বর্ষবরণে বস্ত্রহরণ, একমুঠো ভাবনা

Zahir Babor Picবাংলা নববর্ষ উপলক্ষে মাতামাতিটা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন একটু বেশি। তথাকথিত বাঙালি সংস্কৃতির নামে প্রতি বছর এতে যোগ হয় নতুন মাত্রা। মিডিয়া আর বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর উস্কানিতে এখন বাংলা নববর্ষের দিন ঢাকা শহরের বেশির ভাগ নারী-পুরুষই রাস্তায় বেরিয়ে যান। ৩৬৪ দিন ঢাকা শহর সচল থাকলেও একদিন মোটামুটি অচল হয়ে যায়। পয়লা বৈশাখ রাজধানীর রাস্তা বের হওয়া যে কী দুর্ভোগের তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ কল্পনাও করতে পারবেন না। পয়লা বৈশাখে রাজধানীর চিত্র দেখলে এটি কোনো মুসলিম দেশ তা ভাবতে কষ্ট লাগে। বেলেল্লাপনা, বেহায়াপনা ও নোংরামির যত ধরণ হতে পারে পয়লা বৈশাখে মোটামুটি তা দৃশ্যমান হয়। হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির সদর্প মহড়া চলে ৯০ ভাগ মুসলমানের এদেশে। চলমান এই স্রোতের বিরুদ্ধে কিছু বললেই মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক, কুপমণ্ডুক আরও কত উপাধি ভাগ্যে জুটে। এজন্য পারতপক্ষে পয়লা বৈশাখের চলমান সংস্কৃতির বিপক্ষে জোরালো কোনো আওয়াজ ওঠে না।

তবে এবারের তথাকথিত বর্ষবরণ একটু ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ট খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় কিছু উচ্ছৃঙ্খল যুবক মেয়েদের শ্লীলতাহানি ঘটিয়েছে। মিডিয়া প্রথমে বিষয়টিকে ‘স্বাভাবিক ঘটনা’ হিসেবে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা ব্যাপক সাড়া ফেলায় এড়িয়ে যেতে পারেনি। এজন্য দেরিতে হলেও বেশির ভাগ মিডিয়া ওই দিনের ঘটনাটিকে হাইলাইটস করেছে। সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে ‘সুশিক্ষিত’ তথাকথিত মুক্তমনা মানুষদের ভিড়ে এই অসভ্যতা নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। ওই দিন ঠিক কতজন নারী তাদের মহামূল্যবান সম্ভ্রম টিএসসিতে হারিয়ে এসেছেন তার বিস্তারিত জানা যায়নি। এই ঘটনার সঙ্গে কোন সংগঠনের সোনার ছেলেরা জড়িত তা মোটামুটি দেশবাসী জেনে গেছে। এক মাসের বেশি সময় শাহবাগে জড়াজড়ি আর আমোদ-ফূর্তি করে স্লোগানে মাতানো তথাকথিত অগ্নিকন্যাও এই ঘটনার বিপক্ষে সোচ্চার হয়েছেন। বামপন্থী একটি ছাত্র সংগঠনের নেতারা নাকি এই অসভ্যতায় বাধা দিতে গিয়ে প্রহত হয়েছেন-এ নিয়ে তারা প্রতিবাদ সভাও করেছে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে আরও দুটি খ্যাতনামা বিদ্যাপিঠ জগন্নাথ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও। সেই দুই ঘটনার সঙ্গেও জড়িত একই সংগঠনের সোনার ছেলেরা।

পয়লা বৈশাখে টিএসসি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে এবং জাহাঙ্গীরনগরের ক্যাম্পাসে যে ঘটনা ঘটেছে তা নিঃসন্দেহে জঘন্য। এর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচার হওয়া দরকার। তবে এদেশের সিংহভাগ মানুষ দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করে এর সঙ্গে জড়িত কারও বিচার হবে না। কয়েক দিন মিডিয়ায় চর্চিত হওয়া ছাড়া আর কিছুই হবে না। এ ধরনের ঘটনা যে এবারই ঘটেছে তাও কিন্তু নয়। ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর থার্টিফার্স্ট নাইটে সেই টিএসসিতেই নায়িকা বাঁধনকে শত শত মানুষের সামনে কিভাবে উলঙ্গ করা হয়েছিল সে দৃশ্য বিশ্ববাসী দেখেছে। আজকে যারা ক্ষমতায় তখনও তারাই ছিল ক্ষমতার মসনদে। আজকের ঘটনার সঙ্গে সে ছাত্র সংগঠনটির সোনার ছেলেরা জড়িত সেই ঘটনায়ও তারাই জড়িত ছিল। সেই ঘটনার পরও তদন্ত কমিটি আর লোকদেখানো মামলা হয়েছিল। কিন্তু কিছুই হয়নি। এবারও তদন্ত কমিটি আর লোকদেখানো মামলা হয়েছে। তবে সবাই নিশ্চিত থাকতে পারেন, এতে কিছুই হবে না।

দুই.

