প্রতিষ্ঠার পর এত সংকটে আর কখনও পড়েনি বিএনপি। মূলত ওয়ান ইলেভেনের পরই শোচনীয় অবস্থায় পড়ে দলটি। সে সময় সেনাসমর্থিত সরকারের সবচেয়ে রোষানলে পড়েছিল বিএনপি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে অনেকটা পরিকল্পিতভাবে বিএনপির ভরাডুবির ক্ষেত্র তৈরি করা হয়। ২০০১ সালে দুই তৃতীয়াংশের বেশি আসন নিয়ে ক্ষমতায় আসা দলটি ২০০৮ সালের নির্বাচনে লাভ করে মাত্র ২৯টি আসন। তবুও সংসদে কোনোরকম প্রতিনিধিত্ব টিকিয়ে রাখে দলটি। ২০০৯ থেকে নিয়ে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিরোধী দলে থাকাকালে বিএনপির সামনে নানা ইস্যু আসে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন ছিল তাদের প্রধান দাবি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, যে বিএনপি বিরোধী দলের চাপে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রবর্তনে বাধ্য হয় সেই দলটিই এই ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করছে। আবার যে দলটি নতুন ধারার এই সরকারব্যবস্থা চালুর জন্য দীর্ঘদিন রাজপথে আন্দোলন করেছে তারাই এই ব্যবস্থাটি গলাটিপে হত্যা করেছে। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে বিএনপির আন্দোলন জোরালো রূপ নেয় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে রাজধানী। কিন্তু রাজধানীতে তেমন কোনো আন্দোলনই চোখে পড়েনি। ফলে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সর্বাত্মক আন্দোলন করেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশি-বিদেশি সব চাপ উপেক্ষা করে ৫ জানুয়ারি অদ্ভুত নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় বাংলাদেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়।
নির্বাচন বানচালের আন্দোলনে বাহ্যত ব্যর্থ হয়ে বিএনপি ৫ জানুয়ারির পরপরই আন্দোলন স্থগিত করে। দল গুছিয়ে আবার আন্দোলনে নামবে বলেও দলীয় প্রধান ঘোষণা দেন। কিন্তু প্রায় এক বছরেও দল গোছাতে পারেনি বিএনপি। ৫ জানুয়ারি নির্বাচন ঠেকানোর আন্দোলনে ব্যর্থতা হিসেবে বিএনপি ঢাকা মহানগরীতে দলের ভঙ্গুর দশাকে চিহ্নিত করে। এজন্য প্রথমে ঢাকায় দল গোছানোর প্রক্রিয়া শুরু করেন বেগম জিয়া। অনেক জল্পনা-কল্পনার পর ঢাকায় বিএনপির দায়িত্ব পান মির্জা আব্বাস। বিএনপিতে খোকা-আব্বাসের দ্বন্দ্ব অনেক পুরোনো। খোকা আন্দোলনে ব্যর্থ, তাই তিনি আউট। তার সমালোচনায় সবচেয়ে মুখর থাকা মির্জা আব্বাস পেলেন ঢাকার দায়িত্ব। সঙ্গে দেয়া হলো ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেলকে। দল গোছাতে কয়েকদিন তাদের তৎপরতা দেখাও গেল। দেখতে দেখতে চলে এলো ৫ জানুয়ারি ২০১৫, বিএনপি যাকে গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে আখ্যায়িত করে। আগেরবার সারা দেশে যথেষ্ট আন্দোলন হয়েছে। এবার সবার চোখ ঢাকা মহানগরীর দিকে। বড় গলায় কথা বলা আব্বাস বুঝি এবার রাজধানী অচল করেই দেবেন। ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে টানটান উত্তেজনা। সরকারের দমন-পীড়নের মধ্যে বিএনপি ঘোষণা দিলো ৫ জানুয়ারি ঢাকায় একটা কিছু ঘটানো হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই ঘটলো না। যথারীতি ৫ জানুয়ারি পুরো রাজধানী দখলে থাকলো সরকারি দলের। ওই দিন দুপুরে ঢাকার দায়িত্বে থাকা মির্জা আব্বাস তার বাসার কাছে জনাবিশেক লোকের একটি মিছিল বের করলেন। এতে নাকি পুলিশ গুলি চালালো। এরপর আর কোথাও আব্বাসের দেখা মিলেনি। এমনকি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী হলেও তিনি জনসম্মুখে আসেননি। তার স্ত্রীই প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছেন। ৫ জানুয়ারি কিছু করতে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি জোট ডাকলো টানা অবরোধ-হরতালের কর্মসূচি। প্রথম কয়েক দিন কিছুটা পালিত হলেও পরে তা আস্তে আস্তে পানসে হয়ে যায়। রাজপথে তাদের তেমন কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি। দুর্বৃত্তায়ন ও নাশকতায় কিছু নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ছাড়া তেমন কোনো অর্জন নেই এই আন্দোলনের।
