জহির উদ্দিন বাবর
মূলধারার লেখালেখির পরিচিত মুখ ড. জাফর ইকবাল গত ৩ মার্চ ছুরিকাঘাতে আহত হয়েছেন। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অনুষ্ঠান চলাকালে পুলিশি পাহারার মধ্যেই তার ওপর এই হামলার ঘটনা ঘটে। কয়েকশ শিক্ষার্থী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আক্রান্ত হন শিক্ষক জাফর ইকবাল। তার ওপর এই হামলার ঘটনা নিয়ে দেশ-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ধারাবাহিকভাবে গণমাধ্যমে কয়েক দিনব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন জাফর ইকবাল। তার আঘাত তেমন গুরুতর না হলেও সরকারি এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাৎক্ষণিকভাবে তাকে ঢাকায় আনা হয় এবং সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) তাকে চিকিৎসা দেয়া হয়।
জাফর ইকবাল দেশের প্রথম শ্রেণির একজন নাগরিক। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, জনপ্রিয় লেখক ও বুদ্ধিজীবী। বাংলা সাহিত্যের তুমুল জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের ছোটভাই তিনি। নানা সময় বিভিন্ন কারণে জাফর ইকবাল বাংলাদেশে একটি আলোচিত নাম। তাকে চিনে না এমন শিক্ষিত ও সচেতন মানুষের সংখ্যা নেই বললেই চলে। তার মতো এমন ব্যক্তির ওপর প্রকাশ্যে হামলার ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেয়ার মতো না। এই ধরনের ঘটনা যেই ঘটাক তার সুষ্ঠু বিচার হোক এটা সবারই দাবি। জাফর ইকবালের ওপর হামলার পর বিভিন্ন মহল থেকে এই দাবি উঠেছে। তিনি কী মতের, কোন দলের অনুসারী এটা বিবেচনায় না নিয়ে সবাই তার প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন, ন্যাক্কারজনক এই কাজের নিন্দা করেছেন।
জাফর ইকবালের ওপর এই হামলার ঘটনায় কিছু বিষয় আলোচনায় এসেছে। তাকে আগেও বিভিন্ন সময় হুমকি দেয়া হয়েছে অজ্ঞাত পরিচয়ে। ফলে সরকার তার জন্য পুলিশি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। যে অনুষ্ঠানে তার ওপর হামলার ঘটনা ঘটে সেখানেও তার নিরাপত্তার দায়িত্বে পুলিশ নিযুক্ত ছিল। গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবি ও ভিডিও থেকে দেখা যায়, তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন তিন পুলিশ সদস্য, সঙ্গে আছে হামলাকারী যুবকও। মজার ব্যাপার হলো, হামলাকারী যুবক ছিল জাফর ইকবালের সঙ্গে লাগোয়া, আর পুলিশ সদস্যরা ছিল একটু দূরে। তিন পুলিশের মধ্যে আবার দুজন মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটিতে ব্যস্ত ছিলেন। এই হামলার ঘটনার পর প্রশ্ন উঠেছে, নিরাপত্তার দায়িত্বে পুলিশ নিযুক্তের পরও হামলার ঘটনা ঘটলে আর নিরাপত্তা দিয়ে কী লাভ!
তার ওপর হামলার ঘটনার পরপরই শিক্ষামন্ত্রী ঢাকা থেকে ছুটে গেছেন সিলেটে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে রাতেই তাকে ঢাকায় এনে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। দেশের খ্যাতিমান একজন শিক্ষাবিদ ও লেখকের জন্য রাষ্ট্রের এমন উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তবে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, জাফর ইকবালের ক্ষেত্রে যা করা হলো সেটা কি দেশের অন্য কোনো বুদ্ধিজীবী বা লেখক পাবেন? প্রয়োজনের মুহূর্তে রাষ্ট্র পাশে দাঁড়াবে এটা তো প্রায় সব নাগরিকই আশা করে। কিন্তু আসলেই কি রাষ্ট্র সবার ক্ষেত্রে সমান উদ্যোগী হয়? আমরা প্রায়ই অনেক জ্ঞানী-গুণী, আলেম-উলামা, দেশের জন্য নিবেদিত মানুষের করুণ অবস্থার কথা শুনি; কই রাষ্ট্র তো তাদের পাশে যেভাবে দাঁড়ানো উচিত সেভাবে দাঁড়ায় না! জাফর ইকবালের ক্ষেত্রে সরকার যেভাবে হুটহাট করে সবকিছু করেছে সেটা সবার ক্ষেত্রে করবে এটাই প্রত্যাশা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সবাই কি আর জাফর ইকবালের কপাল নিয়ে জন্মায়! জাফর ইকবালের মতো সবাই কি আর সরকারকে সার্ভিস দেয়! জাফর ইকবালের মতো সবার মতের সঙ্গে কি আর সরকারের মতের মিল হবে!
