জহির উদ্দিন বাবর
তিনি ছিলেন দেশের আলেমসমাজের অন্যতম অভিভাবক। গত কয়েক দশক ধরে শীর্ষ আলেমদের যেকোনো মজলিস ও আয়োজনে তাঁর অংশগ্রহণ ছিল অনিবার্য। বর্ণাঢ্য জীবন, ইলমি অবস্থান এবং ব্যক্তিত্বে সবার মধ্যে ঝলমল করতেন তিনি। প্রথম সারির বেশ কয়েকজন আলেম চলে যাওয়ার পর তাদের শূন্যতা অনেকটা পূরণ করেছিলেন অভিভাবকতুল্য এই আলেম। কিন্তু তিনিও চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তাঁর এই চলে যাওয়ায় দেশের আলেম-উলামা ও দীনদার শ্রেণির মধ্যে গভীর শূন্যতা ও হাহাকার বিরাজ করছে।
হ্যাঁ, বলছিলাম হজরতুল আল্লাম আশরাফ আলী রহ.-এর কথা। ২০১৯ সালের শেষ দিন তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তাঁর বিদায়ে সবার মধ্যে অভিভাবক হারানোর বেদনা লক্ষ্য করা গেছে। দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে আনুষ্ঠানিক শোক জানিয়েছেন সমাজের নানা পর্যায়ের মানুষ। দল-মত নির্বিশেষে তাঁর প্রতি সবার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ দেখে মনে হয়েছে, তিনি একজন সত্যিকারের নায়েবে নবী ছিলেন। এমন আলেমের মৃত্যুকেই হাদিসে ‘আলমের’ (জগতের) মৃত্যু বলা হয়েছে।
শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ.-এর ইন্তেকালের পর তাঁর শূন্যতা কিছুটা হলেও পূরণ করেছিলেন হজরত আশরাফ আলী রহ.। বিশেষ করে শায়খুল হাদিস রহ. যেখানে যেখানে বুখারির দরস দিতেন সেখানে আশরাফ আলী রহ. পর্যায়ক্রমে অধিষ্ঠিত হন। অভিজ্ঞতা ও ইলমি অবস্থানের কারণে তিনি সবার আস্থা ও ভালোবাসার মণিকোঠায় স্থান করে নেন। আলেম-উলামার অবিসংবাদিত অভিভাবক আল্লামা শাহ আহমদ শফী দা.বা.-এর পর হাইয়্যাতুল উলয়া ও বেফাকে তিনিই সর্বোচ্চ আসনটি অলঙ্কৃত করবেন-এমনটা নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ ছিল না। হাটহাজারী হুজুরের অনুপস্থিতিতে আলেমদের জাতীয় এই দুটি প্রতিষ্ঠানে কার্যত তিনিই প্রধান ভূমিকা পালন করতেন। এজন্য তাঁর চলে যাওয়া সবাইকে প্রচ-ভাবে নাড়া দিয়েছে, একটা শূন্যতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
মুজাহিদে মিল্লাত মাওলানা আতহার আলী রহ., মুজাহিদে আজম আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ., কায়েদে মিল্লাত মোহাম্মদ আলী হাফেজ্জী হুজুর রহ.সহ অসংখ্য বুজুর্গানে দীনের সান্নিধ্য এবং একসঙ্গে কাজ করার বিরল অভিজ্ঞতা হয়েছে আল্লামা আশরাফ আলী রহ.-এর। যাদের নাম শুনলে এই অঞ্চলের আলেম-উলামা এবং দীনদার শ্রেণির মাথা ভক্তিতে নুইয়ে আসে তাদের অনেককে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছেন, তাদের সোহবতে ধন্য হয়েছেন হজরত আশরাফ আলী রহ.। এজন্য প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি, ইলমি গভীরতা ও অভিজ্ঞতার বিচারে তিনি পরবর্তীদের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে ছিলেন। দেশের শীর্ষ পর্যায়ের অসংখ্য আলেম সরাসরি তাঁর ছাত্র। এ হিসেবে তাঁর অবস্থান ও প্রভাব ছিল অনেকের চেয়ে ভিন্ন। সবার ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অনন্য মিনার ছিলেন তিনি।
হজরত আশরাফ আলী রহ. প্রথমত একজন আদর্শ শিক্ষক ছিলেন। মানুষ গড়াই ছিল তাঁর প্রধান কাজ। প্রায় ছয় দশক তিনি ইলমে হাদিসসহ দীনি ইলমের খেদমত করে গেছেন। হজরত আতহার আলী রহ.-এর প্রতিষ্ঠিত কিশোরগঞ্জের জামিয়া ইমদাদিয়া থেকে শুরু করে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অন্য অনেক ব্যস্ততার সঙ্গে তিনি দরস-তাদরিসের খেদমতটুকু অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করেছেন। শুনেছি, জামিয়া ইমদাদিয়ায় ছাত্রদের গঠনের জন্য তিনি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে কুমিল্লার কাসিমুল উলূমে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে তিনি খ্যাতি পেয়েছিলেন। সেখানকার ছাত্রদের কাছ থেকে শোনা, কাসিমুল উলূমে অন্য উস্তাদদের বাইরের নানা ব্যস্ততা ছিল। রাতে বেশির ভাগ উস্তাদ মাদরাসার বাইরে থাকতেন। কিন্তু আশরাফ আলী রহ. রাত-দিন পড়ে থাকতেন মাদরাসায়। ছাত্রদের নিয়েই তাঁর কাটত রাত-দিন। পরবর্তী সময়ে ঢাকার জামিয়া রাহমানিয়া, জামিয়া শারইয়্যা মালিবাগেও তাঁকে ছাত্রদের নিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। দীনি অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও দরস-তাদরিসে তাঁর স্বতস্ফূর্ততা লক্ষ্য করা গেছে।