বিএনপির এবারের আন্দোলন ঠেকানোর জন্য সরকার হুট করে টোপ হিসেবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন দিয়ে দিলো। বিএনপিও ম্রিয়মান আন্দোলন থামানোর একটি বাহানা পেয়ে তথাকথিত কর্মসূচি শিথিল করে সিটি নির্বাচনে অংশ নেয়। সরকার ভেবেছিল বিএনপি নির্বাচনে আসবে না, ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে দেবে। কিন্তু বিএনপি নির্বাচনে চলে আসায় সরকার বেকায়দায় পড়ে। শেষ পর্যন্ত সরকার যেকোনো মূল্যে বিএনপিকে ঠেকানোর কৌশল নেয়। সরকারের রাষ্ট্রযন্ত্র এবং সরকারি দলের ক্যাডারদের তৎপরতায় বিএনপি মাঠ ছেড়ে উধাও। নির্বাচনের দিন বিএনপির নেতাকর্মীদের তেমন কোনো তৎপরতাই চোখে পড়েনি। অনেক কেন্দ্রে এজেন্ট হওয়ার সাহসও করেনি বিএনপি কর্মীরা। অবশেষে ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ এনে ভোটের দিন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে বিএনপি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়। একতরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তিন সিটি করপোরেশন নিজেদের দখলে নিয়ে যায়। হুট করে সিটি নির্বাচনে আসা এবং হুট করে সরে দাঁড়ানোর এই প্রক্রিয়া বিএনপির জন্য ভবিষ্যতে কী ফল বয়ে আনবে তা সময়ই বলে দেবে। তবে আপাতত বিএনপির সামনে আশান্বিত হওয়ার মতো কোনো খবর নেই। যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন বিএনপি সবচেয়ে বেশি বিপন্ন। যারা এই দলটি করেন, যেকোনোভাবে এই দলের সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা আছে তারা সবাই হতাশ। বিএনপির ভবিষ্যৎ কী-এই হিসাব কষা শুরু করেছেন দলটির নেতাকর্মীরা।
যে দলটি এদেশের জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তির নেতৃত্ব দিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে; জনগণের বিপুল ভালোবাসায় যে দলটি বারবার এদেশের শাসন ক্ষমতায় এসেছে; যে দলটির প্রধান এখনও এককভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী; যে দলের সভা-সমাবেশে অন্য যেকোনো দলের চেয়ে স্বতস্ফূর্ত লোকসমাগম বেশি হয়, দেশের অন্যতম প্রধান এই দলটির এমন করুণ অবস্থা কেন? আজ সময় এসেছে বিএনপির সঙ্গে সম্পৃক্ত সবার একটু আত্মসমালোচনার। আপাত দৃষ্টিতে বিএনপির বিগত দিনের আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে-সে কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কেউ হয়ত যুক্তি দিতে পারেন, এর সুদূরপ্রসারী ফল বিএনপি ভোগ করবে; কিন্তু এখন যে দলটির দম যায় যায় অবস্থা, ভবিষ্যতে কখন সুফল পাবে তা দিয়ে কি দল বেঁচে থাকবে? দলের প্রধান ব্যক্তিটি থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা পর্যন্ত মামলায় জর্জরিত। বেশির ভাগ নেতাকর্মী আত্মগোপনে। নানাভাবে তারা নিগৃহীত হচ্ছেন। দিন যত যাচ্ছে তাদের মধ্যে হতাশা ততই ভর করছে। দল এবং রাজনীতির প্রতিও অনেকের ঘৃণা জন্মাচ্ছে। ২০১৯ সালের আগে নির্বাচনের আপাতত কোনো সম্ভাবনা নেই। আর অদৃশ্য কোনো চাপে আওয়ামী লীগ সরকার মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে বাধ্য হলেও বিএনপি এর সুফল পাবে না। কারণ আওয়ামী লীগ কোনোভাবে তাদেরকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দেবে না। নির্বাচনের আগে দলীয় প্রধান থেকে শুরু করে প্রথমসারির শতাধিক নেতাকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার জন্য যা যা দরকার সবই করবে আওয়ামী লীগ।
দুই.
