বৈরী গণমাধ্যম ও আমাদের অবস্থান

বিশ্বমিডিয়ার বর্তমান যে স্রোত উল্টোপথে প্রবহমান এর প্রধান টার্গেটই হলো সত্য, সুন্দর ও বাস্তবতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। সারা বিশ্বের গণমাধ্যমের অবস্থা মোটামুটি এক। প্রকৃতি ও গতিধারায় স্বাতন্ত্র রক্ষায় বলিষ্ঠ গণমাধ্যমের সংখ্যা খুবই কম। বর্তমানে গণমাধ্যমের গতি অন্যায্য ও অবৈধ পথে। আধিপত্য বিস্তারের খেলায় গণমাধ্যম এতটাই উন্মাদ যে, নীতি-নৈতিকতার প্রসঙ্গটি এখানে গৌণ, স্থান বিশেষে তুচ্ছ ও পরিত্যাজ্য। স্বার্থের ছিটেফোটা যেখানে আছে সেখানেই গণমাধ্যমের উপস্থিতি অনিবার্য। অপরিমেয় শক্তির আধার গণমাধ্যম তার পুরো প্রভাবটাই অন্যায্য, অসমর্থিত ও অসম পন্থায় খাটাতে চেষ্টা করে। গণমাধ্যমের এই নীতি ও আদর্শের মূলে রয়েছে মালিকদের স্বার্থসংশ্লিষ্টতা ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব। বিশ্বের সব গণমাধ্যমই কোনো না কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠীর মালিকানাধীন। মালিক শ্রেণীর মনোভাব ও মনোবাঞ্চাই প্রতিফলিত হয় গণমাধ্যমে। তাদের চাহিদা ও প্রভাবটাই এখানে মূখ্য। একটি ছোট্ট উদাহরণ দিই। আমাদের দেশের একটি বড় গ্রুপের কয়েকটি মিডিয়া হাউজ আছে। গ্রুপটি প্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পপতির মিডিয়ার আঘাতে জর্জরিত হয়ে বিশাল বাজেটের কয়েকটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা করেছে। এখানে তাদের নীতি-নৈতিকার চেয়ে বড় হলো ব্যবসায়িক স্বার্থ সংরক্ষণ। ব্যবসায়িক প্রয়োজনে কারো চরিত্রহননের প্রয়োজন হলে একযোগে ওই গ্রুপের মিডিয়াগুলোর তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। অনেক সময় সাংবাদিকতার যে নীতিমালা ও মূল্যবোধ আছে এর মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। মালিকপক্ষের নির্দেশের কাছে সাংবাদিকতার নীতিমালা টিকে না। এভাবে মালিকদের অবৈধ ও অন্যায় পন্থায় আহরিত সম্পদের পাহারা দেয় গণমাধ্যম। এজন্য বৈধ-অবৈধ পন্থায় কিছু অর্থবিত্ত কামাতে পারলেই সবাই গণমাধ্যমের মালিক হতে চায়। এ তো গেল আমাদের দেশের গণমাধ্যমের কথা। আর সারা বিশ্বের সিংহভাগ গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রক সা¤্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী। যারা বিশ্বব্যাপী অশান্তি সৃষ্টির হোতা, সত্য ও সুন্দরকে যারা মিটিয়ে দিতে চায় তাদের অর্থে প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমের কাছে গঠনমূলক কিছু আশা করা, নীতি ও আদর্শের সহায়ক কিছু কামনা করা তেতুল গাছে আঙ্গুর চাওয়ারই নামান্তর।
