আমাদের জীবনপ্রবাহে শিল্প-সাহিত্যের ভূমিকার কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিছু কিছু অঙ্গনে মানুষ একান্তই মনন ও চেতনার বুদ্বুদের ভেতর নিজেকে আবিষ্কার করে। মানুষের নিজস্ব এ ভাবনা শিল্পরূপে প্রকাশ ঘটে। প্রত্যেক মানুষের ভেতরেই একটা শিল্পমন কাজ করে। মানুষ যদি ভেতরের শিল্পিত এ মনকে উপযুক্ত পরিচর্যা করে তবেই তা মোহ ও মাধুর্যের মাদকতায় অন্যকে আকৃষ্ট করে। সাহিত্য শিল্পেরই একটি যৌলুসপূর্ণ ধারা যা মানুষকে মোহিত করে অতি সহজে। শিল্প-সাহিত্যের এই অঙ্গনটি বরাবরই শক্তির আধার। একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বায়নের যুগে এ শক্তিতে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। সময়ের পটপরিবর্তনের ফলে বর্তমানে সামরিক শক্তির মহড়া দেখিয়ে দেশ দখলের রেওয়াজ খুব একটা নেই। বর্তমানে বিশ্বের পরাশক্তি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদও তাদের সামরিক শক্তিকে যতটা না কাজে লাগাচ্ছে তার চেয়ে বেশি শক্তি প্রয়োগ করছে শিল্প-সাহিত্যের এ অঙ্গনটিতে।
বর্তমান বিশ্বে এ কথা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, লাখ লাখ সৈন্য যা না করতে পারে তা দু’চারটি প্রচার মিডিয়া ও পত্রিকা দ্বারা করা সম্ভব। বর্তমান বিশ্বকে পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে মিডিয়া। মিডিয়ার অফুরন্ত শক্তির দ্বারাই বিশ্ব তাগুতি শক্তি প্রতিনিয়ত মানুষের বোধ, বিশ্বাস ও শাশ্বত মূল্যবোধে আঘাত হানছে। শৈল্পিক মিশেলের কারণে তাদের সেই আঘাত অধিক ক্রিয়াশীল। আমাদের বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের দিকে তাকালে নষ্ট ধারার প্রাধান্যই নজরে ভাসবে। বোধ ও বিশ্বাসে যারা আবিলতা লালন করে তারাই এখানে আধিপত্য বিস্তার করে আসছে। কারণ বিশ্বাস ও মূল্যবোধের কাছে যাদের দায়বদ্ধতা আছে তারা এমন কোনো বলয় গড়ে তুলতে পারেননি যাতে তারা প্রত্যয়ী ও সুদৃঢ়। ফলে যারা আদর্শকে লালন করতে চায়, বিশ্বাস ও মূল্যবোধ যাদের প্রত্যাশিত তারা প্রতিনিয়ত নিজেদের বিবেক ও চেতনার কাছে পরাজিত হচ্ছেন। সার্বিকভাবে ক্ষতি হচ্ছে আদর্শিক ধারার, সুস্থ ও শালীন প্রবাহের।
দুই.
‘আজ রক্তের জিহাদের যত না প্রয়োজন চিন্তার জিহাদের প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক বেশি। ধারালো তলোয়ারের যত প্রয়োজন শাণিত কলমের প্রয়োজন আরো বেশি। কেননা নবুওয়াতে মুহাম্মদীর ওপর আজ তলোয়ারের হামলা যতটা না চলছে, তার চেয়ে অধিক চলছে যুক্তি-প্রমাণের হামলা, চিন্তা ও দর্শনের মামলা।’ উপরোক্ত কথাগুলো বলেছেন বিংশ শতাব্দীর মহান সংস্কারক সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.। আল্লাহ তাআলা এই মহান সাধককে জান্নাতে উচ্চ মাকাম দান করুন। তাঁর হৃদয়কাড়া আকুতি ও উদাত্ত আহবানে উদ্বুদ্ধ হয়েই বাংলার আলেমরা ব্যাপকভাবে কলম হাতে নিয়েছিলেন। ১৯৮৪ এবং ১৯৯৪ সালে দু’বার তিনি বাংলাদেশে সফরে এসেছিলেন। বাংলাদেশের শিল্প ও সাহিত্যাঙ্গনে ওলামায়ে কেরামের নিদারুণ অনুপস্থিতি তাঁকে যুগপৎ ব্যথিত ও বিস্মিত করেছিল। এজন্য দু’বারই তিনি বিভিন্ন স্থানে আলেমদেরকে খেতাব করতে গিয়ে কলম হাতে তুলে নেয়ার উদাত্ত আহবান জানিয়েছিলেন।
যুগের মুজাদ্দিদ এই মহামনীষীর হৃদয়ের আকুতি ও আহবান এদেশের আলেমদের চেতনাকাশে নতুন দিগন্তের সূচনা করে। অলসতা ও নিস্পৃহতার চাদরে মুড়ি দিয়ে সুখনিদ্রায় বিভোর আলেম সমাজ জাগতে শুরু করে। নতুন দিনের নতুন জিহাদে শরীক হওয়ার স্পৃহা নিয়ে কলম হাতে তুলে নেয়। ক্ষীণ কালির দুর্বল খসখসে কাগজে আঁকাআঁকির মাধ্যমে শূন্য থেকে শুরু হয় তাদের পথচলা। দীর্ঘ দেড় দু’দশকের বিক্ষিপ্ত প্রয়াসের ফলে বাংলা সাহিত্যের সুরভিত অঙ্গনে আলেমসমাজের অংশিদারিত্ব আজ সিকি ভাগ বলা যায়। এটা আশানুরূপ না হলেও অন্তত হতাশাব্যঞ্জক নয়। সূচিত ধারা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলা সাহিত্যের নেতৃত্বের ভার আদর্শিক ও বিশ্বাসদীপ্ত ধারার সাহিত্যিকদের হাতে ন্যস্ত হবেÑএ কথা বলা যায় জোর গলায়। বাঞ্ছিত ধারার শিল্প-সাহিত্যের সাম্প্রতিক আয়োজন সে দিকেই আলোর ইশারা দিয়ে যায়। সূচিত ধারায় গতি সঞ্চালন করে সাফল্যের দোড়গোড়ায় পৌঁছা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমরা স্বপ্ন পুষতে শুরু করেছি। এ স্বপ্ন পূর্ণতা পেয়ে আলোকোজ্জ্বল চ্ছটায় বিমোহিত করবে সবাইকেÑএটাই একান্ত প্রত্যাশা।
তিন.