মূলত বিএনপি সরকারবান্ধব একটি দল। এই দলটিকে সরকারেই মানায়, বিরোধী দলে নয়। আন্দোলন-সংগ্রামে অতীতে উজ্জ্বল ভূমিকা থাকলেও এখন আর এই দল দ্বারা সফল আন্দোলন সম্ভব নয়। কারণ বাস্তব সত্য হচ্ছে, বিশেষ কোনো আদর্শের ওপর ভিত্তি করে এই দলটির জন্ম হয়নি। আওয়ামী লীগের একটি আদর্শ আছে, বামপন্থীদের আদর্শ আছে, জামায়াতে ইসলামীসহ বেশির রাজনৈতিক দলেরই একটি আদর্শ আছে। সেই আদর্শ সঠিক হোক বা ভুল। আদর্শের জন্য মানুষ কিছু না পেলেও লড়াই-সংগ্রাম করে। আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যুগে যুগে মানুষ প্রাণও দিয়েছেন। কোনোদিন ক্ষমতায় যাবে না তবুও আদর্শের জন্য বছরের পর বছর রাজনীতি ও সংগ্রাম করে যাচ্ছে এমন দল বাংলাদেশে অনেক আছে। কিন্তু বিএনপি এর থেকে ভিন্ন। কারণ এর প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। সময়ের প্রয়োজনে অপেক্ষাকৃত সৎ ও নীতিবান সেনা অফিসার জিয়াউর রহমানের ডাকে বিভিন্ন দল, মত ও প্লাটফর্মের মানুষেরা বিএনপিতে যোগ দেন। স্বাধীনতাপরবর্তী লুটেরা রাজনীতির অভিজ্ঞতায় মানুষ বিএনপিকেই বিকল্প রাজনৈতিক প্লাটফর্ম হিসেবে গণ্য করতে থাকে। কিন্তু নব্বইপরবর্তী ক্ষমতার রাজনীতির স্বাদ পাওয়ার পর বিএনপি হয়ে গেছে সুবিধাবাদী একটি ধনিক শ্রেণীর অভয়ারণ্য। বিশেষ করে ২০০১ সালে বিপুল জনমত নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি ধরাকে সরা জ্ঞান করেছে। এই দলের নেতাকর্মীরা অবৈধভাবে অঢেল সম্পদ গড়ে তুলেছেন। ক্ষমতা হারানোর পর তাদের ধারণা ছিল বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুব শিগগির তারা পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে। কোনোমতেই এই অপেক্ষা পাঁচ বছরের বেশি হবে না। কারণ স্বাভাবিকভাবে পরপর দুইবার ক্ষমতায় আসার উদাহরণ এর আগে বাংলাদেশের গণতন্ত্রে ছিল না। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে নির্ধারিত সময়ে পুনরায় ক্ষমতায় না আসতে পারায় বিএনপির নেতাকর্মীরা দারুণভাবে হতাশ হয়েছেন। বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির পর বিএনপির মধ্যে এই হতাশা আরও বেড়ে গেছে। সহসাই যে তারা ক্ষমতায় আসতে পারবেন না সেটা বুঝে গেছেন। ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপি নেতারা যারা অঢেল সম্পদ বানিয়েছেন তারা চান না আন্দোলনে নেমে নিজেদের জীবন এবং সম্পদকে হুমকির মুখে ফেলতে। তবে আবারও ক্ষমতায় যাওয়ার লোভ প্রকটভাবে ভেতরে ভেতরে কাজ করায় কেউ সরাসরি ঘোষণা দিয়ে রাজনীতি থেকে বিদায়ও নিচ্ছেন না।
