প্রতিটি ভূখণ্ডই আজ কারবালা, প্রতিটি মুহূর্তই আশুরা

aura‘কারবালা’ একটি ঐতিহাসিক শব্দ। ইতিহাসের লোমহর্ষক ট্রাজেডি বুকে ধারণ করে আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কারবালা। ক্যালেন্ডারের পাতা ঘুরে প্রতি বছর এ অধ্যায়টি আমাদের দুয়ারে এসে হাজির হয়। আমাদের ঘুমন্ত হৃদয়ে সাড়া জাগায়। পেছনের দিকে ফিরে তাকানোর সুযোগ করে দেয়। নতুন চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার জন্য আন্দোলিত করে। ‘কারবালা’ যার মূলে রয়েছে এক ফোয়ারা রক্তের করুণ ইতিবৃত্ত। প্রিয়জনকে হারানোর অসহনীয় ব্যাথা। প্রিয়নবীর প্রিয় দৌহিত্রের তাজা খুনে লেখা রক্তস্নাত ইতিকথা। নিষ্পাপ শিশু জয়নুল আবেদীনের কোমল দেহ থেকে প্রবাহিত খুনের বারিধারা। আহলে বায়াতের পূত-পবিত্র রমণীদের করুণ আর্তনাদ। পিপাসায় কাতর নিরপরাধ শিশুদের কলিজাফাটা চিৎকার। অপরদিকে ইয়াজিদ-শিমার-যিয়াদদের অট্টহাসি। ধ্বংসাত্মক তা-বলীলা। আর মজলুমের খুনে হাত রঞ্জিত করে ঔদ্ধত্যের বাহাদুরি।
‘কারবালা’ দুটি ধারার উৎসমূল। একটি ইয়াজিদি ধারা, অন্যটি হোসাইনি ধারা। ইয়াজিদ জুলুম, অত্যাচার, অসত্য, অন্যায়ের প্রতীক। হোসাইন সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও ইনসাফের প্রতীক। ইয়াজিদ শক্তির মদমত্তে অন্ধত্বের প্রতীক, আর হোসাইন ত্যাগ ও কুরবানীর প্রতীক। ইয়াজিদ অন্ধকার চাপিয়ে দেয়, হোসাইন আলোর দীপ্তি ছড়ায়। ইয়াজিদ সত্যকে, ন্যায়কে ধরাধামে পরাভূত করতে চায়, আর হোসাইন সত্য-ন্যায়ের জন্য যেকোনো ত্যাগ ও কুরবানি করতে প্রস্তুত। ইয়াজিদের আছে ক্ষমতা, আছে অর্থ কিন্তু সত্য থেকে দূরে, চরিত্রে সে রিক্ত। হোসাইনের সম্পদ ক্ষমতা নেই, আছে সত্য, আছে চরিত্র। ইয়াজিদ দানবীয় শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে, হোসাইন করে মানবীয় শক্তির প্রতিনিধিত্ব। ইয়াজিদি ধারা মানে ভোগের ধারা, হোসাইনি ধারা মানে ত্যাগের ধারা। ইয়াজিদ রক্ত নিতে পারে, হোসাইন রক্ত দিতে পারে। ইয়াজিদ রক্ত নিয়ে সফল হতে চায়, হোসাইন রক্ত দিয়ে সফল হতে চায়। ইয়াজিদের হিসাব অর্থ, সম্পদ, ক্ষমতা। হোসাইনের হিসাব সত্য, ন্যায়, মানবতা। ইয়াজিদের অবস্থান মানবতার বিপক্ষে, হোসাইনের অবস্থান মানবতার স্বপক্ষে। যুগ থেকে যুগান্তরে হোসাইন স্থান করে নিয়েছে মানবতার মনের মুকুরে। আর ইয়াজিদ নিক্ষিপ্ত ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। ইয়াজিদ ছড়ায় দুর্গন্ধ, হোসাইন ছড়ায় সত্যের সুবাস! ইতিহাসের অন্ধকার গলি দিয়ে চলছে ইয়াাজিদ, আর হোসাইন চলছে আলোকজ্জ্বল রাজপথ দিয়ে। তাইতো বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান হোসাইনকে আজ গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে থাকে। আর ইয়াজিদকে  করে চরম ঘৃণার সঙ্গে।
কারবালা ট্রাজেডির ন্যাক্কারজনক অধ্যায় ইসলামী ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল স্তম্ভকে করে দিয়েছিল নড়বড়ে। ‘খেলাফত আলা মিনহাজিন নবুওয়্যাহর’ সুমহান আদর্শকে করে দিয়েছিল ল-ভ-। হকের বিজয় কেতনকে করতে চেয়েছিল ধরাশায়ী। কিন্তু সত্য ন্যায়ের সুমহান আদর্শকে দমাতে পারেনি ইয়াজিদি বাহিনীর হিংস্র বর্বরতা। ইয়াজিদের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে হোসাইন তাঁর আদর্শে অবিচল থেকেছেন। নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়েও আপসকামিতার পরিচয় দেননি। তিনি তো জান্নাতের যুবকদের সরদার। আর যৌবনের দাবি তো আপস নয়। যৌবনের দাবিই তো হলো শিরশ্চেদ হলেও বাতিলের সামনে মাথা নত না করা। আর তিনি তো ক্ষমতার মোহে আবদ্ধ হননি। খলিফা হওয়ার সাধ তো তার মধ্যে ক্ষণিকের জন্যও জাগেনি। তার হিসাব তো আদর্শিকতার। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার। তাইতো তিনি জগৎবাসীর জন্য আদর্শের প্রতীক। ঈমানদীপ্ত চেতনার অনন্ত উৎস।
