‘মানুষের মন আর আকাশের রঙ’ কথাটির একটি তাৎপর্য আছে। আকাশের রঙের যেমন কোনো স্থায়িত্ব নেই, কখন কোন অবস্থা ধারণ করে বলা যায় না, তেমনি মানুষের মন। বড়ই বিচিত্র এই মন। মনের অবস্থা কখন যে কী রূপ ধারণ করবে তা বলা যায় না। মনের যিনি ধারক তিনিও অনেক সময় নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন না মনের ওপর। রক্ত-মাংসের বিশাল দেহের মানুষটি নিয়ন্ত্রিত হয় অদৃশ্য সেই মনের দ্বারা। মন বলছে তো গোটা দেহ সেদিকে ধাবিত হচ্ছে। মন বলেনি তো কোনোভাবেই নড়ছে না বিশাল দেহটি। অনুভবযোগ্য না হওয়ার পরও অদৃশ্য মনের প্রভাব অনেক বেশি। মনই হলো সব ক্রিয়ার নিয়ন্ত্রক। মানুষ যা করে প্রথমে তার উদ্রেক হয় মনে; সেখান থেকে পরিকল্পিত বিষয়টিই বাস্তবতা পায়। মানুষ তার মন ভালো করার জন্য, অন্যের মন পাওয়ার জন্য, কারো মন জয় করার জন্য কত কিছুই না করে থাকে। মনকে উপেক্ষা করে চলার কোনো উপায় নেই। যে কাজে মন সায় দেবে না সেখানে কোনো প্রাণ থাকবে না। মন+যোগ হলেই কাজে প্রাণ আসে, গতি পায়।
বুদ্ধি ও বিবেকবোধের এক সমষ্টিগত রূপ মন। চিন্তা, অনুভূতি, আবেগ, ইচ্ছা এবং কল্পনার মাধ্যমে এর প্রকাশ ঘটে। মন কী এবং কিভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে অনেক রকম তত্ত্ব প্রচলিত আছে। জড়বাদী দার্শনিকরা মনে করেন, মানুষের মনের প্রবৃত্তির কোনো কিছুই শরীর থেকে ভিন্ন নয়। বরং মানুষের মস্তিষ্ক থেকে উদ্ভূত শরীরবৃত্তিক কর্মকা-ের মাধ্যমে মন গড়ে ওঠে। মূলত মনের সঠিক সংজ্ঞা দেয়া সম্ভব নয়। তবে এভাবে বলা যেতে পারে, মন হলো এমন কিছু যা নিজের অবস্থা এবং ক্রিয়াগুলি সম্পর্কে সচেতন। বিশ্বাসীরা মনকে আত্মা হিসেবে অভিহিত করেন। প্রতিটি মানুষের ভেতরে থাকা মন বা আত্মাই হলো মানুষের নিয়ন্ত্রক। সেই নিয়ন্ত্রণ শক্তিটি দুর্বল হয়ে পড়লে মানুষের অস্তিত্ব দুর্বল হয়ে পড়ে; মানুষ হারিয়ে ফেলে তার জন্মের সার্থকতা।
বিচিত্র এই মনে কখন কী যে উদয় হবে তা কেউ বলতে পারবে না। মানবমনের এমন বিচিত্রতার কারণেই অনেক সময় রাজার কাছে তার সিংহাসন আর ভালো লাগে না। মনের সায় না থাকায় অনেক রাজপুত্র সিংহাসনে বসতেই চান না। মনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে অনেক সময় যাবতীয় আরাম আয়েশও হয় বিষের মতো। কারো মনের ওপর টেক্কা দিয়ে কিছু করতে গেলে তা হীতে বিপরীত হয়। মন সবসময় ডুবে থাকে ভাবনার অনন্ত গভীরে। সাতরাজ্যের ভাবনা এসে ভিড় করে মনে। মানুষ যখন একাএকা থাকে তখন তার মনের সঙ্গে চলে বোঝাপড়া। নানা ভাবনা ও ভাবান্তর বিনিময় হয় মনের সঙ্গে। কোনো কোনো সময় মানুষ মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে বিপরীত অবস্থান নিতে যায়। কিন্তু এর ধাক্কা সামলে ওঠা মানুষের জন্য কঠিন হয়ে ওঠে।
প্রায় সবাই জীবনভর মনের মানুষের খোঁজে থাকে। কারো কারো জীবনে ধরা দেয় মনের মানুষ। মন একবার যাকে ধরা দেয় তাকে পাওয়ার জন্য কত কী-ই না করে মানুষ। মন ছুঁয়ে যাওয়া মুহূর্তগুলো মানুষ কখনও ভুলতে পারে না। মনে না ধরলে মানুষ চাইলেও কাউকে ভালোবাসতে পারে না। প্রেম-ভালোবাসার সংযোগ মূলত মনের সঙ্গে। পরস্পরের মধ্যে মন চালাচালির মাধ্যমেই মূলত সম্পর্কের সেতুবন্ধ তৈরি হয়। একবার কারো সম্পর্কে মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি করলে তাকে আর কখনও আপন করে নিতে পারে না মানুষ। মনের বিরূপ ধারণা থেকে মানুষ অনেকের ব্যাপারে হিং¯্র হয়ে ওঠতে পারে। মনে-মনে নিষিক্ত না হলে দুনিয়ার কোনো সম্পর্কই টিকে না।