সারা বিশ্বে প্রভাবশালী যে কটি গণমাধ্যম আছে এর সবগুলোই সরাসরি ইহুদীদের দ্বারা পরিচালিত কিংবা তাদের মিত্রদের প্রতিষ্ঠিত। ইহুদীরা এমন এক জাতি যারা কূট-কৌশলে বিশ্বকে অশান্ত  করে নিজেদের সুবিধাটুকু হাতিয়ে নেয়ার উস্তাদ। ইহুদী চাল বোঝার মতো দূরদর্শিতা কোনো জাতিরই নেই। ইহুদীদের এসব অপকর্ম চালিয়ে যাওয়ার ফলপ্রসূ হাতিয়ার গণমাধ্যম। এজন্য প্রতিটি গণমাধ্যমের কেন্দ্রবিন্দুতে অত্যন্ত কৌশলে তারা বসে আছে। সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে না পারলেও নানা পন্থায় তারা বিশ্বমিডিয়ায় নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে আছে। শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, আমাদের দেশের প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলোর ওপর ইহুদী চক্রের শক্তিশালী হাত আছে। বাহ্যত তাদের লাভ-ক্ষতির কোনো বিষয় না থাকলেও কূটচাল ও দুষ্টুমীর দ্বারা অস্থিরতা বজায় রাখাটাই তাদের সাফল্য। বিশ্বমিডিয়ার নেপথ্যে ইহুদীচক্রের দুষ্ট হাত কার্যকর আছে বলেই গণমাধ্যমের গতি উল্টো স্রোতে, নীতি-নৈতিকতা ও চিরায়ত ধারার বিপরীতে।
দুই.
বিশ্বমিডিয়ার এই যে বিপরীত প্রবাহ এর প্রধানত শিকার ইসলাম, ইসলামী মূল্যবোধ এবং এর অনুসারীরা। বিশ্বের প্রতিটি দেশে মুসলমানরা আজ মিডিয়া আগ্রাসনের নির্মম শিকার। ইসলাম ও মুসলমান আজ বিশ্বমিডিয়ার কাছে সবচেয়ে অপাঙ্ক্তে। দেশে দেশে মুসলমানদের দুর্ভোগ ও দুর্দশার জন্য প্রধানত দায়ী গণমাধ্যম। মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্র“দেরকে উস্কে দেয়া ও উদ্বুদ্ধ করার দায়িত্বটুকু পালন অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছে গণমাধ্যম। মুসলমান সম্পর্কে ভয়াবহ ও ঘৃণ্য যে একটা ধারণা বা চিত্রকল্প দুনিয়ার সামনে তুলে ধরা হয়েছে তা গণমাধ্যমের নৈপুণ্য। মুসলমান ও সন্ত্রাসবাদ সমার্থক হিসেবে উপস্থাপনের যে টার্গেট নিয়ে তাগুতি শক্তি ময়দানে নেমেছিল তা পূর্ণতা পেয়েছে গণমাধ্যমের কল্যাণে।
আফগানিস্তান, ইরাকের মতো ঐতিহ্যমণ্ডিত রাষ্ট্র ধ্বংস করে দেয়ার কারিশমা ইতোমধ্যে গণমাধ্যম প্রদর্শন করেছে। ইরানকে বিশ্বের সামনে মানবসভ্যতার জন্য ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্মক প্রমাণিত করার প্রাথমিক প্রক্রিয়ায় তারা সফল। পাকিস্তানকে অকার্যকর রাষ্ট্র বানানোর প্রস্তুতি প্রায় শেষ। সিরিয়া ও সুদানের প্রতি মিডিয়ার শ্যেনদৃষ্টি পড়েছে আরো আগেই। প্রতিটি মুসলিম দেশকে অস্থিতিশীল করে রাখার জন্য নানা ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে গণমাধ্যম। ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমিতে মুসলমানদের রক্তের স্রোত বইয়ে গেলেও মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষিত হয় না, আর ইসরাইলের কোনো ইহুদীর বাচ্চার পায়ে একটা সুইয়ের আচড় লাগলেও তা মিডিয়ার শিরোনাম হয়ে যায়। সাম্রাজ্যবাদীদের পারমানবিক অস্ত্রের মহড়া দেখে গণমাধ্যম বাহ বাহ দেয়, আর মুসলিম কোনো দেশ পারমানবিক স্থাপনা গড়ে তোলার লক্ষে একটি ইট গাঁথলেও চারদিক থেকে হৈ চৈ রব ওঠে। গণমাধ্যমের এই বিমাতাসুলভ আচরণ, অন্যায় ও অসভ্য কর্মকাণ্ড সমান্তরালভাবে চলছে সারা বিশ্বে। কারণ গণমাধ্যমের প্রভু যারা তারা মুসলমানদের অস্তিত্ব কখনও সহ্য করতে পারে না।
তিন.
বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের মিডিয়া আগ্রাসনের নির্মম শিকার হওয়ার প্রধান কারণ তাদের কাছে শক্তিশালী কোনো গণমাধ্যম নেই। এ ক্ষেত্রটিতে মুসলমানরা নিদারুণ পিছিয়ে আছে। একপেষে ও অন্যায় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ন্যূনতম প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো গণমাধ্যমও মুসলমানদের নেই। এজন্যই সারা বিশ্বে মুসলমানরা আজ একতরফাভাবে মিডিয়া তাণ্ডবের নির্মম শিকার। শুধু আমাদের বাংলাদেশের কথাই চিন্তা করা যাকÑএখানে ইসলামপন্থীরা গণমাধ্যমের কাছে কত অসহায়! নব্বই ভাগ মুসলমানের এই দেশেও ইসলামপন্থীরা যখন গণমাধ্যমের শিকারে পরিণত হয় তখন আক্ষেপের আর কোনো সীমা থাকে না। বাহ্যত বাংলাদেশের বেশির ভাগ গণমাধ্যমের মালিকানাই মুসলমানদের হাতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, মুসলমানদের স্বার্থসংশ্লিষ্টতা রক্ষিত হয়নি একটি গণমাধ্যমেও। ইসলামপন্থীদের দমিয়ে রাখাই যেন গণমাধ্যমের কাজ। তারা যেন মাথাচারা দিয়ে উঠতে না পারে এর জন্য যা যা করা দরকার সবই করতে প্রস্তুত এদেশের গণমাধ্যম। এখানকার গণমাধ্যমের সবচেয়ে উপেক্ষিত, অবহেলিত ও অবদমিত বিষয় হচ্ছে ইসলাম ও মুসলমান প্রসঙ্গ।
বাংলাদেশের কয়েকশ সংবাদপত্র, কয়েক ডজন টিভি চ্যানেল, রেডিও স্টেশন, অনলাইন নিউজ পেপার এবং অগণিত মাসিক, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক সাময়িকী ইসলামের বিরুদ্ধে সক্রিয় আছে। বিশ্বমিডিয়ার উল্টোস্রোতের ধাক্কা আমাদের দেশের গণমাধ্যমগুলোতেও জোরালোভাবে লেগেছে। ইসলামপন্থীদের হেয় করার একটা নীরব প্রতিযোগিতা চলছে আমাদের মিডিয়া অঙ্গনে। এমন কোনো গণমাধ্যম পাওয়া যাবে না যাতে ইসলামপন্থীদের সরাসরি আঘাত কিংবা টিপ্পনি কাটা হয়নি। বিশ্ব মোড়লদের শেখানো বুলি এদেশের মিডিয়াগুলোতে জোরেশোরে প্রচারিত হচ্ছে। ইসলামী শিক্ষা, আদর্শ, মূল্যবোধ এবং সত্য ও সুন্দরের বিরুদ্ধে এদেশের প্রথমসারির গণমাধ্যমগুলো একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। বাম, ব্রাক্ষ্মণ ও স্যেকুলারপন্থীদের একচ্ছত্র প্রভাবের কারণে এদেশের মিডিয়াঙ্গন বরাবরই ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে সরব। ডানপন্থী যে ধারাটি অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী তারাও ইসলামপন্থীদের মিত্র হতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে না। সুযোগ পেলে তারাও ইসলামপন্থীদের বিপরীত অবস্থানে চলে যায়। একটি উদাহরণ দিই, সম্প্রতি ‘ইসলাম ও জাতীয়তাবাদী’ ধারার একটি পত্রিকায় হিল্লা বিয়ের নিন্দা জানিয়ে একটি লেখা প্রকাশিত হয়। এতে ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ফতোয়াকে যেভাবে নগ্ন আক্রমণ করা হয়েছে তা কেবল বাম ও ইসলাম বিদ্বেষী ধারার কোনো সংবাদপত্রেই মানায়। এর কারণ হলো, আমরা ওই সংবাদপত্রটি নিজের মনে করলেও মূলত তারা আমাদেরকে ব্যবহার করে, ফায়দা লুটে। সহানুভূতির প্রয়োজন পড়লে মাঝে-মধ্যে  কোনো কোনো গণমাধ্যম মিত্রতার বান করে মাত্র। প্রকৃত অর্থে বর্তমানে কোনো গণমাধ্যম ইসলামপন্থীদের সহায়ক শক্তি নয়।
চার.
