মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অপার নিয়ামতের আধার এই পৃথিবী। এ জগতের প্রতিটি বস্তুর মাঝে প্রভুর ঐশী প্রেরণা কাজ করে। সৃষ্টি জগতের আবর্তন ও বিবর্তন সবই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কুদরতি নির্দেশনায় হয়ে থাকে। সৃষ্টির প্রবহমান ধারায় এমন কিছু প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় যার পেছনে সৃষ্টি জীবের কোনো দখল থাকে না। কেয়ামত, জন্ম, মৃত্যু, বৃষ্টি এবং গায়েব-এই পাঁচটি জিনিসের জ্ঞান ও নিয়ন্ত্রণ এককভাবে আল্লাহরই কাছে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এর কোনো কোনোটিতে মানুষের ধারণা ও অনুমান কাজ করলেও চূড়ান্ত বিচারে এসব কিছু সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত একমাত্র আল্লাহ। সরাসরি স্রষ্টার নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়ার অন্যতম বৃষ্টি। বৃষ্টি আল্লাহ তায়ালার একটি বিশেষ নিয়ামতও বটে।
সুজলা-সুফলা, শষ্য-শ্যামলায় সুশোভিত এই বসুন্ধরা বৃষ্টির কারণেই হয়ে ওঠেছে মানুষের বাসযোগ্য। বৃষ্টি দ্বারা জমিনকে করেছেন ঊর্বর ও উৎপাদনশীল। প্রকৃতিতে লাগিয়েছেন সজীবতার ছোঁয়া। ফুলে ফলে ভরপুর করে দিয়েছেন জগৎ সম্ভার। তীব্র খরায়, গ্রীষ্মের দাবদাহে জমিন যখন ফেঁটে চৌচির হয়ে যায়, চারদিকে প্রকৃতি খাঁ খাঁ করতে থাকে, তখন মহান প্রভুর ঐশী প্রেরণায় এক পশলা বৃষ্টি জগতে সঞ্চার করে নতুন প্রাণের। প্রকৃতি হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত। মৃতপ্রায় বসুন্ধরা ফিরে পায় তার সজীবতা ও সৌরভ। বিস্ত্রীর্ণ মাঠ, শ্যামল প্রান্তর, সবুজ গাছ-গাছালি, অসহায় প্রাণীকূল সবই বৃষ্টির জন্য হাহাকার করতে থাকে। বৃষ্টির স্নিগ্ধ কোমল ফোটায় গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপে বিরান হয়ে যাওয়া ভূমিতে নতুন প্রাণের ছোঁয়া লাগে । সঠিক সময়ে বৃষ্টির দেখা না পেলে সৃষ্টিকূলের জীবনধারা ব্যাহত হয়। এর গতিধারা শ্লথ হয়ে পড়ে। জমীনের পলে পলে বৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এসব বিবেচনায় বৃষ্টিকে স্রষ্টার অপূর্ব দান ও শ্রেষ্ঠ নিয়ামত হিসেবে আখ্যা না দেয়ার কোনো অবকাশ থাকে না। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আমি জলধর মেঘমালা থেকে প্রচুর বৃষ্টিপাত করি যাতে এর দ্বারা উৎপন্ন করি শস্য উদ্ভিদ।’
দুনিয়ার সব উৎপাদনই নির্ভর করে বৃষ্টির ওপর। বৃষ্টির সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ আল্লাহর কাছে ন্যস্ত। এখানে অন্য কারো হাত নেই। আল্লাহ তায়ালা তার বৃষ্টি বর্ষনের সামর্থ্য ও এর কার্যক্ষমতার ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘বল তো কে সৃষ্টি করেছেন নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল এবং আকাশ থেকে তোমাদের জন্যে বর্ষণ করেছেন পানি, অতঃপর তা দ্বারা আমি মনোরম বাগান সৃষ্টি করেছি। তার বৃক্ষাদি উৎপন্ন করার শক্তিই তোমাদের নেই। অতঃপর আল্লাহর সাথে কোনো উপাস্য আছে কি? বরং তারা সত্যবিচ্যুত সম্প্রদায়।’
অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘তিনিই আল্লাহ যিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে অতঃপর তা দ্বারা তোমাদের জন্যে ফলের রিযিক উৎপন্ন করেছেন এবং নৌকাকে তোমাদের আজ্ঞাবহ করেছেন, যাতে তার আদেশে সমুদ্রে চলাফেরা করে এবং নদ-নদীকে তোমাদের সেবায় নিয়োজিত করেছেন।’
