প্রশ্ন হলো, তারা কে, যারা ইমরান খান ও তাহিরুল কাদরিকে লাহোর থেকে রওয়ানা করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন? তারা কে, যারা উভয়কে একই দিন ইসলামাবাদে আসার পথ করে দিয়েছেন? তারা কে, যারা এই দুজনকে একই দিন একই সময়ে ইসলামাবাদের রেড জোনে ঢোকার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন? ইমরান খানের বক্তব্যগুলো সামনে রাখলে পরিষ্কার বোঝা যাবে, তারা নওয়াজ শরিফের পদত্যাগ এবং মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন। কিন্তু নওয়াজ শরিফ পদত্যাগও করেননি এবং মধ্যবর্তী নির্বাচনের কোনো আভাসও চোখে পড়ছে না। পাকিস্তানের সুশীল সমাজ, আইনজীবী, ব্যবসায়ী এবং পার্লামেন্টে থাকা দলগুলোর বেশির ভাগই ইমরান খানের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পদত্যাগ ও বিদ্রোহ ঘোষণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাহলে এটা কি ইমরান খানের জন্য কোনো সাফল্য বয়ে আনলো?
১৪ আগস্টের আগে সরকার ইমরান খান ও তাহিরুল কাদরির আজাদি মার্চ প্রতিহত করার জন্য যখন লাহোরের রাস্তা বন্ধ করতে থাকে তখন আমার অবস্থান ছিল, তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করার অধিকার থাকা উচিত। যখন তারা উভয়েই ইসলামাবাদে পৌঁছে গেলেন এবং রেড জোনে ঢোকার ঘোষণা দিলেন তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নেসার আলি খান বললেন, রেড জোনে কারো ঢোকা নিষেধ।
সে সময়ও আমার মত ছিল, রেড জোনে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের অনুমতি দিতে কোনো সমস্যা নেই। আমার অবস্থানের কথা শুনে ইমরান খানের দল তেহরিকে ইনসাফের এক নেতা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি আমাকে বললেন, পাকিস্তানের ভাগ্য বদল হতে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি। আপনি অত্যন্ত সতর্কভাবে আমাদের আন্দোলনে সমর্থন দিচ্ছেন। আপনার উচিত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পদত্যাগের দাবি উঠানো যাতে আপনার নাম ওই সাংবাদিকদের তালিকায় স্মরণীয় হয়ে থাকে যারা নতুন পাকিস্তান গড়ায় ইমরান খানের সঙ্গী হবেন।
এ কথা শুনে আমি তেহরিকে ইনসাফের ওই নেতাকে আমাদের এক বন্ধুর বাসায় সাক্ষাতের জন্য বললাম। আমি ওই নেতাকে বললাম, ইসলামাবাদের গ্রিন অথবা রেড জোনে আন্দোলন করা আপনাদের আইনি অধিকার। এক্ষেত্রে আমি আপনাদেরকে ন্যায়সঙ্গত মনে করি। কিন্তু যখন আপনারা শেখ রশিদ আহমদ ও চৌধুরী শুজায়াত হোসাইনের মতো নেতাদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন তখন এটা ভাবার অধিকার আমার আছে, ১৯ এপ্রিল আমার গায়ে কি এজন্যই গুলি লেগেছিল যে, কয়েক মাস পরে ইসলামাবাদের রাস্তায় বৃষ্টিতে ভিজে যুবতীদের এবং তাদের আশপাশে নৃত্যরত ছেলেদের সঙ্গে মিলে ‘গো নওয়াজ গো’(নওয়াজ সরে দাঁড়াও) স্লোগান দেব? আর আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকবে সাবেক স্বৈরশাসক মুশাররফের মন্ত্রীরা।
আমার এ কথার জবাবে তাহরিকে ইনসাফের ওই নেতা বলেন, আপনি নিজে ২০১৩ সালের নির্বাচনে কারচুপি বিষয়টি তুলে ধরেছেন। আজও আপনি সেই কারচুপির বিরুদ্ধে সোচ্চার। কিন্তু সেই কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সরকারের সঙ্গ কেন ত্যাগ করছেন না? আমি বললাম, কারচুপি শুধু পাঞ্জাবেই হয়নি, চার প্রদেশেই হয়েছে। সবচেয়ে বেশি কারচুপি হয়েছে বেলুচিস্তান ও খায়বার পাখতোয়ায়। কিন্তু আপনারা পাঞ্জাব ছাড়া অন্য প্রদেশে কারচুপির বিষয়ে মুখ খুলেন না কেন? তাহরিকে ইনসাফের ওই নেতা বলেন, আপনি হয়তো ধারণা করছেন আমাদের এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য পারভেজ মুশাররফকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া। এজন্য আপনি আমাদের সঙ্গী হচ্ছেন না।
