আমাদের ধর্মীয়, সামাজিক ও জাতীয় জীবনের নানা প্রান্তে আলো ফেলে যাওয়া মনীষী ও আকাবিরের সংখ্যা কম নয়। সবুজ-শ্যামল এই বাংলায় দূর-আরব থেকে ইসলামের শাশ্বত আলোকবিন্দুটির বিচ্ছুরণের নেপথ্যে রয়েছে তাদের সুবিশাল অবদান। ইসলাম ও দ্বীনের প্রতিষ্ঠাই ছিল তাদের জীবনের একমাত্র মিশন ও ভিশন। তাদের শিকড় এদেশের মাটি, মানুষ ও প্রকৃতির গভীরে প্রোথিত। , শুধু এদেশ নয়, সারা দুনিয়া গর্ব করতে পারার মতো ব্যক্তিত্ব বিগত হয়েছেন আমাদের দেশে। তাদের বিরামহীন সাধনা, অসাধারণ গ্রহণযোগ্যতা এবং ইখলাস ও লিল্লাহিয়াতের ওসিলায় আমরা এখনও আমাদের অস্তিত্ব¡ নিয়ে টিকে আছি। অন্ততঃ আত্মপরিচয়ের কোনো সংকটে আমাদের ভুগতে হয় না।
তবে আফসোসের বিষয় হলো, তারা একে একে সবাই বিস্মৃতির আঁধারে তলিয়ে গেছেন। কারণ, আমরা ঋণের দায়স্বরূপ তাদের জীবন, কর্ম ও সাধনাকে আমাদের মধ্যে জীবন্ত করে রাখতে পারিনি। তাদের রোপন করা গাছের ফল ভোগ করছি, ফুলের সৌরভ নিচ্ছি, কিন্তু তাদের কথা বেমালুম ভুলে আছি। শতাব্দী নয়, কয়েক যুগ আগে চলে যাওয়া কোনো মুসলিম মনীষী সম্পর্কে যদি আজকের প্রজন্ম জানতে চায়Ñব্যর্থ হবে। তাকে অতৃপ্ত থাকতে হবে। এমন কোনো উপকরণ কিংবা পঠন সামগ্রী পাবে না যা দ্বারা ওই মনীষীর জীবন ও কর্মের ওপর একটা সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। কালের গর্ভে লীন হয়ে যাওয়া এ ধরনের কত মনীষীর ঋণের দায় যে আমাদের কাঁধে চেপে আছে এর কোনো হিসাব নেই!
জাতি হিসেবে আমাদের একটা বদনাম আছেÑআমরা অকৃতজ্ঞ। আমাদের প্রতি যাদের দান বিশাল, কৃপা অগণন, তাদের ঋণের দায়বোধ আমাদেরকে তাড়িত করে না। আমাদের অস্তিত্বের শিকড়ে, বিকাশের বাঁকে বাঁকে যাদের অবদান তারাই আমাদের থেকে বিস্মৃত হয়ে যান। এভাবে তাদের অবদানের কথা, রেখে যাওয়া আদর্শ, জীবন ও সাধনা হারিয়ে যায় কালের গর্ভে। বিকৃত এই কালচার চলে আসছে বহুদিন থেকে। জাতি হিসেবে এটা আমাদের জন্য অপমান ও লজ্জার। অপরিণামদর্শী, বিবেচনাহীন, স্বার্থান্ধ কোনো জাতির পক্ষেই কেবল তা মানায়।
আকাবিরের স্মৃৃতি হেফাজত, তাদের জীবন ও কর্মকে আলোচনায় এনে জীবন্ত করে রাখার ইতিবাচক, প্রশংসনীয় ও যথার্থ এই প্রয়াস ব্যাপকভাবে কার্যকর রয়েছে আমাদের পাশের দেশ ভারত ও পাকিস্তানে। সেখানকার কোনো আলেম, বুযুর্গ, বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব ইন্তেকালের কয়েক দিনের মধ্যেই ডাউস সাইজের স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ পেয়ে যায়। জীবিত থাকতে তিনি যত আলোচিত ও চর্চিত হন তার চেয়ে বেশি চর্চায় আসেন ইন্তেকালের পর। অপেক্ষাকৃত অপ্রসিদ্ধ ও অকেন্দ্রীয় বুযুর্গেরও অজানা এমন কিছু দিক উঠে আসে যা তার অনুসারীদের আপ্লুত করে, জীবনপথের পাথেয় যোগায়। সেখানকার মাসিক, পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক সাময়িকীগুলোও স্বতন্ত্রভাবে স্মরণ সংখ্যা বের করে। তাদের পত্রিকার কোনো কোনো স্মরণসংখ্যাও আমাদের দেশের স্মারকগ্রন্থগুলো থেকে অনেক বেশি প্রামাণ্য, তথ্যবহুল ও সমৃদ্ধ। আমাদের দেশে সে কালচারটা এখনও গড়ে উঠেনি।