আলো-আঁধারিতে বস্ত্রহরণের একটি বা দুটি ঘটনা বাদে তথাকথিত বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের বাকি আয়োজনগুলো কি সমর্থনযোগ্য? এদেশে সিংহভাগ মানুষের বোধ, বিশ্বাস এবং কালচারের সঙ্গে কি এর কোনো যোগসূত্রতা আছে? মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে হিন্দুয়ানি স্টাইলে যে মিছিলটি বের হয় সেখানে কি নারীরা নিরাপদ? রমনা বটমূলে নারী-পুরুষের অবাধ নাচগান, আড্ডা, পান্তা-ইলিশ খাওয়ার আয়োজন এসব স্থানে কি নারীদের প্রতি অসভ্যতা হয় না? কোনো সুস্থ রুচির মানুষ কি তার স্ত্রী, মেয়ে বা বোনকে এসব জায়গায় অবাধে যেতে দিতে পারেন? পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে রমনা, শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কী হয় সে সম্পর্কে সবার জানাশোনা আছে। তবুও তথাকথিত বাঙালিয়ানা, মুক্তমনা ও প্রগতিশীলতা দেখাতে অনেকেই ছুটে যান সেখানে। নিজের স্ত্রী, মেয়ে, বোনকেও পরপুরুষের সঙ্গে অবাধে মেশার সুযোগ করে দেন। এর পরিণতিতে ছোটখাটো ঘটনা ঘটতেই পারে। যেখানে দিনভর নারীরা শ্লীলতাহানির শিকার হচ্ছে সেখানে কয়েকজন বখাটের বখাটেপনাকে খুব বড় করে দেখার তেমন কিছু নেই।

অনেকে ভাবতে পারেন, এত বড় ঘটনাকে আমি হালকাভাবে দেখছি। নিঃসন্দেহে এই ঘটনাটি অনেক বড় এবং তা হালকাভাবে দেখার নয়। কিন্তু এর আগে-পরে পয়লা বৈশাখকেন্দ্রিক যা ঘটে কোনোটাকেই হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। আপনি আপনার স্ত্রী বা মেয়েকে সাজিয়ে-গুজিয়ে, পেট-পিঠ খোলা রেখে রাস্তায় বের হতে দেবেন, অথবা নিজেই নিয়ে যাবেন আর কেউ তা তাকিয়ে দেখবে না তা তো হতে পারে না। পয়লা বৈশাখের সাতসকালে নারীরা যেভাবে ভারী সাজে সজ্জিত হয়ে রাস্তাঘাটে বেরিয়ে পড়ে তাতে তো পুরুষদের মাথা খারাপ হতে বাধ্য। নারীদের ভারী ও গর্জিয়াস সাজ দেখলে এটাকে কুরবানির হাটের পশুর সঙ্গেই তুলনা করা চলে। শুনতে খারাপ লাগলেও বাস্তবতা এটাই। কুরবানির পশু যেমন বাজারে নেয়ার পর অনেকে হাত লাগিয়ে দেখে তেমনি রাস্তাঘাটে বেরিয়ে পড়া বাজারি নারীদের প্রতি লোলুপ দৃষ্টিতে কোনো পুরুষ তাকাতেই পারে। সুযোগ পেলে কেউ হাত লাগালেও তাকে কি খুব বেশি দোষ দেয়া যাবে? ওই দিন নারীরা পুরুষের মাথা খারাপ করার মতো সাজে বাইরে বের হওয়ার উদ্দেশ্য কী? নিশ্চয় নিজের রূপ-লাবণ্য প্রদর্শন করা। সুতরাং সেই রূপ-লাবণ্যে মোহিত হয়ে কেউ ছুঁয়ে দেখতে চাইলে তা যদি অসভ্যতা হয়; এর আগে মেয়েটি যা করেছে তাও অসভ্যতা। আগের অসভ্যতা থামলে পরের অসভ্যতা এমনিতে থেমে যাবে। আগুনের কাছে মোম নেবেন আর তা গলবে না এটা তো হতেই পারে না। সুতরাং মোমবাতিকে অক্ষত রাখতে হলে আগুন থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।

Related posts

*

*

Top