একটি ভরপুর অনুষ্ঠানে, নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্যে যেভাবে জাফর ইকবালের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তির ওপর হামলার ঘটনা ঘটল এতেই বোঝা যায় দেশের মানুষের নিরাপত্তা কতটা ঝুঁকিতে আছে। চারদিকে চলছে অরাজকতা। কাকে মেরে কে খাবে সেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত সবাই। মানুষের প্রাণের নিরাপত্তা নেই, স্বাধীনভাবে চলাচলের নিরাপত্তা নেই, মন খুলে কথা বলা বা স্বাধীন মত প্রকাশের স্বাধীনতাও নেই। একটি বদ্ধকর পরিবেশের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে দেশের মানুষ। এই অবস্থায় জাফর ইকবালের মতো তারকা ব্যক্তিদের ওপর প্রকাশ্যে হামলার ঘটনায় সবার উদ্বেগ আরেকটি বাড়িয়ে দেয়।
দুই.
জাফর ইকবালের ওপর হামলা চালিয়েছে একটি যুবক। হামলার সময় দেখা গেছে জাফর ইকবালের ঠিক পেছনে গোবেচারা টাইপের ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে। কেউ দেখে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলেই ভাববে। আচমকা তার হামলার শিকার হন জাফর ইকবাল। পুলিশ ও ছাত্ররা এগিয়ে আসতে আসতে সে জাফর ইকবালের গায়ে কয়েকটি আঘাত করে। তবে কোনো আঘাতই তেমন গুরুতর নয়। ফলে জাফর ইকবাল সেরে উঠতে খুব বেশি সময় লাগেনি। তিনি রক্ষা পেয়েছেন এবং দ্রুত সেরে উঠেছেন এতে দেশের সবাই খুশি। তবে জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনা নিয়ে বরাবরের মতোই রাজনীতি হয়েছে। এই ঘটনা নিয়ে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল পরস্পরের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়েছে। বরাবরের মতোই কোনো তদন্ত ছাড়াই পরস্পরকে দুষেছেন রাজনৈতিক দলের দায়িত্বশীল নেতারা।
জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারী ছেলেটিকে হাতেনাতে ধরে গণধোলাই দিয়েছে ছাত্ররা। তার অবস্থা অনেক গুরুতর ছিল। তবে চিকিৎসার পর ওই যুবকও সেরে উঠেছে। জানা গেছে, যুবকটি সালাফি মতবাদে বিশ্বাসী। তার দুই চাচা কুয়েতে থাকেন, তাদের দ্বারাই সে সালাফি মতবাদে দীক্ষিত হয়। সে আলিয়া মাদ্রাসায় দাখিল পর্যন্ত পড়েছে। তার বাবাও একটি মাদরাসার শিক্ষক। কয়েক দিন পর্যন্ত গণমাধ্যমে যুবক ফাইজুল হাসান সম্পর্কে নানা তথ্য এসেছে। তবে এসব তথ্যেও ছিল অনেক অসঙ্গতি। কোনটা সত্য আর কোনটা অসত্য এটা নিয়ে অনেককে ধোঁয়াশায় পড়তে হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, এই যুবক জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টার দায় স্বীকার করেছে। সে জানিয়েছে, জাফর ইকবাল ইসলামবিরোধী কথা লিখেছেন এজন্য সে এই হামলা করেছে। তবে ইসলামবিরোধী কী লিখেছে এ সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য দিতে পারেনি সে। একজন সম্পর্কে ভাসাভাসা ধারণার ওপর তাকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে খুন করতে যাওয়া আদৌ সম্ভব কি না তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। এই যুবক ইসলাম সম্পর্কে কতটা ধারণা রাখে সেটাও সামনে এসেছে বড় করে। এই যুবকের সঙ্গে তেমন কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর যোগসূত্রতাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাহলে এই যুবক কেন জাফর ইকবালকে খুন করতে গেল, তাকে এই কাজে কে উদ্বুদ্ধ করেছে, সে কারও দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছে কি না; আদৌ কি ইসলাম অবমাননার জন্য নাকি অন্য কোনো কারণে এই হত্যাচেষ্টা এসব প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর এখনও মিলেনি।
তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, বরাবরের মতোই এই হামলার ঘটনার পর থেকে এর সঙ্গে ইসলাম, আলেম-উলামা, মাদরাসা শিক্ষিতদের জড়ানোর একটা অপচেষ্টা হয়েছে। এক শ্রেণির মিডিয়া ওঁৎ পেতে থাকে, কোনো ঘটনার সঙ্গে একটু মাদরাসা শিক্ষিতদের জড়াতে না পারলে যেন তাদের পেটের ভাত হজম হয় না। সুযোগ পেলেই ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে মাদরাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে বিষোদগার করে ছাড়ে। একই ভাঙা ক্যাসেট তারা বারবার বাজায়। বিশেষ করে কওমি মাদরাসাগুলোর সঙ্গে জঙ্গিবাদকে জড়ানোর একটি অপচেষ্টা বরাবরই হয়ে আসছে। জাফর ইকবালের ওপর হামলার পরও হয়েছে। হামলাকারী অভিযোগে যে ছেলেটি গ্রেপ্তার হয়েছে সে কওমি মাদরাসার ছাত্র না, তবুও তাকে জোর করে কওমি মাদরাসার বানানোর চেষ্টা হয়েছে। এমনকি ইসলামপন্থীদের দুধ-কলা খেয়ে বেড়ে উঠা দৈনিক ইনকিলাব পর্যন্ত ন্যাক্কারজনক এই কাজটি করে সমালোচিত হয়েছে।
তথাকথিত বুদ্ধিজীবী কোনো ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই এর দায় মাদরাসাপড়–য়াদের ওপর চাপিয়ে দিতে উঠেপড়ে লাগে। টেলিভিশনের টক শোতে বসে ইনিয়ে-বিনিয়ে এর সঙ্গে জোর করে হলেও ইসলামপন্থীদের যোগসূত্রতা খোঁজে বেড়ায়। জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনার পরও সেটা হয়েছে। কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী সরাসরি মাদরাসা শিক্ষাকে দুষেছেন। মৌলবাদীরা দেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর সেটা ইনিয়ে-বিনিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এটা ইসলামপন্থী বা মৌলবাদীরা করেছে এর কি কোনো প্রমাণ আছে! একজন যুবক এই কাজের সঙ্গে জড়িত, এর দায় কি বর্তাবে পুরো মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার ওপর! তাহলে হলি আর্টিজানে যারা হামলা চালিয়ে জঘন্য হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তারা কোন প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছিল? তারা তো সবাই নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় আর তথাকথিত এলিট শ্রেণির সদস্য ছিল। কই তখন তো কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেনি। এই শিক্ষা জাতির জন্য ক্ষতিকর সেটা কেউ বলেনি। এতেই বোঝা যায়, এদেশের তথাকথিত সুশীল সমাজ, কথিত বুদ্ধিজীবী এবং মূলধারার গণমাধ্যমের গলার কাঁটা হলো ইসলামপন্থীরা। সুযোগ পেলেই ইসলামপন্থীদের ঘায়েল করাই হচ্ছে তাদের কাজ।
