মানুষের জীবন তো একটাই। তা আবার একটি নির্দিষ্ট ফ্রেমে বন্দী। মানুষ চাইলেই এর বাইরে বেরোতে পারে না। অস্তিত্ব লাভ এবং বিনাশ কোনোটাতেই মূলত মানুষের হাত নেই। নির্দিষ্ট ফ্রেমের মধ্যে বিচরণের সময়টুকুই মানুষের কর্তৃত্বের আওতাভুক্ত। এই সময়ে মানুষ যা করে পরবর্তী জীবনে এর সুফল বা কুফল তাকে ভোগ করতে হয়। নির্ধারিত ছকে আঁকা এই সময়টুকুই মানবজাতির মূল পুঁজি। অস্তিত্বের সার্থকতা ও সফল জীবনের জন্য এই সময়টুকু খুব হিসাব-নিকাশ করে কাটাতে হয়। ‘শুধুই বাঁচার জন্য বাঁচা’ এটা অন্য প্রাণীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও মানুষের ক্ষেত্রে তো নয়। কারণ জীবন-পরবর্তী সময়টুকুও মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য প্রকৃতিগতভাবেই মানুষের চাওয়া-পাওয়া হলো ফ্রেমে বন্দী জীবনটুকু সার্থক করে তোলা।
সৃষ্টির স্বাভাবিক নিয়মে জন্মলাভ, বেড়ে ওঠা আর পরিণত বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণকেই কি একজন মানুষের সার্থক জীবন বলা চলে? আসা-যাওয়ার এই মিছিলে তো পৃথিবীতে অগণিত মানুষ অতীত হয়েছে; তাদের সবাই কি সফল? মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীও তো দীর্ঘ সময় জীবনকে উপভোগ করে এক সময় হারিয়ে যায়, তাদেরকেও কি সফল বলা হবে? না, কেউ তাদেরকে সফল বলবে না। পৃথিবীতে আসা আর যাওয়ার যে ধারাবাহিকতা তাতে সবাই সফল নয়, কেউ কেউ সফল। সবার জীবনকে সার্থক বলা চলে না, কারো কারো জীবন সার্থক। সেই কেউ কেউ বা কারো কারো সংখ্যাটা খুবই নগণ্য। গতানুগতিক আসা আর স্বাভাবিকভাবে চলে যাওয়ার মিছিলই ভারী।
আসা-যাওয়ার এই চলমান প্রক্রিয়ায় কত মানুষ যে অতীত হয়েছে এর কোনো হিসাব-কিতাব নেই। শতকরা একজন মানুষকেও কেউ স্মরণ রাখে না। হয়ত হাজারে একজন মানুষ এমন পাওয়া যাবে যাদেরকে পৃথিবীবাসী মনে রেখেছে যুগ-যুগ ধরে। অতীত হওয়ার শত বছর পরেও স্মরণীয় এমন সার্থক জীবন খুবই কম। অতি নগণ্য এই সার্থক জীবনের অধিকারী যারা তাদের এই সার্থকতার মূল হেতু কী? গতানুগতিক মানুষ আর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় জীবনযাপনের পরও কেন তারা স্মরণীয়? এর উত্তরটা হলো, নিজের জন্য তাদের কোনো ভাবনা ছিল না; মানুষের জন্যই ছিল তাদের যত ভাবনা। এজন্য মানুষেরা তাদেরকে হৃদয়ের মনিকোঠায় সযতনে জায়গা করে দিয়েছে। পরের জন্য কিছু করা, অন্যকে নিয়ে ভাবা, মানবিকতার বোধ ও চেতনা অন্তরে লালন এবং বাস্তবায়নই হলো সার্থক জীবনের চাবিকাঠি। পৃথিবীতে যারাই সফল হয়েছেন তারাই মানুষকে নিয়ে ভেবেছেন। মানুষের প্রতি তাদের দরদ ছিল আকাশছোঁয়া। মানবপ্রেম, হিতাকাক্সক্ষা, আর্তমানবতার সেবা, অন্যের প্রতি দয়া ও সহানুভূতি প্রদর্শনই হলো সার্থক মানবজীবনের মূল হাতিয়ার।