মির্জা আব্বাস, যাকে ঢাকা বিএনপির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তার অঢেল সম্পদ। ব্যাংক, পরিবহন সেক্টরসহ নানা খাতে তার বিশাল বিনিয়োগ। এত বিশাল সম্পদের মায়া ছেড়ে আন্দোলন করার মতো নৈতিক সামর্থ্য তার নেই। এবারের আন্দোলনের আগে আমানুল্লাহ আমানের নেতৃত্বে রাজধানীতে সমাবেশ করেছেন নব্বইয়ের ছাত্র নেতারা। ‘খালেদার কামান, আমানুল্লাহ আমান’ বলে যিনি খ্যাত, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যার বিশাল ভূমিকা সেই আমান এবার রাজপথে নামবেন-সেই খবরে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলেন দলীয় নেতাকর্মীরা। কিন্তু ৫ জানুয়ারির আগে পরে রাজপথে তো দূরের কথা কোথাও তার নামগন্ধও পাওয়া যায়নি। বরং দলের ডাকা লাগাতার হরতাল-অবরোধের মধ্যেই ঘটা করে ছেলেকে বিয়ে করিয়েছেন বলে খবরে জানা গেছে। একসময়ে রাজপথ কাঁপানো বিএনপির এই নেতা এখন কত সম্পদের মালিক হয়ত তিনি নিজেই জানেন না। আন্দোলনে নামলে নিশ্চিতভাবে তার সম্পদ হারাতে হবে। সম্পদের মায়া ত্যাগ করা কি এতো সহজ! সুতরাং ধরি মাছ না ছুই পানি নীতি অলম্বন করাই ভালো। দলীয় পদ-পদবিও ঠিক থাকবে, আন্দোলন-সংগ্রামেও নেই; কোনোমতে পরের কাঁধে বন্দুক দিয়ে ক্ষমতায় যেতে পারলে ভাগ-বাটোয়ারায় ফেরায় কে! এখানে উদাহরণ হিসেবে এক দুইজনের নাম উল্লেখ করা হলো; এই অবস্থা বিএনপির প্রায় সব নেতারই। সুতরাং এই নেতাদের দিয়ে আর যাই হোক আন্দোলন যে হবে না সেটা হলফ করে বলা যায়।
সাম্প্রতিক আন্দোলনে বিএনপিকে ডুবিয়েছে অতি বিদেশনির্ভরতা। আন্দোলন-সংগ্রামে নেই, বিএনপির দৃষ্টি শুধু বিদেশের দিকে। কে কী বললো, কোন দূতাবাস কী বিবৃতি দিলো, কোন কূটনীতিকের কী তৎপরতা এসবের দিকেই দলটির মনোযোগ বেশি। দলটির নেতা, কর্মী ও সমর্থকেরাও সবসময় এসব নিয়েই চর্চা করতে থাকেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশি শক্তিগুলোর প্রভাব আছে নিঃসন্দেহে, কিন্তু বিএনপি এটাকে ক্ষমতার পালাবদলের মাধ্যম হিসেবে যেভাবে দেখছে এতেই দলটি ভুল করেছে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কার্যকর আন্দোলন করলেই বিদেশি শক্তিগুলোর তাতে সমর্থন থাকে। বিএনপির মিত্র শক্তিগুলো চায় তারা এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করুক যাতে দেশ অচল হয়ে যায়, তখন তারা সরকারকে চাপ দিতে পারবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সত্যিকার অর্থে কার্যকর কোনো আন্দোলন করে দেখাতে পারেনি বিএনপি। সারা দেশে যথেষ্ট আন্দোলন-সংগ্রাম হলেও রাজধানীতে এর কিছুই হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের সফলতা হলো, যেভাবেই হোক তারা রাজধানীকে নিজেদের কন্ট্রোলে রাখতে পেরেছে। যার ফলে সারা দেশের জোরালো আন্দোলনেও সরকারের টনক নড়েনি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যে আন্দোলন করেছিল তা ছিল রাজধানীকেন্দ্রিক। সেজন্য সেই আন্দোলনের সুফল পেয়েছে দলটি। বিএনপি যতদিন ঢাকায় শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারবে ততদিন সারা দেশে যত আন্দোলনই করুক এর সুফল ভোগ করতে পারবে না।
