জহির উদ্দিন বাবর
অবহেলা আর তুচ্ছতাচ্ছিলের শিকার ভাগ্যবিড়ম্বিত এক জনগোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা। কিছুদিন পরপর তথাকথিত নিরীহ জাতি বৌদ্ধরা তাদের কচুকাটা করে। কিন্তু সারা বিশ্ব তখন নীরবতা পালন করে। ‘টু’ শব্দ নেই তথাকথিত মানবাধিকারের ফেরিওয়ালাদের। এমনকি মুসলিম বিশ্বও তাদের নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামায় না। রোহিঙ্গারা যে মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত সে কথা যেন কারোর মনেই পড়ে না। গত কিছুদিন ধরে রোহিঙ্গা মুসলিমদের গণহারে নিধনযজ্ঞ চলছে। জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের ‘বিশ্বের অন্যতম নির্যাতিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
একটি কুকুর না খেয়ে মারা গেলে তথাকথিত যে সভ্য দুনিয়ায় চোখের পানির স্রোত বয়ে যায়, বন্য প্রাণী বাঁচাতে যেখানে কোটি কোটি ডলারের ফান্ড অনায়াসে সংগৃহীত হয়, মিয়ানমারে মাসের পর মাস নির্বিচারে নিরপরাধ নারী-শিশু-বৃদ্ধকে হত্যা করার পরও সেখানে কোনো সাড়া পড়ে না। কোনো কুলাঙ্গার ইসলামের নবী বা ধর্মকে কটাক্ষ করে প্রাণ বাঁচাতে দেশান্তরিত হলে সভ্য দুনিয়ায় তার আশ্রয়ের অভাব হয় না। তার স্বদেশ ত্যাগের বেদনায় সমব্যথী ব্যক্তি বা দেশের অভাব হয় না। অথচ নিজ দেশে পরবাসী রোহিঙ্গা মুসলিমদের জোর করে দেশ থেকে বের করে দেয়া হলেও এ নিয়ে তাদের কোনো উচ্চবাচ্য নেই। মানববন্ধন, টক শো কিংবা জাতিসংঘের কোনো বিশেষ বৈঠক নেই। এই বিশ্বে বাঘ সংরক্ষণের আহ্বানে পত্রিকার শিরোনাম করা হয়, সম্মেলন হয় কিন্তু সারাবিশ্বে ৫৭টি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ থাকা সত্ত্বেও মুসলিমদের গণহত্যা থেকে রক্ষা করতে কোনো সম্মেলন হয় না। রোহিঙ্গাদের ‘অপরাধ’ তারা মুসলমান। তবে তাদের দুর্ভাগ্য, মুসলমান নামধারীদের কাছ থেকেও তারা সুবিচার পাচ্ছে না।
রোহিঙ্গারা পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন স্টেটের উত্তরাংশে বসবাসকারী একটি জনগোষ্ঠী। ধর্মের বিশ্বাসে এরা অধিকাংশই মুসলমান। রাখাইন স্টেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হলো রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের সরকারি হিসাব মতে, প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা আরাকানে বসবাস করে। রোহিঙ্গারা বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠীগুলোর একটি। কয়েক দশক ধরে আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলিমরা নিজ দেশে পরবাসী হয়ে থাকছে। রোহিঙ্গাদের জোর করে বৌদ্ধধর্ম পালনে বাধ্য করা হয়। মুসলিম স্থাপনাসমূহ রাখাইন বৌদ্ধরা দখল করে নিচ্ছে বলেও অভিযোগ আছে। প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধ অধ্যুষিত মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, সীমান্ত রক্ষীবাহিনী, পুলিশ ও স্থানীয় বৌদ্ধদের আক্রমণে মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে। সেখানে রোহিঙ্গা মুসলিমরা চরম মানবেতর জীবনযাপন করছে। অধিকাংশ মুসলিমের জীবনের নিরাপত্তা নেই। তারা চরম নির্যাতন-নিপীড়নের মধ্যে অসহায় জীবনযাপন করছে। মিয়ানমারে মিডিয়া কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কারণে রোহিঙ্গা নির্যাতনের খবর সিকিভাগও আমরা জানতে পারছি না।
