মিডিয়াযুদ্ধের সেকাল-একাল ও ইসলামের আদর্শ

Media_zahirbabor1আজকের বিশ্বে ‘মিডিয়াযুদ্ধ’ নামে যে কথাটি ব্যাপক প্রচলিত এটা কোনো নতুন যুদ্ধ নয়। এর সঙ্গে মানবসভ্যতার পরিচয় অনেক পুরনো। সমকালীন প্রচারমাধ্যমের দ্বারা প্রতিটি যুগই এ যুদ্ধের কীর্তিতে ভরপুর। গোত্রীয় যুগে এ যুদ্ধ শে’র-কবিতা আবৃত্তি, অলঙ্কার ও ভাষাশৈলীর জোরে চলত। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা থাকত শা’য়ের বা কবিদের। প্রত্যেক গোত্র নিজেদের শান-শওকত, শৌর্য-বীর্য প্রকাশের জন্য কবিদের সহায়তা যোগাত। বরং অধিকাংশ গোত্র কবিদের জীবন-জীবিকার যাবতীয় দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করত। যাতে তারা স্বাবলম্বী হতে পারে, অন্যের ওপর ভরসা করতে না হয় সে ব্যবস্থা করত। প্রশংসা-নিন্দা, উৎসাহ-কুৎসা আরবের সাহিত্যের বিশেষ উপাদান ছিল, যাকে প্রাচীন যুগের মিডিয়াযুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মনে করা হতো।

মিডিয়াযুদ্ধ বলা হয় ওইসব মাধ্যমের দ্বারস্থ হওয়াকে যার সাহায্যে নিজেদের মত ও দর্শন অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়া যায়। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রচারমাধ্যমের গুরুত্বকে কখনো অবহেলা করেননি, বরং মিডিয়াযুদ্ধের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে সে যুগের প্রচলিত প্রচার মাধ্যমকে সময় ও সুযোগ মতো পূর্ণাঙ্গরূপে ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ইসলামপূর্ব যুগে কাবার দেয়ালকে সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করা হতো। সুরা কাউসার অবতীর্ণ হওয়ার পর সাহাবায়ে কেরাম নবী করিম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে চ্যালেঞ্জে অবতীর্ণ হওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। দরবারে নবওয়াত থেকে অনুমতি প্রাপ্তির পর ভাষাশৈলী ও অলঙ্কারের সর্বোচ্চ মানে উন্নীত মহাগ্রন্থ আল কুরআনের সবচেয়ে ছোট সেই সুরাটি অন্যান্য কবিতার পাশে খানায়ে কাবার দেয়ালে লিখে রাখলেন। ফল এই হলো যে, তৎকালীন সেরা কবিরা নিজ হাতে তাদের কবিতা মুছে ফেলে লিখে দিলেন ‘মা হাযা কাওলুল বাশার’Ñএটা নয় কোনো মানুষের কালাম।’ এটা আরবের বিখ্যাত কবিদের পক্ষ থেকে নিজেদের পরাজয়ের প্রথম ঘোষণা। এর দ্বারা কুরআনে কারিমের সত্যতার বড় স্বীকৃতি যেমন আদায় হয়েছিল তেমনি এটা ছিল মিডিয়াযুদ্ধে ইসলামের প্রথম বিজয়।

মদিনা মোনাওয়ারায় অনেকবার এমন হয়েছে যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববীর মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবা দিচ্ছেন। কেউ এসে সংবাদ দিল কাফেরেরা কুৎসামূলক অমুক কথা বলেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন মিম্বর থেকে নিচে নেমে এসে ‘রাসুলের কবি’ খ্যাত হযরত হাস্সান বিন সাবেত রা.কে মিম্বরে আসার নির্দেশ দিতেন এবং বলতেন, ‘হে হাস্সান! আল্লাহর রাসুলের পক্ষ থেকে জবাব দাও। আল্লাহ রুহুল কুদস (জিবরাইল) দ্বারা তোমাকে সাহায্য করবেন।’ নির্দেশ পালনার্থে হযরত হাস্সান বিন সাবেত রা. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপস্থিতিতে মিম্বরে আসতেন এবং নিজের ইলহামি কাসিদার সাহায্যে কাফের-মুশরিক ও ইসলামের শত্রুদের এমন দাঁতভাঙা জবাব দিতেন যে, কয়েক পুরুষ পর্যন্ত তারা একথা ভুলতে পারত না।