আমাদের সরকার, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবার টার্গেট ইসলামপন্থীরা। কোনো ঘটনা ঘটলেই যাচাই-বাছাই ছাড়াই সবাই ঢালাও মন্তব্য করতে থাকে এটা মৌলবাদীদের কাজ, মাদরাসা শিক্ষিতদের কাজ। তথাকথিত জঙ্গিবাদের সঙ্গে মাদরাসা এবং আলেম-উলামাকে জড়াতে না পারলে যেন তা জমে উঠে না। যেকোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ যে উগ্রবাদী হতে পারে, কোনো কারণে যে কেউ বিক্ষুব্ধ হতে পারে সেটা তাদের মাথায় থাকে না। ইসলাম সম্পর্কে কটূক্তি এবং ইসলামপন্থীদের আঘাত দিয়ে কথা বলা আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের একটি ফ্যাশন। কথিত বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের এমন সদস্য খুব কমই পাওয়া যাবে যারা ইসলামপন্থীদের ব্যাপারে আজেবাজে মন্তব্য করেননি কিংবা তাদের সম্পর্কে বিরূপ ধারণা পোষণ করেন না। তাদের কেউ অন্য কোনো কারণে আক্রান্ত হলেও দায় পড়ে ইসলামপন্থীদের ওপর। এটা যে স্বার্থবাদী যেকোনো শ্রেণি বা গোষ্ঠীর লোকজন করতে পারে সেটা কারও চিন্তায় আসে না। ফলে এ ধরনের ঘটনাগুলোতে একতরফা দোষারোপ চলে। এতে প্রকৃত দোষীরা বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
চলমান শতাব্দীর শুরু থেকে আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে জঙ্গিবাদের বিষয়টি অনেক বড় করে সামনে এসেছে। আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ বাদ দিলাম, গত ১৮ বছরে বাংলাদেশে তথাকথিত জঙ্গিবাদের যেসব ঘটনা ঘটেছে এর সঙ্গে মূলধারার আলেম-উলামা এবং কওমি মাদরাসাপড়–য়াদের সম্পৃক্ততা কত ভাগ? জোর গলায় বলতে পারি সেটা শতকরা পাঁচ ভাগও হবে না। যে কেউ কোনো উদ্দেশ্যে কিংবা কায়েমি কোনো স্বার্থবাদীদের ফাঁদে পড়ে ইসলামের নামে কোনো ঘটনা ঘটালে এর দায় ইসলামের ধারক-বাহকদের ওপর চাপিয়ে দেয়া উচিত নয়। জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত যাদেরকে নানা সময় গ্রেপ্তার করা হয়েছে কিংবা বিভিন্ন অভিযানে যারা মারা গেছে তাদের কতজন প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা পেয়েছেন? ইসলামি লেবাস ধারণ করলেই কেউ ইসলামের ধারক হয়ে যায় না। কারণ ইসলামি লেবাস এবং আকৃতি ধারণ করা খুব সহজ। কিছুদিন দাড়ি না কাটলে আর গায়ে একটা পাঞ্জাবি-টুপি লাগালেই আমাদের সমাজে তাকে ইসলামপন্থী হিসেবে মনে করতে থাকে। আসলে কি ইসলামপন্থী হওয়ার মাপকাঠি এটা?
শুধু বাহ্যিক অবয়বের নাম ইসলাম নয়। ইসলাম একটি আদর্শের নাম, সুমহান একটি শিক্ষার নাম। এই আদর্শ ও শিক্ষা ধারণ না করে শুধু দাড়ি রাখলে আর টুপি-পাঞ্জাবি পরলেই ইসলামপন্থী হিসেবে গণ্য করা দুঃখজনক। এই বিবেচনায় কাউকে ইসলামপন্থী বা মৌলবাদী হিসেবে ধরলে করার কিছু নেই। ইসলামকে যারা কলুষিত করতে চায়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসলামকে যারা ভয়ংকর রূপে উপস্থাপন করতে চায় তাদের দ্বারাও খুব সহজেই এই লেবাস আর অবয়ব ধারণ করা কোনো ব্যাপার না। এজন্য শুধুই অবয়ব দেখে কাউকে ইসলামের ধারক মনে করে ইসলামপন্থীদের ওপর যেকোনো ঘটনার দায় চাপিয়ে দেয়া উচিত নয়। এর দ্বারা কখনও সমাধান আসবে না। প্রকৃত অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
তিন.