তবে আশার কথা হলো, শিল্প-সাহিত্যের শালীন, আদর্শিক, বাঞ্ছিত ও বিশ্বাসদীপ্ত অঙ্গনটা আজ আর সঙ্কুচিত নয়। দিগন্তপ্রসারী না হলেও এর বি¯তৃতি দৃষ্টিসীমা স্পর্শ করবে। নষ্টামী ও কুরুচিপূর্ণ কথ্য ও লেখ্য সাহিত্যের যেখানে ছড়াছড়ি সেখানে বোধ ও বিশ্বাসের ওপর নির্মিত সাহিত্যের স্থান করে নেয়াটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। আমরা যারা আমাদের বিশ্বাস ও আদর্শের কাছে দায়বদ্ধ তারা এ চ্যালেঞ্জে সফল হয়েছি বলতেই হবে। আজ আমাদের অঙ্গনে আমাদের সদর্প পদচারণা চোখে পড়ার মতো। বাংলাবাজার ও বায়তুল মোকাররমকেন্দ্রিক ইসলামী বইয়ের বিশাল যে বাজার গড়ে উঠেছে তা মানের বিচারে না হলেও সংখ্যায় কোনোক্রমেই প্রচলিত ধারার তথাকথিত বস্তুবাদী সাহিত্যের চেয়ে কম নয়। ইসলামী প্রকাশনা জগতে প্রতিদিনই কিছু না কিছু সংযুক্তি ঘটছে, বিশ্বাসীদের পঠন-পাঠনের উপকরণে সমৃদ্ধি হচ্ছে। এর অধিকাংশই অনুবাদ ও সংকলননির্ভর হলেও এটাকে একদম তুচ্ছজ্ঞান করার সুযোগ নেই। সমৃদ্ধ ও সহজলভ্য কোনো ভাষার রূপান্তর যদি মানুষের প্রয়োজন পূরণে সহায়ক হয় তবে তাতে দোষের কী? বিষয়টিকে আমরা ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দৃষ্টিকোণেই বিশ্লেষণ করতে পারি। তবে আমাদের অতীত বিবেচনা করলে এর ইতিবাচক বিশ্লেষণই যুক্তিযুক্ত মনে হবে। কারণ এক যুগ আগেও ইসলামী প্রকাশনার এই বিশাল বাজার ও ব্যাপক চাহিদার কথা কল্পনা করা যেতো না। সংখ্যায় যেহেতু আমরা একটি সন্তোষজনক পর্যায়ে উপনীত হতে পেরেছি, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস আমরা মানের বিচারেও অদূর ভবিষ্যতে কাক্সিক্ষত মানে উন্নীত হতে পারব ইনশাআল্লাহ। হতাশার অদৃশ্য চাদরে আচ্ছাদিত না থেকে এখন আমাদের উচিত প্রত্যাশার দিগন্তবিস্তৃত স্বপ্নিল ভুবনে বিচরণ করা।
সাম্প্রতিক সময়ে বাঞ্ছিত ও আদর্শিক ধারার প্রকাশনার ব্যাপ্তির পাশাপাশি মিডিয়াক্ষেত্রেও এর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তৃত হয়েছে। বিশেষত প্রিন্ট মিডিয়ায় ইসলামী ধারার একটি বলয় গড়ে উঠেছে। দৈনিক না হলেও সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক মিলিয়ে প্রায় অর্ধশতাধিক ম্যাগাজিন-সাময়িকী নিয়মিত আদর্শ ও বিশ্বাসের বিভা ছড়িয়ে যাচ্ছে। বিগত এক দু’ বছরের মধ্যেই বেশ কয়েকটি ইসলামী পত্রিকা বাজারে এসেছে এবং মোটামুটি দৃঢ়তার সঙ্গে টিকে আছে। শত প্রতিকূলতার মধ্যে একটি মাসিক পত্রিকাও নিয়মিত প্রকাশ করা চাট্টিখানি কথা নয়। যারা এ শিল্পটির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত তারা জানেন বর্তমান বাজারে প্রতি মাসে একটি পত্রিকা পাঠকের হাতে তুলে দেয়াও যে কত কঠিন ও দুরূহ কাজ। কঠোর সাধনা, অদম্য স্পৃহা, নির্দিষ্ট টার্গেট এবং প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করার মনোবল ও প্রত্যয় না থাকলে কেউ এ ক্ষেত্রে সফল হতে পারবে না। বাংলাদেশে যারা আদর্শিক ও বাঞ্ছিত ধারার এ ক্ষেত্রটিতে কাজ করে যাচ্ছেন তারা অবশ্যই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। প্রত্যেকের উচিত যথাসাধ্য তাদেরকে সহযোগিতা করে যাওয়া।