রোহিঙ্গারা সবধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার মূল কারণ হলো তাদেরকে নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি দেশটির সরকার। ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও রোহিঙ্গারা এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত নয়। মিয়ানমার সরকারের দাবি, রোহিঙ্গারা হলো ভারতীয়, বাঙালি ও চাঁটগাইয়া সেটলার, যাদেরকে ব্রিটিশরা আরাকানে এনেছে। যদিও ঐতিহাসিকভাবে এটি প্রতিষ্ঠিত যে, ব্রিটিশরা বার্মায় শাসক হিসেবে আসার কয়েক শতাব্দী আগে থেকেই রোহিঙ্গারা আরাকানে আসে এবং জাতি হিসেবে বিকশিত হতে থাকে।
নাগরিক হিসেবে স্বীকার না করায় সবকিছু থেকেই বঞ্চিত রোহিঙ্গারা। মিয়ানমারে ভ্রমণ, শিক্ষা, চিকিৎসার জন্য পরিচয়পত্র থাকাটা খুবই জরুরি বিষয়। কিন্তু মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের পরিচয়পত্র ইস্যু করে না। ফলে এমনিতেই পিছিয়ে পড়া রোহিঙ্গারা আরও পিছিয়ে পড়েছে। মিয়ানমার সরকারের ভূমি ও সম্পত্তি আইন অনুসারে বিদেশিরা কোনো সম্পত্তি ও ভূমি মালিক হতে পারে না। রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সরকারের দৃষ্টিতে অবৈধ অভিবাসী তথা বিদেশি। তাই, রোহিঙ্গারা কোনো ভূমি বা স্থায়ী সম্পত্তির মালিক হতে পারে না। বর্তমানে যেসব ভূমিতে রোহিঙ্গারা বসবাস করছে, মিয়ানমার সরকার যেকোনো মুহূর্তে সেগুলো দখল করে নিতে পারে।
রোহিঙ্গারা সরকারি চাকরি করতে পারে না, সরকারি কোনো দপ্তরের সেবা তারা পায় না। এমনকি ব্যাংকে লেনদেন করতে পারে না। সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রের সেবা গ্রহণ করতে পারে না, উপযোগ সেবার (বিদ্যুৎ, পানি, জ্বালানি) জন্য আবেদন করতে পারে না, স্বপরিচয়ে শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে ভর্তি হতে পারে না। প্রায় ৮০ ভাগ রোহিঙ্গা বাস্তবিক অর্থে অশিক্ষিত। শিক্ষার আলো তাদের ওপর পড়ে না। মিয়ানমারের প্রশাসন রোহিঙ্গাদের জোর করে শ্রমিক হিসেবে খাটায়। প্রায়ই স্থানীয় প্রশাসন ও সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন লোকালয়ে হানা দেয়। শহরের সৌন্দর্যবর্ধন, সরকারি জমি অধিগ্রহণের নামে রোহিঙ্গাদের অনেকগুলো মসজিদ ইতোমধ্যে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রাচীন কিছু মসজিদও আছে।
রোহিঙ্গাদের বিয়ে করার জন্যও স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নেয়া লাগে। এছাড়া দুটোর বেশি সন্তান নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মানবেতর জীবনযাপন করা এসব রোহিঙ্গা অতিষ্ঠ হয়ে একটু শান্তির সন্ধানে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডের পথে পা বাড়ায়। নৌপথে সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে অসংখ্য রোহিঙ্গা সাগরে ডুবে করুণভাবে প্রাণ হারিয়েছে। বিগত কয়েক দশক ধরে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ সীমান্তে পুশ ইন করছে। রুটিনমাফিক নির্যাতন করে রোহিঙ্গাদের বাধ্য করছে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে। বর্তমানে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রিত অবস্থায় বসবাস করছে। যদিও রিফিউজি হিসেবে বাংলাদেশে তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা আরও কম। বাংলাদেশ সরকারও রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত নয়। কক্সবাজারে যেসব রোহিঙ্গা এসে আশ্রয় নিয়েছে তারা খুবই মানবেতর জীবনযান করছে। কিন্তু তাদের তাদের প্রতি নেই বিশ্বের কারও নজর।
মিয়ানমারে এখন ক্ষমতায় তথাকথিত শান্তিতে নোবেল বিজয়ী নেত্রী অং সান সুচি। কিন্তু মুসলমানদের মানবাধিকার নিয়ে তিনি কখনো ‘টু’ শব্দটিও করেননি। এমনকি তার শাসনামলে যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়ে গেছে রোহিঙ্গা নিধন। ভাগ্যবিড়ম্বিত এই জাতির জন্য এখন আল্লাহই যেন একমাত্র ভরসা।