আল্লাহর বৈচিত্র্যময় সৃষ্টিরাজি এই পৃথিবী তার কুদরতি ইশারায় চলছে নিরবধি। তিনি পৃথিবীর গতিধারা যেভাবে, যে গতিতে প্রবাহিত করতে চান সেভাবেই প্রবাহিত হচ্ছে। আল্লাহর নির্দেশনায় জগতের সবকিছুই সংঘটিত হয়। বৃষ্টিও এর ব্যতিক্রম নয়। হযরত মিকাঈল আ. আল্লাহর নির্দেশনা মোতাবেক বৃষ্টি বর্ষণের কাজে নিয়োজিত আছেন। যখন যেখানে বৃষ্টির প্রয়োজন আল্লাহর নির্দেশ পেলে সেখানেই তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের চোখ ধাঁধানো আবিষ্কারে বৃষ্টি বর্ষণের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া বর্ণনা করা হলেও তার মূলে রয়েছে অদৃশ্য কুদরতি হাত। তার সম্মতি না থাকলে কোনো প্রক্রিয়াই কার্যকর হবে না। আল্লাহ তায়ালা আকাশে ভাসমান মেঘমালা থেকে বৃষ্টি বর্ষণের ধাপসমূহ চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘তুমি কি দেখ না যে, আল্লাহ মেঘমালাকে সঞ্চালিত করেন, অতঃপর তাকে পুঞ্জিভূত করেন, অতঃপর তাকে স্তরে স্তরে রাখেন, অতঃপর তুমি দেখ যে, তার মধ্য থেকে বারিধারা নির্গত হয়। তিনি আকাশাচ্ছিদ শিলাস্তুপ থেকে শিলাবর্ষন করেন এবং তা দ্বারা যাকে ইচ্ছা আঘাত করেন এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা তা অন্যদিকে ফিরিয়ে দেন। তার বিদ্যুৎ ঝলক দৃষ্টি শক্তিকে যেন বিলীন করে দিতে চায়।’
বৃষ্টি আল্লাহর এক বিশেষ করুণা। তিনি দয়া করে বৃষ্টি দ্বারা এ জমিনকে সিক্ত না করলে পৃথিবীর রূপ-লাবণ্যতা বিলীন হয়ে যেত। জীব-জন্তুর জন্য পৃথিবী তার বাসযোগ্যতা হারাত। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষ সত্ত্বেও বৃষ্টির কোনো বিকল্প আবি®কৃত হয়নি। কৃষকের ফসল, জমিনের ঊর্বরতা, গাছ-গাছালীর সজীবতা, ফল-ফলাদির উৎপাদন সবকিছুই নির্ভর করে বৃষ্টি বর্ষণের ওপর। বৃষ্টি বর্ষণের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক অবস্থার কোনো ব্যতিক্রম হলেই সহজাত প্রাকৃতিক ধারা ব্যাহত হয়। এই ভূপৃষ্ঠে আল্লাহর রহমতের বারিধারা প্রবাহিত না হলে মানুষের আবাসন উপযোগী স্বচ্ছ, নির্মল প্রকৃতির সন্ধান মানুষ পেত না। পৃথিবীর মিষ্ঠ পানির প্রধান উৎস বৃষ্টি। পর্যাপ্ত মিষ্ঠ পানি না হলে পৃথিবীতে প্রাণের স্পন্দন বাকি থাকবে না। প্রত্যেকটি প্রাণীর অস্তিত্বের সঙ্গে বৃষ্টির সম্পর্ক ওৎপ্রোত। বৃষ্টি যেমন মানুষের জীবনের জন আশির্বাদ, তেমনি কখনো কখনো তা অভিসম্পাত হিসেবেও আবির্ভূত হয়। অনাবৃষ্টি যেমন অসহ্য দানবের রূপ লাভ করে তেমনি অতিবৃষ্টিও সৃষ্টিকূলের জন্য দুঃসহের কারণ। রাসূল সা. উম্মতকে অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি উভয় ধরনের দুর্যোগ থেকে পানাহ চাওয়ার কথা বলেছেন।
আল্লাহর চিরায়ত নেজাম হচ্ছে তিনি যে জিনিস দ্বারা সৃষ্টিকূলের ফায়দা পৌঁছান, যে জিনিস তার নিয়ামত হিসেবে পরিগণিত, সে গুলোকেই কখনো কখনো এর বিপরীত মেরু তথা শাস্তি ও গজবের জন্য ব্যবহার করেন। বৃষ্টিও তেমনি একটি নিয়ামত যা কখনো কখনো শাস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটা মানুষেরই কৃতকর্মের ফসল। মানুষের জন্য আল্লাহর দানকৃত নিয়ামতসমূহের সঠিক ব্যবহার এবং তা ভোগ করার যথাযথ কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন না করলে নিয়ামতই অভিশাপের হিংস্র রূপ লাভ করে। শাস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটা মানুষেরই কৃতকর্মের ফসল। মানুষের জন্য আল্লাহর দানকৃত নিয়ামতসমূহের সঠিক ব্যবহার এবং তা ভোগ করার যথাযথ শোকরিয়া না করলে নিয়ামতই অভিশাপের হিংস্র রূপ লাভ করে। এজন্য ইসলামের নির্দেশনা হচ্ছে আল্লাহর নিয়ামতরাজি উপভোগ করার পাশাপাশি তার প্রতি যথাযথ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা। বৃষ্টির ন্যায় মহান নিয়ামত মানুষকে আল্লাহর কুদরতের প্রতি বিশ্বাসীই করে না বরং তার প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধে বাধ্য করে। স্রষ্টার এই একটি মাত্র নিয়ামতের ওপর চিন্তা-গবেষণা করলে এর কোনো কূল-কিনারা পাবে না সৃষ্টিকূল।