বাংলাদেশের মিডিয়াঙ্গনে ইসলামপন্থীদের একমাত্র ভরসা মাসিক পত্রিকাগুলো। কয়েক ডজন মাসিক, দু একটি পাক্ষিক ও সাপ্তাহিকই নিরাশায় একমাত্র আশার আলো। আশা জাগানিয়া এই সাময়িকীগুলো শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ইসলাম ও মুসলমানের পক্ষে জোরালো ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। ইসলামপ্রিয় সীমিতসংখ্যক পাঠকেরা প্রতি মাসে তাকিয়ে থাকে এই ম্যাগাজিনগুলোর দিকে। ইসলামের নিখাদ ও সঠিক ব্যাখ্যা উপস্থাপনের কারণে সাময়িকীগুলোর প্রতি সবার একটা আস্থা ও নির্ভরতা আছে। গণমাধ্যমমের বিরূপ প্রবাহ এবং বেসামাল ধাক্কার বিপরীতে এসবের আবেদন খুব একটা নেই একথা সত্য। তবে একদম শূন্যতার চেয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো ন্যূনতম ব্যবস্থা থাকাটা কম কিসে? ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে গণমাধ্যম ব্যাপক পরিসরে অতি প্রভাবক ভঙ্গিতে যে বিষোদগারগুলো করে যাচ্ছে এর উপযুক্ত জবাব বা প্রতিরোধ হয়ত সাময়িকীনির্ভর ইসলামী পত্র-পত্রিকা দ্বারা সম্ভব নয়। তবে সুনির্দিষ্ট একটা পাঠক শ্রেণীকে তো অবশ্যই বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করা যাবে। আমাদের সাময়িকীনির্ভর ইসলামী সংবাদপত্র সে গুরুদায়িত্বটুকুই পালন করে যাচ্ছে।
আশা ও নির্ভরতার প্রতীক ইসলামী পত্র-পত্রিকাগুলোর বর্তমান যে অবস্থাটা তা বেশিদিন আগের নয়। গত এক দেড় দশকের মধ্যে এর বিকাশটা সর্বময় গ্রাহ্যতা পেয়েছে। অন্তত ইসলামী পত্রিকাগুলোর নতুনত্ব ও স্বতন্ত্রতা অর্জনের যে প্রয়াস তা মোটামুটি এক দশকের মধ্যেই সাধিত হয়েছে। সার্বিক মূল্যায়নে ইসলামী ভাবধারার সাময়িকীগুলোর আমূল পরিবর্তন হয়েছে গত কয়েক বছরে। নতুন জন্ম নেয়া এবং পরোনো পত্রিকাগুলোর নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপিত হওয়ার অঘোষিত একটা প্রতিযোগিতা বেশ ভালোভাবেই আঁচ করা যাচ্ছে। পত্রিকার নীতি থেকে নিয়ে বিষয়বস্তুর নতুনত্ব, আঙ্গিক ও উপস্থাপনায় ভিন্নতা এবং অবয়ব পাল্টে দেয়া পর্যন্ত এই পরিবর্তনের অন্তর্ভুক্ত। ইতিবাচক এই পরিবর্তনের কারণে মানে ও গুণে ইসলামী পত্রিকাগুলোর অবস্থানটা আগের তুলনায় অনেক অগ্রসর হয়েছে। ইদানীং এগুলোর পরস্পরে ভালো করার সুন্দর ও ইতিবাচক একটা প্রতিযোগিতা বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। নির্দিষ্ট সময়ে চমক ও জৌলুশের সঙ্গে বাজারে আসার জমে ওঠা এই প্রতিযোগিতা প্রত্যাশা পূরণের পথে বড় ধরনের অগ্রগতি বলেই মনে হচ্ছে।
