন্তরে তীর বিদ্ধ করেছেন। দুই চারজন কুলাঙ্গার ও তাদের দোসর ছাড়া লতিফ সিদ্দিকীর মন্তব্যে সব মুসলমানের অন্তরে আঘাত লেগেছে। তিনি ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসে আক্রমণ করে অনেক কথা বলেছেন। প্রথমে তিনি আঘাত করেন ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি হজকে। তার ভাষায় ‘এই হজে যে কত ম্যানপাওয়ার নষ্ট হয়! হজের জন্য ২০ লাখ লোক আজ সৌদি আরবে গিয়েছে। এদের কোনো কাম নেই। এদের কোনো প্রডাকশন নেই। শুধু রিডাকশন দিচ্ছে। শুধু খাচ্ছে আর দেশের টাকা দিয়ে আসছে। অ্যাভারেজে যদি বাংলাদেশ থেকে এক লাখ লোক হজে যায় প্রত্যেকের পাঁচ লাখ টাকা করে ৫০০ কোটি টাকা খরচ হয়।’ এরপর তিনি আক্রমণ করেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.কে। তিনি নিজেই হজের এক কাল্পনিক ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। তার ভাষায় ‘আবদুল্লাহর পুত্র মোহাম্মদ চিন্তা করল এ জাজিরাতুল আরবের লোকেরা কিভাবে চলবে। তারা তো ছিল ডাকাত। তখন একটি ব্যবস্থা করল যে আমার অনুসারীরা প্রতি বছর একবার একসাথে মিলিত হবে। এর মধ্য দিয়ে একটি আয়-ইনকামের ব্যবস্থা হবে।’
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ইসলামের অন্যতম মূল স্তম্ভে যেভাকে নগ্ন আঘাত করেছেন তার বক্তব্যের কোনো জবাব চলে না; তার কথার কোনো পাল্টা যুক্তি দেয়ার মতো ধৈর্য ও রুচি কোনো মুসলমানের নেই। অনেকে বলেছেন, লতিফ সিদ্দিকী তার মুক্ত চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন, ইসলামের বিশ্বাস এতো ঠুনকো নয় যে কারো মন্তব্যে তাতে আঘাত লাগবে। যাদের মধ্যে ঈমানের ছিঁটেফোটাও নেই, মুসলমান নাম ধারণ করলেও যাদের অন্তরে রয়েছে বক্রতা তারা লতিফ সিদ্দিকীর পক্ষে অবস্থান নিতেই পারে। তবে যাদের অন্তরে ঈমানের শিখার উপস্থিতি আছে তারা কোনোভাবেই লতিফ সিদ্দিকীর মতো কুলাঙ্গারের পক্ষে সাফাই গাইতে পারে না। লতিফ সিদ্দিকী তার মন্তব্যের কারণে যে মুরতাদ হয়ে গেছেন এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। তাকে যারা মুরতাদ মনে করবে না তাদের ঈমান নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। আর মুরতাদের শাস্তির ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশনা স্পষ্ট, তাকে শিরশ্চেদ করতে হবে। একজন কাফের মুসলিম সোসাইটিতে সম্মানের সঙ্গে বাস করার সুযোগ পেলেও কোনো মুরতাদের সেই অধিকার নেই।
লতিফ সিদ্দিকী তার মন্তব্যের দ্বারা মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছেন। অনেকে এই মন্তব্যের জন্য দেশের প্রচলিত আইনে তার বিচার দাবি করেছেন। কিন্তু তার অপরাধের তুলনায় প্রচলিত আইনের শাস্তি খুবই নগণ্য। বাংলাদেশে দ-বিধির ২৯৫-ক ধারা অনুযায়ী এই অপরাধে একজন ব্যক্তির সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদ- বা অর্থদ- অথবা উভয় দ-ই হতে পারে। ওই ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে বা বিদ্বেষপরায়ণ হয়ে কোনো কথা বা লিখিত শব্দের মাধ্যমে বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেন অথবা দৃশ্যমান কোনো উপস্থাপনার মাধ্যমে ধর্ম বা কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীকে অপমান করেন বা অপমান করার প্রয়াস চালান, তাহলে তিনি সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদ- বা অর্থদ- অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
এ ধরনের ধর্মদ্রোহী যারা প্রকাশ্যে মানুষের বিশ্বাসের অনুভূতিতে আঘাত হানে মানুষ চায় তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার। কেউ রাষ্ট্রদ্রোহী কাজ করলে আমাদের দেশের প্রচলিত আইনে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। অথচ রাষ্ট্র মানুষের জন্যই; আর মানুষের অন্তরকে ক্ষতবিক্ষত করলে এর শাস্তিও তেমনি হওয়া উচিত। মানুষের বিশ্বাসের জায়গাটা তো আরো ঊর্ধ্বে। দেশরক্ষায় মানুষ যেমন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত তেমনি বিশ্বাসের জায়গাটাও কম সবল নয়। মানুষ তার বিশ্বাসে অটল থাকতে গিয়ে দেশ-জাতিকে ত্যাগ করতে পারে অনায়াসেই। ইসলামের মতো একটি মনোনীত ধর্মের অনুসারীদের বিশ্বাসটুকু অন্য যেকোনো ধর্মের চেয়ে সবল। কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ইসলামের প্রকৃত অনুসারী হতে পারবে না যতক্ষণ না তার প্রাণ, মা-বাবা, সন্তান-সন্তুতি; ধন-সম্পদ এবং দুনিয়ার সবকিছুর চেয়ে রাসূলুল্লাহ সা.-এর প্রতি ভালোবাসা প্রবল না হবে। নবীপ্রেমের জ্বলন্ত প্রমাণ রেখে অসংখ্য মানুষ অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছেন। ভালোবাসা ও ঈমানের এই অবস্থাটিকে দুনিয়ার কোনো সম্পর্ক বা সূত্র দিয়ে তুলনা করা যাবে না। ইসলামের নবীকে কটূক্তির পর এই ধর্মের কোনো অনুসারী নীরবে বসে থাকতে পারে না। হয়ত ব্যক্তিপর্যায়ে ইসলামের বিধিবিধান সবাই ঠিকমতো পালন করে না, কিন্তু বিশ্বাস ও আবেগের স্থানে যথার্থ প্রকাশে কোনো মুসলমান ত্রুটি করে না।