হাজার বছর পেরিয়ে গেলেও কারবালার কটুস্মৃতি আজও ঈমানদীপ্ত চেতনার গভীরে প্রতিনিয়ত সাড়া জাগায়। ফোরাতের তীরের সেই করুণ দৃশ্য আজও তাদের বিবেককে রক্তাক্ত করে। মানবতার নিষ্ঠুর দুশমনদের প্রতি ঘৃণা জন্মায়। ইয়াজিদশাহীর সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রের জন্য ক্ষোভ প্রদর্শন করে। তাদের অন্তরের ক্ষত শুকিয়ে যায়নি আজও। মহররম এলেই মুমিনের চেতনা নব আঙ্গিকে জেগে উঠে। কারবালা ট্রাজেডিকে নিয়ে নতুন করে ভাবে। হ্যা! ঈমানের দাবি তো তাই। সত্য-ন্যায়ের পক্ষাবম্বনই তো বাঞ্ছনীয়। আদর্শিকতার প্রতীককে আঁখড়ে ধরাই তো সঠিক সিদ্ধান্ত।
প্রতি বছরই কারবালা আসে যায়। কিন্তু কী তার দাবি, তার চাওয়া পাওয়া কী, তা আমাদের কাছে অজানা থেকে যায়। তা থেকে শিক্ষা প্রহণ করার কোনো চেতনা আমাদের নেই। অথচ রক্তভেজা সেই কারবালার ঘটনায় আমাদের জন্য রয়েছে মহান শিক্ষা। জীবনচলার অনন্য পাথেয়। ফোরাতের কূলঘেষে বিস্তৃত কারবালা আজও নীরব ভাষায় মুসলিম মিল্লাতকে আহ্বান করছে। আগামী দিনের চলার পথে গতি সঞ্চালন করছে। কী সেই আহ্বান? কী সেই চেতনা? সেই আহ্বান হলো বাতিলের রক্তচোখে আতঙ্কিত না হওয়ার। অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার। সত্য-ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত হওয়ার। মুনাফিক-গাদ্দারদের মুখোশ উন্মোচিত করে সঠিকভাবে চিহ্নিত করার। নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে হলেও নিজ আদর্শে শীশাঢালা প্রাচীরের মতো দৃঢ়পদ থাকার। শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় মানবতাবিরোধী অভিশপ্তদের সঙ্গে আমরণ সংগ্রামে রত থাকার। খোদাপ্রদত্ত মহাতন্ত্র ‘খেলাফত আলা মিনহাজিন নবুওয়াহ’ প্রতিষ্ঠায় হোসাইনি ত্যাগের সুমহান ধারা বাস্তবায়নের। শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে শির উঁচু করে দাঁড়ানোর।
কিন্তু আজকের কারবালার পরিধি তার নির্ধারিত পরিম-লে সীমাবদ্ধ নয়। ফোরাতের তীর ভেদ করে সারা বিশ্বে তার আয়তন বৃদ্ধি পেয়েছে। আজকের পৃথিবীর প্রতিটি ভূখ-ই কারবালা। প্রতিটি মুহূর্তই আশুরা। প্রতিটি মুসলিম জনপদই ইয়াজিদ শিমারদের নির্যাতনের স্টিম রোলারে পিষ্ঠ। দিকে দিকে তাদেরই দৌরাত্ম। কারবালার অসহায় রমণীদের আর্তনাদ আজকে ভেসে আসছে ভূস্বর্গ কাশ্মীরের প্রতিটি গুহা থেকে। নিষ্পাপ শিশুদের গগনবিদারী আর্ত-চিৎকার শোনা যাচ্ছে বাস্তুহারা বসনিয়ার প্রতিটি পরিবারে। যিয়াদ শিমারদের বুলেটের আঘাতে জাজরা হচ্ছে ফিলিস্তিনের নিরপরাধ শিশুদের বুক। এক ফোটা পানি আর সামান্য অন্নের জন্য বুকফাটা কান্না ভেসে আসছে বোমায় জর্জরিত আফগান থেকে। নীড়হারা পাখির মতো ছুটাছুটি করছে ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়ার জনগণ। কসোভো, চেচনিয়া, হার্জেগোবিনাসহ মুসলিম অধ্যুষিত প্রতিটি জনপদই ইয়াজিদি তা-বের শিকার।
কারবালা থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্য আর ফোরাতের তীরে যেতে হয় না। পৃথিবীর যেকোনো স্থানে দৃষ্টি দিলেই তা অর্জিত হয়। তাই ঈমানদারদের আজ কারবালাকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। কারবাল ট্রাজেডির অঘোষিত আহ্বান উপলব্ধি করতে হবে। নতুন চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে কারবালার শোণিত ধারায় গতি সঞ্চালন করতে হবে। হোসাইনি আদর্শ বাস্তবায়নে আত্মনিয়োগ করতে হবে। ইয়াজিদ শিমারদের হিংস্র ছোবল থেকে মানবতাকে মুক্তি দিতে হবে। তবেই কারবালার ট্রাজেডি হবে সার্থক। হোসাইনি ত্যাগের হবে সঠিক মূল্যায়ন। মুসলিম মিল্লাতের সামনে উন্মোচিত হবে নতুন দিগন্ত।

*

*

Top