পাঁচ
আশার প্রতীক একমাত্র অবলম্বন আমাদের ইসলামী পত্রিকাগুলোর বর্তমান অবস্থান নিয়ে অত্যধিক উচ্ছ্বসিত হওয়া কিংবা তৃপ্তির ঢেকুর তোলার কোনো অবকাশ নেই। উল্টো স্রোতের মিডিয়ার বিরুদ্ধে ন্যূনতম প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হলে ইসলামী মিডিয়াখ্যাত এই পত্রিকাগুলোর বর্তমান অবস্থাটা মোটেই সন্তোষজনক নয়। নিয়মিত ও অনিয়মিত প্রকাশ হওয়া এসব পত্রিকার অনগ্রসরতা ও পিছিয়ে পড়ার কারণ অনেক। কারণগুলো চিহ্নিত করা এবং এগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করার কোনো রেওয়াজ চালু নেই। থাকলে এ অঙ্গনে এগিয়ে যাওয়াটা সহজ হতো। বহুল প্রচলিত মাসিক পত্রিকাগুলোর তোষামোদী ও তৈলমর্দন জাতীয় লেখা ও প্রস্তাবকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা সহ্য করার মতো সৎ সাহস কারো নেই। কোনো পত্রিকা বা পত্রিকাসংশ্লিষ্ট কাউকে নির্দিষ্ট করে সমালোচনামূলক দু একটি শব্দ ব্যবহার করলেও তা মেনে নিতে পারে না। সাধারণ ধারার মিডিয়ায় আমরা সমালোচনার যে রেওয়াজ দেখতে পাই এর ছিটেফোটাও আমাদের ধারায় নেই। পেশাগত কিংবা বস্তুনিষ্ঠতার কারণে নির্মোহ হয়ে কারো সম্পর্কে দু একটি শব্দ উচ্চারণ করলেও তাকে শত্র“ বলে ভাবতে থাকে। ত্র“টি সংশোধন এবং বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা মেনে নেয়ার উদারতাটুকু যতদিন ইসলামী পত্রিকাগুলোর মধ্যে না আসবে ততদিন এর মানোন্নয়নের তেমন আশা করা যায় না।
ইসলামী ধারার মিডিয়াকে শিল্পাঙ্গন হিসেবে জ্ঞান করতে হবে। এর অঙ্গনটিকে শিল্পের মর্যাদায় অভিষিক্ত করা না গেলে কোনোদিন মানোন্নয়ন হবে না। আর শিল্পের মানোন্নয়নের জন্য চাই পেশাদারী মনোভাব। পেশাদারিত্ব না থাকলে কোনো শিল্পই উন্নত শিল্পের মর্যাদা পায় না। ইসলামী ধারার পত্র-পত্রিকার সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট তাদের কাছে এটি শিল্প হিসেবে মূল্যায়িত নয়। ফলে কেউই এ অঙ্গনটিতে শতভাগ পেশাদারী মনোভাব আরোপ করতে পারে না। সাময়িক আবেগ এবং মুহূর্তের উচ্ছ্বাসের কারণে বেশির ভাগই ইসলামী ধারার মিডিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত হয়। সামান্য প্রতিকূলতা এবং পরিস্থিতির কিছুটা বিরূপতা দেখলেই আবার তারা ছিটকে পড়ে। এভাবে সহজেই ছিটকে পড়ার কারণে এমন কোনো অভিজ্ঞ লোক তৈরি হচ্ছেন না যিনি তার যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে এ অঙ্গনটিকে সম্ভাবনাময় করে তুলবেন।