কেউ ভিন্নমত পোষণ করলেই তাকে আক্রমণ করে বসার কথা ইসলামে কোথাও বলা হয়নি। জিহাদ ইসলামের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেটা কোনো মুসলমানের পক্ষে অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে বিশেষ প্রেক্ষাপটে সুনির্দিষ্ট শর্তের ভিত্তিতেই জিহাদ ফরজ হয়। মনগড়া ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে কেউ চাইলেই জিহাদের নামে হঠকারিতার অধিকার রাখে না। আজ বিশ্বের নানা স্থানে জিহাদের নামে যা কিছু হচ্ছে সেটা কতটুকু কুরআন-হাদিসের বিধানসম্মত জিহাদ এটা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। কোথাও কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেই সেটার সঙ্গে জিহাদের মতো পবিত্র জিনিসকে জড়ানো কোনোভাবেই সমীচীন নয়।
ইসলামের মূল স্পিরিট এবং মৌলিক মানবাধিকার ভিন্নমতকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। আপনি আপনার মত নিয়ে থাকবেন, আমি আমার মত নিয়ে থাকব। আমি যা বিশ্বাস করি সে অনুযায়ী চলব, আপনি যা বিশ্বাস করেন সে অনুযায়ী চলবেন। কেউ কারও মতকে বাধাগ্রস্ত করব না। কিন্তু আপনার মত আপনার পর্যন্ত ঠিক আছে, তা যখন অন্যকে আঘাত করবে তখনই বাঁধে বিপত্তি। বিভিন্ন আইন ও নীতিকথা বলে ভিন্নমতকে দমন করা যাবে না। কিন্তু ভিন্ন মত যখন কারও মায়ের সতিত্বে আঘাত করে তখন কি আইন ও নীতিকথার কারণে কেউ বসে থাকে? আপনি যখন কারও মাকে গালি দেবেন, তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন তখন সে আপনাকে তার সাধ্য অনুযায়ী আঘাত করার চেষ্টা করবেই। তার জায়গায় আপনি থাকলেও সেটাই করতেন। একজন প্রকৃত মুসলমানের কাছে তার নবীর সম্মান মায়ের চেয়েও অনেক বেশি। সেই নবীকে নিয়ে, তার পরিবারকে নিয়ে কেউ কটূক্তি করলে মানুষ আইন ও নীতিবাক্যের বাইরে চলে যেতে বাধ্য হয়।
আমাদের সমাজে এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী আছেন যাদের কাজই হলো ইসলাম সম্পর্কে সুড়সুড়ি দেয়া; সুযোগ পেলেই ইসলামপন্থীদের আঘাত করে কথা বলা। এটাকে তারা প্রগতিশীলতা বলেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলেন। কিন্তু তাদের এই প্রগতিশীলতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ইসলামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অন্য কোনো ধর্মের ব্যাপারে তারা কখনও মুখ খুলেন না। অন্য কোনো ধর্মীয় বিশ্বাস তা যত ঠুনকোই হোক তাতে তারা আঘাত করেন না। তাদের মূল টার্গেটই হলো ইসলাম ও মুসলমান। তাদের বেশির ভাগই হয়ত নামধারাী মুসলমান, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা ইসলাম ও মুসলমানের ঘোর বিরোধী। এই শ্রেণিটি কারণে-অকারণে সরলমনা মুসলমানদের বিশ্বাসে নানা সময় আঘাত করে, তাদেরকে হেয় করে। সুতরাং তাদের প্রতি যে কেউ বিক্ষুব্ধ হতে পারে এটাই স্বাভাবিক।
ইসলাম, ইসলামি মূল্যবোধ, আলেম-উলামা, মসজিদ-মাদরাসা এসব নিয়ে সুড়সুড়ি দিয়ে যারা মজা পান তাদের একজন জাফর ইকবাল। নানা সময় তিনি এ ধরনের সুড়সুড়ি দিয়ে আলোচনার খোরাক জুগিয়েছেন। তার এই সুড়সুড়িমার্কা আচরণের জন্য কেউ তার ওপর ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়–ক সেটা আমরা কেউই সমর্থন করি না। কিন্তু তাদের মতো সমাজের সচেতন মানুষদের এ ব্যাপারে একটু সতর্ক হলে ক্ষতিটা কোথায়! বছর দুয়েক আগে বইমেলায় জাফর ইকবালের একটি বই এসেছে, যার নাম ‘ভূতের বাচ্চা সোলায়মান’। এটা নিয়ে তখন নানা সমালোচনা হয়েছে। সোলায়মান আ. একজন প্রখ্যাত নবী। তিনি ভূতের গল্প লেখেন ভালো কথা, ভূতের বাচ্চা হিসেবে একজন নবীর নামকেই কেন বাছাই করতে হবে তাকে? দুনিয়াতে কি নামের কোনো কমতি আছে! এটা যে শুধুই কাকতালীয় ঘটনা তা মনে করার কোনো কারণ নেই। অতীতেও তিনি এবং তার মতো কথিত প্রগতিশীলেরা কৌশলে এ ধরনের কাজ করেছেন। তাদের এই অযাচিত কাজগুলোই সমাজে অসহিঞ্চুতা বাড়ায়, মানুষকে উগ্রপন্থার দিকে তাড়িত করে। এজন্য এসব ব্যাপারে সবাইকে আরেকটু সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।