একবার আরবের এক গোত্র নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কাব্য ও বক্তৃতায় মোকাবেলার চ্যালেঞ্জ করে বসল। রাসুলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। তিনি ‘রাসুলের কবি’ খ্যাত হযরত হাস্সান বিন সাবেত রা. এবং ‘খতিবে রাসুল’ খ্যাত সাম্মাস বিন কায়েস রা.কে মোকাবিলার জন্য নির্বাচন করলেন। দু’জনই কবিতা আবৃত্তি ও বাকশৈলীর মনোরম প্রদর্শনী করলেন। মুসলমান কবি ও বক্তার শ্রেষ্ঠত্ব সবাই স্বীকার করে নিল। ওই গোত্র তাদের কৃত ওয়াদা মোতাবেক ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিল।

উমরাতুল কাযার সময় যখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহরামের হালতে তাঁর প্রতি প্রাণ উৎসর্গকারী সাহাবায়ে কেরামকে সঙ্গে নিয়ে মক্কা মুকাররমায় প্রবেশ করছিলেন তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগে আগে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা বীরত্বের সঙ্গে কিছু কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন। ওই পংক্তিগুলোতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদব ও সম্মানের প্রসঙ্গ যেমন ছিল তেমনি কাফেরদের প্রতি মৃদু-কঠোর ধমকিও ছিল। ওমর রা. তাঁকে বারণ করার চেষ্টা করলেন। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হে ওমর! তাঁকে কবিতা আবৃত্তি করতে দাও। এটা ওই লোকদের ওপর তীর ছুঁড়ে মারার চেয়েও বেশি কার্যকরী।’ দুশমনের নাকের ডগায় পৌঁছে তাদেরকে ভীত-সন্ত্রন্ত করে তোলার এর চেয়ে সুন্দর পদ্ধতি আর কী হতে পারে! কেননা হুদাইবিয়ার চুক্তিপত্রে ‘অস্ত্র প্রদর্শনীর’ ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল কিন্তু ‘কবিতা আবৃত্তির’ ওপর কোনো বাধা ছিল না। সেই সুবর্ণ সুযোগই নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাজে লাগিয়েছিলেন।

প্রচারণার প্রচলিত ও সহজলভ্য পদ্ধতি ব্যবহারের পাশাপাশি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘ইহুদী প্রচার মাধ্যম’ এর প্রতিরোধের প্রতিও বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। ইসমা নামে বদচরিত্রের এক ইহুদি নারী ছিল। সে কবিতা লিখত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি কটূক্তি এবং মুসলমানদের মনে কষ্ট দেয়াই ছিল তার কবিতার মূল উপজীব্য। এক অন্ধ সাহাবী তার জীবনলীলা সাঙ্গ করে দেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এ সংবাদ পৌঁছার পর উৎসাহসূচক মন্তব্য করলেনÑ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সাহায্যকারীর জিয়ারত করতে চান তারা যেন উমায়ের বিন আদিকে দেখে নেন।’

কাব ইবনে আশরাফ ইহুদি প্রোপাগান্ডার এক শক্তিশালী বাহন ছিলেন। তার যেমন অঢেল সম্পদ ছিল তেমনি তিনি ছিলেন একজন কবি। নারীদের অবাধ স্বাধীনতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তাকে গণ্য করা হয়। কবিতায় মুসলিম নারীদের নাম ধরে ধরে কুৎসা রটাতেন। রেসালতের প্রতি কটূক্তিকারীদের আশ্রয়স্থল ও সাহায্যকারী ছিল। বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তা দান এবং মক্কার কাফেরদেরকে সংঘবদ্ধ করার জন্য মক্কা মুকাররমা চষে বেড়াতেন। কাফেরদের সমাবেশে আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রতি কটূক্তি করে কবিতা পাঠ করে শুনাতেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে হযরত মুহাম্মদ ইবনে সালামা রা. ওই অভিশপ্তকে খতম করেন এবং চিরদিনের জন্য তার মুখ বন্ধ করে দেন।