জঘন্য মন্তব্যের পরও থেমে থাকেননি লতিফ সিদ্দিকী। ঔদ্ধত্যের চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন এই নাস্তিক। বক্তব্যের জন্য বিন্দুমাত্রও অনুতপ্ত নন জানিয়ে ধর্মদ্রোহী হওয়ার চরম দাম্ভিকতা দেখিয়েছেন। বিদেশে বসে তার এই বক্তব্য ও আচরণে দেশ-বিদেশের মুসলমানরা ফুঁসছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে দুই ডজনের বেশি মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। তাকে মন্ত্রিত্ব ও দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। যে দলটি তাকে দুধ-কলা খাইয়ে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে তারাও এখন জনরোষের ভয়ে তাকে দল থেকে বের করে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সরকারি দলের নেতারা ইনিয়ে-বিনিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন, লতিফ সিদ্দিকীর বক্তব্যের দায় তার দল বা সরকার নেবে না; এটা একান্তই তার নিজস্ব বক্তব্য। কিন্তু দেশের মানুষ এটা ভালোভাবেই টের পেয়েছে। এক নাস্তিকের ঔদ্ধত্যের প্রকাশ ঘটলেও এই দলটিতে লুকিয়ে আছে অসংখ্য ধর্মদ্রোহী। ইতিপূর্বে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের বিভিন্ন নেতানেত্রীর মুখ থেকে ধর্মদ্রোহী বক্তব্য ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় বেরিয়ে এসেছে। এজন্য ইসলামের সেবক হিসেবে তারা নিজেদেরকে যতই জাহির করার কসরত করুক কেউ আর তাদেরকে এ ব্যাপারে বিশ্বাস করে না।
বাংলাদেশে ইসলাম সম্পর্কে কটূক্তি এবং মুসলমানদের মনে আঘাত দেয়ার নজির শুধু এটাই নয়। অতীতেও তসলিমা নাসরিন, দাউদ হায়দার থেকে শুরু করে অনেক নাস্তিক-মুরতাদ বিভিন্ন সময় কটূক্তির মাধ্যমে মুসলমানদের হৃদয়ে আঘাত দিয়েছে। এদেশের মুসলমানরা তাদের প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠেছেন। কোনো কোনো নাস্তিক-মুরতাদ চিরদিনের জন্য দেশছাড়া হয়েছে। আমাদের দেশে তথাকথিত প্রগতিশীলতার আড়ালে একটি ধর্মদ্রোহী শ্রেণী গজিয়ে ওঠেছে। নানা কারণে দিন দিন তাদের সংখ্যা বাড়ছে। তাদের কাজই হলো ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা। তারা তাদের লেখা ও বক্তব্যে সুযোগ পেলেই ইসলামের ওপর আঘাত করে বসে। রাষ্ট্রীয়ভাবে আইনি ব্যবস্থা না থাকায় তাদের কোনো বিচার হয় না। ইসলামপ্রিয় মানুষদের হৃদয়ে গুটিকতক কুলাঙ্গার আর কতদিন এভাবে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েই যাবে-সেটা আজ দেশবাসীর প্রশ্ন।
পাকিস্তান-সৌদি আরবসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্লাসফেমি আইনের মাধ্যমে ধর্মদ্রোহী এই কুলাঙ্গার শ্রেণীটিকে ঠেকানোর ব্যবস্থা আছে। ব্লাসফেমি মানে ধর্ম অবমাননা। ধর্মের অপমান যাতে কেউ না করতে পারে এর জন্য পৃথিবীর সব ধর্মেই সুস্পষ্ট আইন-কানুন আছে। ইহুদি, খ্রিস্ট ও ইসলাম ধর্মে অবমাননার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট শাস্তির কথা উল্লেখ আছে। শুধু তাই নয়, একালের অনেক আধুনিক রাষ্ট্রেও এ ধরনের আইনের ব্যবস্থা আছে। ইহুদিদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ তওরাতে ধর্ম অবমাননাকারীর শাস্তির বিধান হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের কথা বলা হয়েছে। খ্রিস্টধর্মেও অবমাননার শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের সুপারিশ করা হয়েছে। বৃটেনে ধর্ম অবমাননার জন্য থমাস আইকেনহেড নামের ১৮ বছরের এক যুবককে ১৬৯৭ সালে শেষবারের মতো মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। ওইসব দেশে আইনের আওতায় খ্রিস্ট ধর্মের বিরুদ্ধে যাতে বিদ্বেষ প্রচার না করা হয় তার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পাশ্চাত্যের মতো মুক্ত সমাজে, যেখানে বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতাকে অত্যন্ত মূল্যবান মনে করা হয়, সেখানেও ধর্ম অবমাননার মতো স্পর্শকাতর বিষয়টি মাঝেমধ্যে হৈচৈ ফেলে দেয়। কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশেই। এখানে সেই ব্লাসফেমি আইনটি আজও প্রণয়ন হয়নি। ব্লাসফেমি আইনটি থাকলে কোনো কুলাঙ্গার আর ধর্ম সম্পর্কে কটূক্তি বা জঘন্য মন্তব্যের দুঃসাহস দেখাবে না।