আল্লামা আশরাফ আলী রহ.-এর জীবনের একটি বড় দিক হলো ইসলামি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা। পাকিস্তান আমলে নেজামে ইসলাম পার্টির যখন যৌবনকাল তখন তিনি এই দলটির সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। নেজামে ইসলাম পার্টির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। আশির দশকে হাফেজ্জী হুজুরের তওবার রাজনীতিতেও তাঁর অংশগ্রহণ ছিল। পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে অনেকটা দূরে সরে গিয়েছিলেন। দরস-তাদরিস আর তাসাউফের লাইনে নিমগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। শায়খুল হাদিস রহ.-এর ডাকে এক পর্যায়ে আবার সক্রিয় হলেন রাজনীতিতে। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। এদেশে ইসলামি শাসনব্যবস্থা কায়েম হোক সেই স্বপ্ন তিনি দেখতেন। এজন্য ইসলামি আন্দোলন-সংগ্রামের নানা পর্যায়ে আমরা তাঁকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে দেখেছি। ইসলামি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত সবাইকে তিনি ভালোবাসতেন, প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন। সবার ক্ষেত্রে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতেন। তাঁর মতো একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও পোড় খাওয়া আলেম রাজনীতিক ইসলামি রাজনীতির জন্য আশির্বাদতুল্য।
পুরোনো যুগের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও তিনি নতুনকে ধারণ করতেন। নতুনদের মধ্যে যারা এগিয়ে যাচ্ছে তাদের উৎসাহ দিতেন। দীনের জন্য ক্ষতিকর নয় এমন কিছু গ্রহণ করতে তার আপত্তি ছিল না। সব ব্যাপারে তাঁর সচেতনতা ছিল লক্ষ্যণীয়। বিশেষ করে বেফাক ও হাইয়্যার বৈঠকগুলোতে তিনি অত্যন্ত সচেতনতার পরিচয় দিতেন বলে জানিয়েছেন সেখানে উপস্থিত অনেকেই। কওমি মাদরাসা সনদের স্বীকৃতি বাস্তবায়নে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। একদিকে সরকারি স্বীকৃতি প্রয়োজন, অন্যদিকে কওমি ধারায় যেন অনাকাক্সিক্ষত কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয় সে ব্যাপারে সবসময় সচেতন ছিলেন। শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও তিনি বেফাক-হাইয়্যার বৈঠকগুলোতে গুরুত্বের সঙ্গে অংশ নিতেন। এই দুটি প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর করার জন্য তাঁর প্রচেষ্টার কোনো কমতি ছিল না।
দীনের জন্য তিনি গোটা জীবন ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। জীবনের শেষ কয়েক বছর অসুস্থতা নিয়েও ঘুরে বেরিয়েছেন দেশের নানা প্রান্তরে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় উপস্থিতি, বেফাক-হাইয়্যাকে কার্যকর করা, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা, দরসে বুখারি পাশাপাশি ওয়াজ-নসিহত ও তাসাউফের লাইনে অবিরত কর্মমুখর থাকতে দেখেছি তাঁকে। দীনের জন্য ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যাকে তুচ্ছ করেছেন তিনি। ইন্তেকালের আগে গুরুতর অসুস্থতা নিয়ে যখন রাজধানীর আসগর আলী হাসপাতালে ভর্তি তখনও তিনি নিজেকে নিয়ে নয়, দীনের কথা ভেবেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন। সেখানে ব্যক্তিগত কোনো চাওয়া-পাওয়ার কথা নয়, কাদিয়ানিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে কাফের ঘোষণার দাবি জানিয়েছিলেন তিনি। এটাই প্রমাণ করে তিনি দীনের জন্য কতটা নিবেদিত ছিলেন। ইসলামের জন্য নিবেদিত এই বান্দাকে কবুল করে আল্লাহ তাঁকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন। আমিন।
ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অনন্য মিনার
Tags