Media_zahirbabor2ইহুদি আবু রাফে ‘কুফুরি সাংবাদিকতার’ (এটাকে যদি সাংবাদিকতা হয়) সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সহায়তাকারী ছিল। ইসলামের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডায় পানির মতো পয়সা ব্যয় করতো। কবিদের সেবায় দিরহাম-দিনারের থলি পৌঁছে দিত। কবিরা যেন জীবন-জীবিকার দিক থেকে সম্পূর্ণ দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে মিডিয়াযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারে এর সব ব্যবস্থা সে করে দিত। দীনী জযবায় উজ্জীবিত কয়েকজন নও মুসলিম তাকেও তার চিরস্থায়ী ঠিকানা জাহান্নামে পাঠিয়ে দেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এ সংবাদ পেলেন অত্যন্ত আনন্দ প্রকাশ করলেন এবং ওই ভয়াবহ শত্রুকে যারা জাহান্নামে পাঠিয়েছেন তাদের কামিয়াবির জন্য দুআ করেছেন।
সিরাতে নববীর কিতাবসমূহে উল্লিখিত ঘটনাবলী আমাদের পথপ্রদর্শনের সহায়ক হিসেবে আজও অক্ষত আছে। এসব ঘটনার কারণ ও হেকমত বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। কিন্তু আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে একথা বলতে পারি, ওই যুগে প্রচলিত মিডিয়াকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের উপকার ও ফায়দার জন্য পূর্ণাঙ্গরূপে ব্যবহার করেছেন। আর ইহুদি মিডিয়াধারীদের কুকর্মের ওপর এমন চপেটাঘাত করেছেন যা নির্লজ্জ, অশ্লীল ও কুচক্রীদের জবানকে অন্তত মদিনার শাসনামলে চিরদিনের জন্য নিশ্চুপ করে দিয়েছিল।

আধুনিক প্রযুক্তি যখন থেকে প্রচার মাধ্যমে উৎকর্ষ সাধন করে এবং বক্তৃতা ও কবিতা আবৃত্তির পাশাপাশি সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশনের ভূমিকা যুক্ত হয়Ñতখন থেকে মিডিয়ায় এক বিপ্লব সংঘটিত হয়ে যায়। ঘরের কোণে পর্যন্ত দুশমনদের থাবা বিস্তার লাভ করে। এতে মহিলা ও শিশুদের মানসিকতা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়। মিডিয়ায় ইসলাম ও মুসলমানদের দুশমনদের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম হয়। বর্তমানে পুরো মিডিয়া জগৎটা পশ্চিমা পদলেহী এবং ইহুদি-খ্রিস্টানদের এজেন্টে ছেয়ে গেছে। নগ্নতা ও অশ্লীীলতাকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। মানবিক মূল্যবোধের ধারণাটাই তারা পাল্টে দিয়েছে। মিথ্যাকে সত্য এবং বাতিলকে হক বানিয়ে পেশ করা হচ্ছে। অবস্থা এই দাঁড়িয়েছে যে, ‘গাধার নাম জ্বিন রেখেছে, জ্বিনের নাম গাধা; তোমার কারিশমা করতে পারে তাই চাইবে তুমি যা।’ মিডিয়ায় এখন ইসলাম ও মানবিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে একতরফা যুদ্ধ চলছে। সাংস্কৃতিক দুর্বৃত্তরা ভদ্রতা ও মানবিকতার চেহারা ঢেকে অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতার প্রবাহে ভেসে যাচ্ছে। মানবতাবিধ্বংসী কালচারে আজ ছেয়ে যাচ্ছে চারদিক।

অন্যদিকে ‘ধর্মীয় সাংবাদিকতা’ মাদরাসার মুখপত্র এবং মাসিক দীনী সাময়িকী পর্যন্ত এখনো সীমাবদ্ধ। রেডিও এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে ইতিবাচকভাবে ইসলামের আওয়াজ প্রচারের জন্য নেই কোনো প্রতিনিধিত। কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের বিশাল জগতও ইসলামপন্থীদের থেকে ফাঁকা পড়ে আছে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা লুটছে ইহুদি-খ্রিস্টান এবং ইসলামী সমাজে নিয়োজিত তাদের এজেন্টরা। এর বিপরীতে ওলামায়ে কেরামের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই বললেও অত্যুক্তি হবে না। ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য কিছু করার মানসিকতা যারা পোষণ করেন তাদেরকে এ ক্ষেত্রটি সম্পর্কে আরো বেশি করে মনোযোগী হতে হবে।

[উর্দু মাসিক আল বাইয়্যেনাত থেকে অনুবাদ। মূল লেখক মুফতী আতিকুর রহমান কাসেমী]

Related posts

*

*

Top