নিছক নিজেকে নিয়ে ভাবা আর ভোগবিলাসে ডুবে থাকায় মানবজীবনের সার্থকতা কোথায়? এটা বোধ-বুদ্ধিহীন প্রাণীর স্বভাব। অন্যকে টপকে নিজের ভাগটুকু দখল করা তো হিংস জীব-জানোয়ারের প্রকৃতি। ‘যা ইচ্ছে তাই করবো’ এই মনোভাব তো হলো চেতনা ও বিশ্বাসহীন প্রাণীর। একজন প্রকৃত মানুষ তো নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারে না। মানুষ তো তিনিই যার মধ্যে আছে মানবিকতা। মূল ধাতুর (মনুষ্যত্ব) অনুপস্থিতি মানুষকে তো নিয়ে যায় পশুর কাতারে। প্রকৃত মানুষ তো তিনিই যার ‘এ জীবন-মরণ সকলই পরের তরে’। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ এই চেতনাই হলো মানুষের বেঁচে থাকার প্রেরণা। পরের জন্য কিছু করায় যে তৃপ্তি তা নেই পৃথিবীর আর কোথাও। এজন্য যারা মানুষ তারাই উপভোগ করেন পৃথিবীটাকে। আর যারা অমানুষ বাহ্যিকভাবে তারা যত ভোগ-বিলাসই করুক মূলত তারা নিঃস্ব, বিবর্ণ জীবনের গ্লানিতে দগ্ধ।
দুই.
যুগে যুগে বিভিন্ন ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ মূলত মানুষকে কেন্দ্র করেই। প্রতিটি ধর্মই মানুষের প্রয়োজনের দিকটির প্রাধান্য দিয়েছে। মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার প্রতিটি মুহূর্তে ধর্ম তার আবেদনময়ী হাত প্রসারিত করেছে। প্রতিটি ধর্মের মূলধারা মানবতার পক্ষে। তবে বাস্তব ক্ষেত্রে ধর্মীয় আচরণ সব সময় মানবতাকে স্পর্শ করতে পারেনি। এটা ধর্মের দোষ নয়, দোষ হলো ধর্মের ধারক-বাহকদের। তবে এ অভিযোগ ইসলামের বিরুদ্ধে করা যাবে না। ইসলাম মানবতাবাদ ও মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী একটি ধর্ম। একথা শুধু শে-াগানসর্বস্ব নয়, বরং প্রায়োগিক ক্ষেত্রে এর উজ্জ্বল নজির বিদ্যমান। ইসলামের শত্রুরাও একথা স্বীকার করতে কুণ্ঠিত নয় যে, এই ধর্মটি মানুষের দরদ যতুটুকু বুঝেছে তা বোঝেনি অন্য কোনো ধর্ম। ইসলামের সহজাত ধারা মানবতা ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতি বহমান। ইসলামের প্রদীপ্ত শিখার দ্রুত বিচ্ছুরণের পেছনে এটি বিশেষ কারণ হিসেবে চিহ্নিত।
ইসলাম একটি মানুষকে মাতৃগর্ভ থেকে কবর পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দিয়েছে। যেকোনো দুর্যোগ ও সংকটে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। জীবনের পদে পদে ইসলামের করুণামিশ্রিত হাতছানি মানুষকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছে। ইসলাম মানুষের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধের যে বীজ বপন করে দিয়েছে তার নজির আর কোথাও পাওয়া যাবে না। ইসলামের মর্মবাণী হচ্ছে মানুষের জন্য, জীবনের জন্য সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও সহানুভূতি। মানুষের প্রয়োজনে মানুষ। সভ্যতার মূল উপাদান মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ আঞ্জাম দিয়েছে ইসলাম। ইসলামের আদর্শে আদর্শবান কারো জন্য মানুষের প্রয়োজনকে খাটো করে দেখার কিংবা এ ব্যাপারে উদাসীন থাকার কোনো অবকাশ নেই। এজন্য প্রতিটি মুসলমানকে মানবতাবাদী হওয়া তার ঈমান ও আদর্শের দাবি।