ভারত-পাকিস্তানের বুযুর্গদের আমরা অসম্ভব রকম ভক্তি করি, তাদের প্রতি সর্বোতভাবে নিবেদিত হই, কিন্তু তাদের কর্মপন্থা গ্রহণের তাগিদ অনুভব করি না। তাদের দৃষ্টির সূক্ষতা, চিন্তার উদারতা, সময়চেতনা আমাদের মধ্যে ছাপ ফেলে না। আমাদের বুযুর্গানে দ্বীন ও ওলামায়ে কেরামের মধ্যে লেখালেখির অভ্যাসটা এমনিতেই কম। আর যারা লিখতে জানেন তারাও নিজের জীবনকথা সংরক্ষণ করার প্রয়োজন অনুভব করেন না, স্মৃতিকথা লেখেন না। শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রহ. রচিত স্মৃতি ও আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘আপবিতিহ’ পড়ে উজ্জীবিত ও মুগ্ধ হননি এমন আলেম-বুযুর্গ খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাদের মুখে মুখে এ কালজয়ী গ্রন্থটির প্রশংসা শোনা যায়। কিন্তু তাদের নিজেদেরও যে বিচিত্রধর্মী সমৃদ্ধ একটি জীবন আছে, তারাও যে স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার ওপর ভর করে এমন কিতাব রচনা করতে পারেন সে অনুভূতিটুকু কারো মধ্যে কার্যকর দেখি না। কেউ তার নিজের জীবনকে যেভাবে উপলব্ধি করেন তার বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা তিনি নিজে ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের আকাবিরের স্মৃতি সংরক্ষণ না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো উপাত্ত-উপকরণের স্বল্পতা। তারা নিজেরা জীবদ্দশায় যেমন নিজেদের জীবনকথা লেখার তাগিদ অনুভব করেন না, তেমনি তাদের উত্তরসূরিরাও এ ক্ষেত্রে তেমন মনোযোগী হন না। এভাবেই অবজ্ঞা-অবহেলায় আকাবিরের জীবন, কর্ম ও সাধনা তলিয়ে যাচ্ছে কালের অতল গর্ভে।
তবে আশার কথা হলো, সাম্প্রতিক বাংলাদেশে আকাবিরের বিশাল ঋণের দায় থেকে মুক্তি পাবার কিছুটা প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নিকট অতীতে চলে যাওয়া বুযুর্গ আলেমদের ওপর ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি প্রামাণ্য স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় আরো বেশ কয়েকটি স্মারকগ্রন্থের কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। বুযুর্গানে দ্বীনের স্মৃতি ও অবদানকে স্মরণীয় করে রাখার ক্ষেত্রে এটি একটি ইতিবাচক দিক।
নতুন প্রজন্মের কাছে চলে যাওয়া মনীষীদের তুলে ধরার ক্ষেত্রে এখনই আন্তরিক না হলে প্রাচীন প্রদীপতুল্য মুরব্বিরা হারিয়ে যাবেন বিস্মৃতির গভীরে। আমাদের স্বার্থেই এই প্রদীপগুলো জ্বালিয়ে রাখতে হবে। ধর্মীয়, সামাজিক ও জাতীয়ভাবে অবদান রেখেছেন এমন মনীষীদের জীবন ও কর্ম পাঠ্যভুক্ত করার বিষয়টি খুব কঠিন কিছু না। অন্ততঃ কওমী মাদরাসাগুলোর যে কয়টি বোর্ড রয়েছে তাদের সিলেবাসে আমাদের দেশের চলে যাওয়া শীর্ষ আলেমদের জীবন ও কর্মের সংক্ষিপ্ত বিবরণ থাকতে পারে। শুধু পাঠ্যই নয়, বিশিষ্ট আলেমদের জীবন ও চিন্তাধারার ওপর পাঠচক্রও হতে পারে। থাকতে পারে তাদের প্রত্যেকের নামে পৃথক পৃথক পাঠাগার। তাদের জীবনীগ্রন্থ ও রচনার ওপর দেশব্যাপী বইপড়া প্রতিযোগিতাও হতে পারে। এককথায় তাদের জীবনচর্চার ধারা যত সজীব করা যায় ততই ভালো। তাদের অবদান ও কীর্তি যত ছড়িয়ে দেয়া যায় ততই মঙ্গল। আর এটা আকাবিরের কোনো স্বার্থে নয়, আমাদের নিজেদেরই স্বার্থে, আগামী প্রজন্মের পথচলাকে আরো বাঞ্ছিত ও সাবলিল করতে।