অনেকে বলবেন, বিএনপি আন্দোলন কিভাবে করবে, রাস্তায় নামলেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুলি করে। এটি একটি কমন কথা। পৃথিবীতে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামই রক্তপাত ছাড়া সফল হয়নি। রাস্তায় নামলে পুলিশ গুলি করবে সেই ভয়ে যদি কোনো আন্দোলনের কর্মী ঘরে বসে থাকে সেই কর্মী দ্বারা আর যাই হোক আন্দোলন হবে না। বায়ান্ন, একাত্তর, নব্বই সব আন্দোলনেই গুলি হয়েছে। সব আন্দোলনেই রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে, প্রাণ দিতে হয়েছে। এখন হয়ত গুলির মাত্রাটি বেড়ে গেছে। আন্দোলনকারীদের ভেতরে ভয় সৃষ্টির জন্যই গুলি চালানো হয়। সেই ভয় যদি আন্দোলনকারীদের ভেতরে ঢুকে যায় তাহলে তো আর আন্দোলন হবে না। ঢাকা শহরে গুলি চালানোর মতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য কতজন আছেন আর বিএনপির নেতাকর্মী কতজন আছেন? সবাই নামলে কতজনকে গুলি করবে পুলিশ? একটি ওয়ার্ডে কয়েকজন মিছিল করলে গুলি চালাবে, এই ভয়ে অন্য ওয়ার্ডের নেতাকর্মীও ঘরে বসে থাকবে! এটা মনে করলে তো আর আন্দোলন হবে না। পৃথিবীর সব স্বৈরাচারী সরকারই চায় বন্দুক দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে। কিন্তু বিপ্লবীরা সেই বন্দুককে ভয় পেলে তো কোনো দেশ, কোনো সমাজে কখনও পরিবর্তন আসবে না। পুলিশের গুলি, রাজপথে রক্ত তো আর বিএনপির সাধারণ সমর্থকেরা দেবে না। রক্ত দিতে হবে, গুলি খেতে হবে দলের সক্রিয় নেতাকর্মীদেরই। কারণ ক্ষমতায় গেলে ভাগ-বাটোয়ারা তো সাধারণ সমর্থকেরা পাবেন না, তা কুক্ষিগত হবে নেতাকর্মীদের। সুতরাং সেই ভাগ-বাটোয়ারার জন্য বিনিয়োগ হিসেবে এখন রক্ত, অর্থ, শ্রম দিতে হবে নেতাকর্মীদেরই।
বিএনপির সাংগঠনিক কাঠানো ভেঙে পড়েছে। গত পাঁচ সাত বছরে দলটি ভারমুক্ত একজন মহাসচিব বানাতে পারেনি। দলের প্রধান খালেদা জিয়া আর সেকেন্ড ইন কমান্ড তারেক রহমান; তারা মা-ছেলে হলেও বিভিন্ন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে দুইজনের মধ্যে কিছুটা টানাপোড়েন আছে। খালেদা জিয়াকে বেষ্টন করে আছে বেতনধারী কিছু কর্মচারী মোসাহেব। তারা একেকজন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যের চেয়ে বেশি শক্তিধর। দলীয় নীতিনির্ধারণী অনেক বিষয়েও বেতনধারী কর্মচারীদের নাক গলাতে দেখা যায়। এমনকি সরকারের এজেন্ট হয়ে কাজ করেন এমন কর্মচারীও খালেদা জিয়ার পাশে আছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। দলীয় অনেক সিদ্ধান্তের কথা নেতাকর্মীরা জানার আগে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে পৌঁছে যায়। আয়েশী জীবন-যাপনে অভ্যস্ত খালেদা জিয়া বয়স হয়ে যাওয়ার কারণে এখন আর দলের জন্য সক্রিয়ভাবে সময় দিতে পারেন না। তারেক রহমান দেশের বাইরে থাকায় দল চালানোর মতো পাওয়ারফুল কোনো নেতাও নেই খালেদা জিয়ার আশেপাশে। এজন্য তাকে নির্ভর করতে হয় বেতনধারী কর্মচারীদের ওপর। ঢাকা মহানগরী দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট। কিন্তু এখানে দলের কোনো কমিটি নেই বছরের পর বছর ধরে। দায়িত্বে না থাকলে কেউ ঝুঁকি নেবে না এটাই স্বাভাবিক।
বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থাও শোচনীয়। বিএনপির মূল শক্তি ছাত্রদল। আন্দোলন-সংগ্রামে এই ছাত্র সংগঠনটির অতীত ঐতিহ্য গৌরবময়। কিন্তু আজ ছাত্রদলের অস্তিত্ব খোঁজে পেতে কষ্ট হয়। বছরের পর পর বছর ধরে ছাত্রদলের অনেক ইউনিট পুনর্গঠন করা হচ্ছে না। নানা যাচাই-বাছাইয়ের পরও ছাত্রদলের যে কমিটি দেয়া হয়েছে তা অছাত্রদের আখড়া। আদুভাই আর বাবা-চাচাদের দ্বারা গঠিত ছাত্র সংগঠন আন্দোলন-সংগ্রামে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না এটাই স্বাভাবিক। যুবদলের অবস্থাও একই রকম। রাজপথের আন্দোলনে যুবদলের যেখানে মূল ভূমিকা পালনের কথা সেখানে এর কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না। পেশাজীবীদের মধ্যে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা অনেকটা সক্রিয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের তেমন কোনো ভূমিকা নেই। বিএনপিপন্থী সাংবাদিকরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সক্রিয়তা দেখালেও তারা ঢাল-তলোয়ারহীন বিধিরাম সরদার। নামে অনেক বড় সাংবাদিক, কিন্তু তারা কোথাও কর্মরত নন। পেশাদারিত্ব না থাকার কারণে মিডিয়ায় তারা বিএনপির পক্ষে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না। জাতীয় প্রেস ক্লাবের মতো প্রতিষ্ঠান এতদিন বিএনপি-জামায়াতপন্থীদের দখলে থাকলেও এখন তা হাতছাড়া হওয়ার পথে। বিএনপির পক্ষে জোরালো ভূমিকা রাখার মতো প্রভাবশালী কোনো মিডিয়াও নেই। জেলে কাতরাচ্ছেন মাহমুদুর রহমান, দৈনিক আমার দেশ বন্ধ; এই পরিণতি দেখে বিএনপির পক্ষে অবস্থান নেয়ার দুঃসাহস কোনো মিডিয়া দেখাবে না। টক শোতে বিএনপির পক্ষে কথা বলা বুদ্ধিজীবীরাও আজ কোনঠাসা। আসিফ নজরুল, নুরুল কবিরের মতো স্পষ্টভাষী লোকেরা আজ টক শোতে অবাঞ্ছিত। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা কাঁধে নিয়ে দেশ ছেড়েছেন ড. তুহিন মালিক। কারাগারে ধুকছেন মাহমুদুর রহমান মান্না।
নানা সংকটের আবর্তে আবদ্ধ আজকের বিএনপি। অন্তহীন সমস্যা কাটিয়ে ওঠা দলটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জে টিকে থাকার জন্য দরকার দলের জন্য নিবেদিত কর্মী বাহিনীর। সত্যিকার অর্থে মনে-প্রাণে বিএনপিকে ভালোবাসে এমন কর্মীর অভাব বিএনপিতে নিদারুণ। যারা বিএনপিকে অন্তর থেকে ভালোবাসে এমন অনেকেই দলে কোণঠাসা; কেউ কেউ অভিমান করে দূরে সরে আছে। এই দুর্যোগকালে বিএনপির উচিত দলের দুর্দিনের কা-ারিদের কাছে টেনে আনা। সাংগঠনিকভাবে বিএনপিকে চাঙ্গা করা এখন প্রধান কাজ। অগোছালো, ভঙ্গুর সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে আন্দোলন-সংগ্রামের যত কর্মসূচিই ঘোষণা করা হোক বিএনপি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না