আমাদের ইসলামী ধারার সঙ্কুচিত গণ্ডিটাতে যোগ্য লোকের বড়ই অভাব। যোগ্যতায় যিনি ঋদ্ধ, প্রেরণা ও সামর্থ্যে যিনি বলীয়ান এমন লোক হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র। আশার কথা হলো, তারুণ্যনির্ভর একটি শ্রেণী এ অঙ্গনের শূন্যতা পূরণের জন্য ব্যাপকভাবে এগিয়ে আসছে। কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, তাদের মধ্যে প্রেরণার দীপ্তিটা যত উচ্চকিত, যোগ্যতার বিচারে অগ্রসরতাটা তত নয়। তাদের অপুষ্টতা ও  অপরিপক্কতা চোখে পড়ার মতো। কথার ফুলঝুরি ও ভাবের প্রকাশভঙ্গি দেখে সবজান্তা মনে হলেও মূলত ফাঁপা ও অন্তঃসারশূন্য।
গণমাধ্যমের বিস্তৃত অঙ্গনটাকে নিজেদের আয়ত্বে রাখার কৌশল ও চেষ্টা ইসলামী ভাবধারার লোকদের মধ্যে সক্রিয় না থাকলে এ অঙ্গনে সারাজীবন সংখ্যালঘু ও নিরীহ হিসেবেই থাকতে হবে। অন্য ভাবধারা ও দর্শনে বিশ্বাসীদের গড়া গণমাধ্যমে কভারেজ পাওয়ার অলিক আশা ছাড়তে হবে। এই সত্য ও বাস্তবতা আমাদের মেনে নিতেই হবে যে, গণমাধ্যমের কর্তৃত্ব ও মালিকানা যাদের হাতে তাদের ইচ্ছে অনুযায়ীই পরিচালিত হবে গণমাধ্যম। মিডিয়া বা গণমাধ্যমের নিজস্ব কোনো নীতি-নৈতিকতা নেই। ‘মিডিয়া-হাতি’ পালনে যারা উজাড় হয়ে অর্থ ব্যয় করছেন তারাই মিডিয়ার আনুকূল্য ও সহযোগিতা পাবেন। ওই শ্রেণীটি যা চাইবেন, যে ভাবধারা লালন করবেন এরই প্রতিফলন ঘটবে গণমাধ্যমে। আদর্শিক, নৈতিক, মূল্যবোধের এবং ইসলামী ধারার কোনো গণমাধ্যমের স্বপ্ন দেখলে আপনাকেও ‘মিডিয়া-হাতি’ পালনের দুঃশাহস দেখাতে হবে। নিছক আবেগ ও সাময়িক উত্তেজনায় নয়, বাস্তবতার নিরিখে পেশাদারী মনোভাব নিয়েই এ অঙ্গনে টিকে থাকতে হবে। যতদিন না গণমাধ্যমে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করবে ততদিন আদর্শিক ও ইসলামী ধারার লোকদের বৈরি মিডিয়ার উৎপাত সইতে হবেই। তবে দিন দিন উৎপাতের মাত্রা যেভাবে বেড়ে যাচ্ছে তা থেকে নিষ্কৃতি লাভের যথাযথ ভাবনা এখনই সবাইকে ভাবতে হবে।

*

*

Top