মানুষের হিতকামী হওয়া ইসলামের আদর্শ। মানুষের কল্যাণ ও সমাজের প্রয়োজনকে বড় করে দেখার শিক্ষা দিয়েছে ইসলাম। মানুষ তার নিজের প্রয়োজনে যত না ব্যতিব্যস্ত হবে তার চেয়ে বেশি উদগ্রীব হতে হবে অন্যের প্রয়োজন পূরণে। অন্যের জন্য মরণেও সুখÑকবির এ কথা ইসলামের। ইসলামের নবী মুহাম্মাদ (সা.) আর্তমানবতার সেবায় অনন্য উদাহরণ স্থাপন করে গেছেন। তিনি ছিলেন মানুষের কল্যাণ ও হিতকামনায় নিবেদিতপ্রাণ। মানুষের দুঃখ, দুর্দশা, ব্যথা-বেদনা ও পীড়ন-দহনে তিনি যেমন ব্যথিত হতেন তেমনি তা লাঘবের জন্য গ্রহণ করতেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। একজন নগণ্য মানুষও যেকোনো সমস্যায় পড়ে তার কাছে এলে তিনি তাকে কোনো দিন নিরাশ করেননি। নিজে না খেয়ে অন্যকে খাওয়ানো, নিজে না পরে অন্যকে পরানো, নিজের আরাম-আয়েশ তুচ্ছ করে অন্যের অবস্থা পাল্টে দেয়ার অসংখ্য উদাহরণ তিনি রেখে গেছেন। তাঁর ঘোরতর শত্রুকেও তিনি মানবিক দিক থেকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখেননি। যারা তাদের সব শক্তি প্রয়োগ করে ইসলাম ও মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার যাবতীয় কৌশল অবলম্বন করেছে তাদেরকেও রাসূল (সা.) সহযোগিতা করেছেন। তাদের খোঁজ-খবর নিয়েছেন। যে বুড়ি প্রতিদিন নবীজীর চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখত সে বুড়ির হঠাৎ অনুপস্থিতি নবীজিকে বিস্মিত করল। তিনি ছুটে চললেন বুড়ির বাড়িতে। গিয়ে দেখলেন বুড়ি অসুস্থ। তিনি লেগে গেলেন বুড়ির শুশ্রুষায়। তাকে সুস্থ করে তুললেন। আবার যে বুড়ি মুহাম্মদ নামক ‘জুজুর ভয়ে’ মদিনা ছেড়ে পালাতে লাগল সে বুড়ির গাঁট্টি বহন করেছেন স্বয়ং নবী করীম (সা.)।
আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসা ইসলামের দাবি, মানবিক মূল্যবোধের পরিচায়ক। পীড়িত ও দুর্দশাগ্রস্ত কোনো লোকের দুঃখ মোচন করে দিলে আল্লাহ তাআলা অত্যন্ত আনন্দবোধ করেন। পক্ষান্তরে কারো ওপর অর্পিত দায়িত্ব এড়িয়ে গেলে এবং আশেপাশের অসহায় ও পীড়িতদের প্রতি সহানুভূতির দৃষ্টি না দিলে এর জবাবদিহিতা করতে হবে। রাসূল (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ তাআলা বনি আদমকে ডেকে বলবেন, ‘হে আদম সন্তান! আমি পীড়িত হয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমার সেবা করোনি। আমি তোমার কাছে খাদ্য চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে খাদ্য দাওনি। আমি তোমার কাছে পানি চেয়েছিলাম, কিন্তু তাও তুমি দাওনি।’ তখন অপরাধী বান্দা বলবে, ‘হে প্রভু! কিভাবে আমি তোমরা সেবা করব? কিভাবে আমি তোমাকে খাদ্য আর পানি দেব? তুমিই তো সমস্ত জগতের প্রতিপালক।’ তখন আল্লাহ বলবেন, ‘আমার অমুক বান্দা পীড়িত ছিল, তুমি তার সেবা করনি। আমার অমুক বান্দা তোমার নিকট খাদ্য চেয়েছিল, কিন্তু তাকে খাদ্য দাওনি। আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানি চেয়েছিল, কিন্তু তুমি তাকে পানি দাওনি। যদি তুমি তাদের সেবা করতে, খাদ্য আর পানি দিয়ে সাহায্য করতে, তাহলে স্বয়ং আমাকে সাহায্য করা আর দান করা হয়ে যেতো।’
মানবজীবনের সার্থকতা কিসে!
Tags