আমি তাকে বললাম, পারভেজ মুশাররফের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো বিরোধ নেই। আদালত তাকে দেশের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিলে আমি কী করতে পারি? আমি শুধু এটুকু চাচ্ছি যে, ইমরান খান আইনের ভেতরে থেকে আইনানুগভাবে আগামী নির্বাচনে কারচুপির পথ বন্ধ করবেন।
এ সময় আচমকা ওই নেতা তার মোবাইলের ব্যাটারি বের করে ফেললেন এবং আমাকে বললেন, আমার আই ফোনটা যেন বাসার বাইরে রেখে আসি। এরপর তিনি কানে কানে বললেন, ২৩ আগস্ট প্রধান বিরোধী দল পিপলস পার্টিও আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দেবে। তখন নওয়াজ শরিফের পদত্যাগ করতেই হবে। ২৩ আগস্ট রাত দশটার দিকে আমি আপনাকে ফোন দেব। ইনশাআল্লাহ, কয়েক মাসের মধ্যে ইমরান খানই হচ্ছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তবে মনে রাখবেন, আমরা ক্ষমতায় এসে আপনার জিও টিভিকে কিন্তু ছাড়বো না।
২৩ আগস্ট সকালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী পারভেজ মুশাররফের সহযোগীরা পার্লামেন্ট ভবনের সামনে অবস্থানরত আন্দোলনকারীদের জন্য বিশেষ নাস্তার আয়োজন করেন। সেই নাস্তায় মিষ্টান্নও ছিল। তাদের হয়তো ধারণা ছিল, ২৩ আগস্ট নওয়াজ শরিফের ক্ষমতার শেষ দিন। কিন্তু ওই দিন দুপুরেই পিপলস পার্টির প্রধান আসিফ আলি জারদারি লাহোরে নওয়াজ শরিফের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। নওয়াজকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন এবং আন্দোলনকারী যারা তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন তাদেরও সঙ্গেও আলোচনার কথা বলেন।
এটা সত্য যে, আন্দোলনকারীরা আসিফ আলি জারদারির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তাকে এটা বুঝিয়েছিলেন যে, তিনি ইমরান খানকে সহযোগিতা করলে সিন্ধু প্রদেশে পুনরায় তার দল শাসনক্ষমতায় আসতে পারবে। কিন্তু পিপলস পার্টি ও এমকিউএম নিজেদেরকে এটা থেকে দূরে রাখে। উভয় দলেরই নওয়াজ শরিফের প্রতি নানা অভিযোগ রয়েছে। তবে তারা মনে করেন, পাঞ্জাবের রাজনীতিকদের একটি অংশ পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়ছে। যাদের দূরদৃষ্টি অনেক ক্ষীণ এবং তাদের এটা ধারণা নেই যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা উপর-নিচ হলে পাকিস্তানে কী অবস্থার সৃষ্টি হবে। ২৩ আগস্ট সন্ধ্যা পর্যন্ত নওয়াজ শরিফের পদত্যাগের কোনো ঘোষণা তো আসেইনি; তবে ইমরান খানের এই ঘোষণা এসেছে যে, তিনি নতুন পাকিস্তান এজন্য বানাতে চাচ্ছেন যাতে পুনরায় বিয়ে করতে পারেন। তবে এটা জানা নেই, বিয়ের জন্য নতুন পাকিস্তানের শর্ত হবু ভাবী আরোপ করেছেন, নাকি অন্য কেউ।
২৩ আগস্ট রাতে তাহরিকে ইনসাফের ওই নেতা আমাকে পুনরায় ফোন দেন এবং পিপলস পার্টি তাদের ধোঁকা দিয়েছে বলে অভিযোগ করেন। আজ (২৪ আগস্ট) সকালে ওই নেতা আমাকে আবার ফোন দিয়ে বলেন, এবার বুঝে এসেছে যাবতীয় এই খেলা ইমরান খানকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর জন্য নয় বরং সোনিয়া গান্ধী বানানোর জন্য ছিল। আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এর কী উদ্দেশ্য? তিনি বললেন, আমাদের দলে প্রধানমন্ত্রী হতে দুই তিনজনের মধ্যে প্রতিযোগিতা রয়েছে। তারা পরস্পরের ওপর গভীর দৃষ্টি রাখেন। তাদেরই একজন অন্যজনের ব্যাপারে অভিযোগ করেছেন, ওই নেতা ইমরান খানকে আশ্বস্ত করেছেন যে, ২৩ আগস্ট নওয়াজ শরিফের পতন হয়ে যাবে। আর তার দুরভিসন্ধি ছিল, মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে ইমরান খানকে আইনের ৬২ ও ৬৩ ধারা মোতাবেক আদালতের মাধ্যমে অযোগ্য প্রমাণ করে তিনিই প্রধানমন্ত্রীর পদ দখল করবেন। আর সোনিয়া গান্ধীর মতো ইমরান খান দলীয় প্রধান হিসেবে ঘরে বসে দলের দেখাশোনা করবেন। ওই নেতাই বুঝিয়ে ইমরান খানকে পার্লামেন্ট থেকেও ইস্তফা দিতে বাধ্য করেছেন।
২৫ আগস্ট ২০১৪ সোমবার পাকিস্তানের দৈনিক জং-এ প্রকাশিত উর্দু থেকে অনুবাদ