মানুষের মন সংবেদনশীল একটি বস্তু। মন কখন যে কিভাবে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে তা বলা যায় না। আকাশের রঙ যেমন দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যায় তেমনি মানুষের মন। সাদা ঝকঝকে আকাশটিকে হঠাৎ মেঘ ঢেকে ফেলে, তর্জন-গর্জনে চারদিকে সৃষ্টি হয় ভীতিকর পরিস্থিতির। আবার কখনও মেঘঢাকা আকাশে, মুখ ঘোমরা করা প্রকৃতিতেও হঠাৎ কোথায় থেকে হেসে ওঠে ঝলঝলে রোদ। ঠিক তেমনি মন এই ভালো তো এই খারাপ। আপনি কোথাও ঘুরতে গেলেন ভালো মুডে, চরম ক্রেজি হয়ে। কিন্তু হঠাৎ কারো কোনো কথা, আচরণ বা কোনো অনাকাক্সিক্ষত খবর শুনে মন গেল খারাপ হয়ে গেল। হয়ত আপনি সেখানেই অবস্থান করছেন কিন্তু মন সায় দিচ্ছে না কিছুতেই। আপনার প্রিয় বিষয়গুলোও তখন অপ্রিয় হয়ে ওঠবে। মন খারাপের প্রভাব ফুটে ওঠবে আপনার চেহারায়। মানসিক ভারাক্রান্ত মানুষ শারীরিকভাবে অসুস্থ মানুষের চেয়ে বেশি ভেঙে পড়ে। তবে সবার মনের অবস্থা একরকম নয়। কারো কারো মন বেশি সংবেদনশীল, কারোটা একটু কঠোরপ্রকৃতির। অনেকে আছেন, যেকোনো পরিস্থিতি সামলে ওঠার মতো মানসিক শক্তি রাখেন। তবে অতি সংবেদনশীল বা অতি কঠোরপ্রকৃতির কোনো মনই মানুষের জন্য ভালো না।
মন ভালো করার স্বতসিদ্ধ কোনো ফর্মূলা নেই। অনেক বড় মনোবিদও এমন কোনো উপায়ের কথা বলতে পারেন না, যা মন ভালো করার নিশ্চয়তা দেয়। তবে কিছু কমন বিষয় আছে যেগুলো বেশির মানুষের ক্ষেত্রে ভালো ফল দেয়। মন ভালো করার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, যে কারণে আপনার মন খারাপ আগে সেই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করুন। আর তাতেও সফল না হলে যখন ইচ্ছা প্রাণ খুলে হাসুন। কারণ ১৫ মিনিটের হাসিই আপনাকে সুস্থ জীবন দান করবে। এমনকি কাঁদতে ইচ্ছা করলে হাসার চেষ্টা করুন। দেখবেন মন ভালো হয়ে যাবে। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে কাঁদলেও মন ভালো হয়ে যায়। তবে হাসাই ভালো। মন খারাপ থাকলে ঘরের মধ্যে বসে না থেকে বরং রাস্তায় বের হোন। আপনি আপনার কোনো বন্ধু বা পার্কেও যেতে পারেন। অনেক সময় পছন্দের কোনো জিনিস কাছে রাখলেও মন ভালো হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে মন খারাপের সময় সুন্দর কোনো সুবাস নিন। সেটা হতে পারে আপনার প্রিয় কোনো পারফিউম অথবা প্রিয় কোনো ফুল। এভাবে এক মিনিট সুবাস নিলেই আপনার মন ভালো হয়ে যাবে। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, মন খারাপের সময় প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটালে মন ভালো হয়ে যায়। তাই মন খারাপের সময় আপনার প্রিয়জনের সঙ্গে তা ভাগাভাগি করুন। দেখবেন মন ভালো হয়ে গেছে।
আমরা সবাই অন্যের মন পাওয়ার জন্য কম-বেশি উদগ্রিব। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের মন পেতে, সন্তান মা-বাবার মন পেতে কিংবা অফিসের কর্মচারী বসের মন পেতে মরিয়া। অনেক সময় আক্ষেপ করে বলতে শোনা যায়, এতকিছু করলাম তবুও তার মন পেলাম না। তাহলে মন পাওয়ার জন্যও চেষ্টা করা লাগে। শুধু শুধু কারো মন পাওয়া যায় না এটা স্বতসিদ্ধ কথা। যার মনে পেতে চান আগে তার মনটা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। তিনি কী চান, কী তার পছন্দের তা নির্ণয় করতে হবে। মানুষের মনটুকু বুঝতে পারলে তাকে আপন করে নেয়া অতি সহজ। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিলে তো সমাধান বের হবেই। মন পাওয়ার বিষয়টির পাশাপাশি মন থেকে ওঠে যাওয়ার একটি বিষয়ও আছে। কারো মন থেকে ওঠে গেলে সে আর কখনও সেখানে স্থান পায় না। যিনি আপনার প্রিয়, যার সঙ্গে আপনার স্বার্থের সম্পর্ক তার মন থেকে ওঠে যাওয়া তো খুবই উদ্বেগের বিষয়। এজন্য নিজের মন ভালো রাখা, অন্যের মন বোঝা, কারো মনে স্থান করে নেয়া, কারো মন জয় করা সবই একটি আরেকটির সঙ্গে জড়িত। সব মিলিয়েই মন একটি অদ্ভুদ জিনিস। মনের বিচিত্রতা আজও রহস্যই রয়ে গেছে।