জহির উদ্দিন বাবর
একজন বড় নেতা হিসেবে যে দাপট ও ভাব থাকার কথা সেটা তাঁর ছিল না। রাজনীতির তর্জন-গর্জন করতে তাঁকে কখনও দেখা যায়নি। একটি দলের শীর্ষ নেতা হওয়া সত্ত্বেও চলতেন খুবই সাদাসিধে। অপরিচিত কারও পক্ষে দেখে বোঝার উপায় ছিল না তিনি এতো বড় নেতা! সবার সঙ্গে এমনভাবে মিশতেন মনে হতো তিনি তাদের চেয়ে ভিন্ন কেউ নন। কথা ও আচরণে সারল্য, চিন্তার গভীরতা, দৃষ্টিভঙ্গির প্রখরতা, উদার ধ্যান-ধারণা এবং নির্মল ও মিষ্টি হাসি দিয়ে তিনি সবাইকে আপন করে নিতে পারতেন। দল-মত নির্বিশেষে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও অনন্য শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন তিনি। এমন ‘অজাত শত্রু’ রাজনীতিবিদ সচরাচর চোখে পড়ে না। সত্যিকার অর্থে তিনি ছিলেন ইসলামি রাজনীতির শুদ্ধপুরুষ।
হ্যাঁ, বলছি মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী রহ.-এর কথা। ইসলামি রাজনীতির পুরোধা এই ব্যক্তিত্ব গত ১১ মে ২০২০ পাড়ি জমিয়েছেন অনন্তের পথে। ৮৪ বছরের বর্ণাঢ্য জীবন তাঁর। ৬০ বছরের বেশি সময় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থেকে এদেশের ইসলামি রাজনীতির নানা অধ্যায় তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন। ইসলামি রাজনীতিতে তাঁর মতো এতো জানাশোনা এবং বাস্তব সাক্ষী খুব কমই আছে। এজন্য তাঁকে ‘ইসলামি রাজনীতির বিশ্বকোষ’ বললেও অত্যুক্তি হবে না।
২০১২ সালে মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ.-এর ইন্তেকালের পর ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মাওলানা নেজামী রহ.। প্রাচীন দল নেজামে ইসলাম পার্টির একটি অংশেরও নেতৃত্ব দিতেন। তাঁর রাজনীতির সূচনা নেজামে ইসলামের মাধ্যমেই। আশির দশকে সম্পৃক্ত ছিলেন হজরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর তওবার রাজনীতির সঙ্গে। নব্বইয়ের দশক থেকে ছিলেন ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে এদেশের ইসলামি রাজনীতিতে যত ঘটনাপ্রবাহ সবকিছুর সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। যাঁদের সঙ্গে রাজনীতির দীর্ঘ পথ মাড়িয়েছেন তাদের বেশির ভাগই ইতোমধ্যে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। ইসলামি রাজনীতির বিশাল এক অভিজ্ঞতার ভা-ার নিয়ে তিনি আমাদের মধ্যে নেয়ামত হিসেবে ছিলেন। তাঁর চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে ইসলামি রাজনীতির একটি সমৃদ্ধ ভাণ্ডার হারিয়ে গেল।
দুই.
মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী রহ.-এর ব্যতিক্রমী কিছু দিক তাঁকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে দেয়। ইসলামি ধারার গতানুগতিক রাজনীতি করলেও তিনি সবার কাছে ছিলেন ভিন্ন কেউ। কারণ তিনি বড় কোনো মাদরাসার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন না। তাঁকে নিয়ে মাতামাতি করার মতো সেই অর্থে গুণগ্রাহী ছাত্র কিংবা ভক্তকুল ছিল না। রাজনীতির মারপ্যাচে বলয় তৈরি করে নিজেকে ভিন্নভাবে উপস্থাপনের মতো ‘যোগ্যতা’ কিংবা মানসিকতাও তাঁর ছিল না। এজন্য রাজনীতির পাঠশালায় প্রতিটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তাঁকে একটি দলের শীর্ষ পদে আসতে হয়েছে। তবে অনেক বড় পদে অধিষ্ঠিত হয়েও তিনি সেই পদের উঞ্চতা অনুভব করেননি। পদ ব্যবহার করে বাড়তি কিছু পাওয়ার মনোবৃত্তিও তাঁর মধ্যে কখনও চোখে পড়েনি।
চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তিনি জোটের একজন বড় নেতা ছিলেন। তৎকালীন বিএনপি মহাসচিব ও এলজিআরডি মন্ত্রী আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার সঙ্গে তাঁর ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা। দুজনের বাড়িই নরসিংদীর শিবচরে। চাইলে সেই প্রভাব খাটিতে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যেতে পারতেন মাওলানা নেজামী। কিন্তু জোট সরকারের পাঁচ বছরে তাঁর জীবনধারায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। এতো বড় নেতা হয়েও ঢাকা শহরে চলতেন লোকাল বাসে কিংবা রিকশায়। অনেক সময় রিকশা ভাড়া থাকত না, পায়ে হেঁটেই চলাফেরা করতেন। দিনের বেশির ভাগ সময় কাটাতেন পল্টন এলাকায়। অনেক সময় দুপুরে কিংবা সন্ধ্যায় হোটেল খানা বাসমতিতে একটি রুটি-সবজি আর চায়ের পয়সাও হয়ত তার পকেটে থাকত না। চেনা-পরিচিত কেউ অফার করলে সাদরে গ্রহণ করতেন। বহুবার পল্টনের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে চা খেতেও দেখেছি।
সারল্য ও সাদাসিধে জীবন ছিল মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামীর সবচেয়ে বড় গুণ। খুব ফিটফাট কাপড় পরেছেন এমনটা দেখিনি কখনও। পায়ে সেই কমদামি সেন্ডেল। তিনি যখন ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান, ১৮ বা ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে যেতেন, তার চলন-বলন সেই একই ছিল। শুনেছি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তাঁকে অনেক মূল্যায়ন করতেন। বৈঠকে তাঁর মতকে গুরুত্ব দিতেন। কিন্তু এসব বিষয় কখনও তাঁর মধ্যে বাড়তি কোনো উত্তাপ সৃষ্টি করতে পারেনি। বিরোধী দলের পাতি নেতারাও যেখানে দামি গাড়ি হাঁকায় সেখানে একটি দলের শীর্ষ নেতা গুলশানের মতো অভিজাত এলাকায় বৈঠকে হাজির হতেন লোকাল বাসে। ফেরার সময় হয়ত কেউ অনুগ্রহ দেখিয়ে কোথাও নামিয়ে দিতেন।
২০১৬ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দল থেকে বেরিয়ে যায় ইসলামী ঐক্যজোট। তৃণমূলের সায় না থাকলেও দল পরামর্শ করেই এই সিদ্ধান্ত নেয়। তবে শুনেছি আবদুল লতিফ নেজামী সাহেব ব্যক্তিগতভাবে এটা চাননি। কিন্তু ঘরে-বাইরে নানা চাপে তিনি অনেকটা বাধ্য হন। পরবর্তী সময়ে ইসলামী ঐক্যজোটের অনেক নেতার মুখে প্রকাশ্যে খালেদা জিয়া কিংবা বিএনপির সমালোচনা শুনলেও নেজামীর মুখ থেকে তা কখনও শোনা যায়নি। এরপরে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে দলটির ঘনিষ্ঠতা নিয়ে বাজারে নানা কথা প্রচলিত আছে। কিন্তু আবদুল লতিফ নেজামীর মধ্যে রাজনৈতিক এই বাঁক বদলেও বিশেষ কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। জীবনের শেষ কয়েক বছরেও তার মধ্যে আগের সেই সাদাসিধে ও অনাড়ম্বর ভাব দেখা গেছে। সুযোগের অভাবে হয়ত অনেকেই সৎ। কিন্তু আবদুল লতিফ নেজামী সুযোগ পেয়েও অপেক্ষাকৃত সৎ ছিলেন, এটাই হলো তাঁর জীবনের অনন্য ব্যতিক্রমী দিক।
তিন.
মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী নিছক একজন ইসলামি রাজনীতিকই ছিলেন না। উচ্চশিক্ষিত ও বিদ্বান মানুষ ছিলেন। তাঁর কাছে রাজনীতি মানে রাজপথের কর্মসূচিই নয়, রাজনীতিকে পাঠ ও বিশ্লেষণও করতেন। দেশ-বিদেশের রাজনীতি নিয়ে তাঁর জানাশোনার পরিধি ছিল বিশাল। মিটিং মিছিলে মাঠ গরম করা রাজনৈতিক বক্তব্য তিনি দিতেন না। কিন্তু তাঁর কথায় থাকত যুক্তির প্রখরতা। রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতিপথ তিনি টের পেতেন। শুনেছি ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের সময় নীতি-নির্ধারণী বিষয়ে তিনি স্রোতের বাইরে কিছু কথা বলেছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই দূরদর্শী কথাগুলো বোঝার সক্ষমতা হয়ত অনেকের ছিল না। এজন্য কেউ কেউ তাকে সন্দেহও করেছেন।
তিনি একজন জানাশোনা সাংবাদিক ও সম্পাদক ছিলেন। মূলধারার পত্রিকায় কাজ করেছেন। লিখতেনও ভালো। পরবর্তী সময়ে দৈনিক সরকার নামে একটি পত্রিকা বের করতেন। তাঁকে একাই পত্রিকার সব কাজ করতে দেখেছি। এমনটি দলীয় যে বিবৃতি সেটাও তিনি নিজে লিখতেন। পল্টনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতা আবদুল কাইয়ুম ভাইয়ের দোকানে বসে বিবৃতি লিখে তা বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠাতে দেখেছি বহুবার। তাঁর সঙ্গে দেখা হলেই বগলের নিচে পত্রিকা দেখা যেত। একজন সচেতন রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিটি খবর খুটিয়ে খুটিয়ে পড়তেন।
সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁর বেশ সুসম্পর্ক ছিল। মূলধারার ডাকসাইটে অনেক সাংবাদিকের মুখে শুনে ‘নেজামী ভাই’ অনেক ভালো মানুষ। বিবিসি থেকে শুরু করে যেকোনো মিডিয়া যোগাযোগ করলে তিনি গুরুত্ব দিতেন এবং অত্যন্ত সুন্দরভাবে বক্তব্য তুলে ধরতেন। সাংবাদিকদের মারপ্যাচ তিনি বুঝতেন। এজন্য বক্তব্য দিতেন খুব সতর্কভাবে। বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তিনির্ভর জোরালো বক্তব্য দিতে দেখেছি তাকে। ইসলামি রাজনীতিবিদদের মধ্যে গণমাধ্যমে এতোটা গুছিয়ে কথা বলার লোক খুব কম আছেন।
বিভিন্ন সময় দেখা-সাক্ষাতে তাঁকে রাজনীতির বর্ণাঢ্য জীবন নিয়ে লিখতে অনুরোধ করেছি বেশ কয়েকবার। প্রতিবার সেই নির্মল হাসি দিয়ে বলেছেন লিখব। কিন্তু আবার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, লিখলে সবাই সেটা ধারণ করতে পারবে তো! জানি না রাজনীতির বর্ণাঢ্য ভাণ্ডার থেকে পরবর্তীদের জন্য তিনি কিছু সুরক্ষিত রেখে গেছেন কি না। তবে সাধারণের মধ্যে একজন অসাধারণ হিসেবে তিনি ইসলামি রাজনীতিতে চর্চিত থাকবেন অনেক দিন। এই অঙ্গনের মুষ্টিমেয় লোকও তাঁর থেকে দীক্ষা নিলে ইসলামি রাজনীতির চেহারা পাল্টে যাবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়। সাদামনের ইখলাসওয়ালা এই আলেম রাজনীতিক পবিত্র রমজানে চলে গেছেন। এই উসিলায় আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করে দিন, সেই দোয়াই করি।
বিদায় ইসলামি রাজনীতির শুদ্ধপুরুষ
Tags