মুসলিম উম্মাহর প্রধান সংকট

Zahirbabor.com 2মুসলিম জাতির অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো পারস্পরিক ঐক্য ও বিভক্তি। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘এক মুসলমান অন্য মুসলমানের জন্য দেয়ালসদৃশ। এর একটি অংশ আঘাতপ্রাপ্ত হলে এর প্রভাবে সারা শরীর ব্যথিত ও আঘাতপ্রাপ্ত হয়।’ অদৃশ্য এই শক্তিই মুসলমানদের অবিস্মরণীয় বিজয়ের গোপন রহস্য। সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ূবী রহ. বায়তুল মুকাদ্দাস পুনরুদ্ধারের জন্য ওই সময় চূড়ান্ত বিজয়ের প্রস্তুতি নেন, যখন মুসলমানদের পারস্পরিক বন্ধন সুদৃঢ় হয় এবং সিরিয়ার নেতৃস্থানীয়রা একই প্লাটফর্মে জড়ো হন। ইতিহাসের ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলে একথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, যতক্ষণ মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির সুদৃঢ় বন্ধন, পারস্পরিক সহযোগিতাবোধ এবং মতবিরোধ ও ভেদাভেদ থেকে নিষ্কৃতি পায়নি ততক্ষণ তারা কোনো একটি যুদ্ধেও জয়লাভ করতে পারেনি। মুসলমানরা যখন প্রত্যেকেই নিজস্ব মত-পথ ও চিন্তাধারায় খেয়ালি বিচরণ করে; নিজেদের মধ্যে সৃষ্ট মতপার্থক্য শত্রুতার রূপ নেয়; তখন সফলতার আর কোনো প্রচেষ্টাই কাজে আসে না। তখন সবক্ষেত্রে মুসলমানদের হতে হয় অপদস্থ। পরাজয়ের গ্লানি ছাড়া তাদের ভাগ্যে আর কিছুই তখন জুটে না।

বর্তমানে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে অনৈক্য ও অসংহতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। দুনিয়াতে আজ মুসলামানদের রয়েছে বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠী। পৃথিবীর এক চতুর্থাংশ তাদের। তবুও দুনিয়ার অন্যান্য শক্তির কাছে তারা আজ নত। মুসলমানরা আজ লাঞ্ছিত ও নিষ্পেষিত হচ্ছে দেশে দেশে। তাদের দেখে বিদ্রুপের হাসি হাসছে বাতিল শক্তি। কিন্তু মুসলমানদের এই অবস্থা হলো কেন? এর একমাত্র কারণ মুসলিম উম্মাহর ভেতরে ঢুকে গেছে অনৈক্যের বীজ। মুসলিম বিশ্ব আজ শতধা বিভক্ত। তাদের খণ্ড খণ্ড শক্তি নির্জীব হয়ে আছে। প্রত্যেকে তাদের নিজস্ব মতের পূজায় লিপ্ত। নিজের দল বা নেতার কথাই তিল-তাবিজ; অন্যের কোনো গুরুত্ব নেই। উম্মতের এই অনৈক্য ও অসংহতি সৃষ্টি করছে মারাত্মক বিষক্রিয়ার। ফলে তারা কাটাচ্ছে মুমূর্ষু অবস্থা ।

কর্মপরিকল্পনা ও কার্যপ্রণালীর আছে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি। পরিবেশ পারিপার্শি¦কতাও সর্বত্র এক নয়। তাছাড়া ইসলামী কার্যসম্পাদনকারীদের মত ও চিন্তার ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকাও স্বাভাবিক। সে হিসেবে কৌশলগত ও চিন্তাগত আংশিক মতবিরোধ তেমন দোষের কিছু নয়। কিন্তু এই মতপার্থক্য যখন ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব, দলীয় বিবেদ ও শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ের রূপ নেয়, তখন তা জন্ম দেয় ভয়াবহ পরিস্থিতির। গঠনমূলক কাজের পরিবর্তে চর্চা হয় বিনষ্টের। ইসলামী ভাবধারার আবরণে চরিতার্থ হয় ব্যক্তিস্বার্থ। তাই সব সফলতা পর্যবসিত হয় ব্যর্থতায়। অবশেষে আত্মঘাতী এই কর্মকা- ইসলামের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। গণ্য হয় ইসলাম নিশ্চি‎হ্নেরকারণ হিসেবে। ইসলামী সমাজ যখন বিভক্ত হয় দলে-উপদলে; প্রত্যেকে বিভোর হয় অনিষ্টের চিন্তায়; তখন উম্মাতের অস্তিত্ব আর টিকিযে রাখা যায় না। নিজেরাই কারণ হয় নিজেদের পতনের।

Zahirbabor.com 1কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এই ধ্বংসাত্মক কাজকে অনেকেই সামাজিক সংশোধন ও ইসলামী বিপ্লবের কাজ হিসেবে মনে করে। অথচ এটি মারাত্মক একটি ভুল। পারস্পরিক অনৈক্য ও সংঘাত কোনোদিনও ইসলামী সমাজ বিপ্ল¬বের জন্য সহায়ক হতে পারে না। বর্তমান মুসলমানদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক সত্য হচ্ছে তারা আজ বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত। গঠনমূলক কাজের পরিবর্তে ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত। গড়ার চেয়ে ভাঙার ক্ষেত্রে বেশি উদ্যোগী। মুসলিম দেশের শাসক কিংবা ইসলামী দলের পরিচালক; প্রত্যেকেই আত্মপূজারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ। প্রত্যেকে ছুটছে নিজেদের দুষ্টু প্রবৃত্তির পেছনে। ‘আমার মত ও চিন্তাই বিশুদ্ধ; এটিই একমাত্র পথ ও পদ্ধতি’ এই আত্ম-তুষ্টিতে ভুগছে সবাই।’ অন্যদের গুরুত্ব দিতে রাজি নয় কেউই। মুসলমানদের মধ্যে আজ পারস্পরিক শ্রদ্ধা, পরমতসহিঞ্চুতা, সহমর্মিতা ও সহযোগিতাবোধ নেই বললেই চলে।

আকিদাগত, চিন্তাগত, রাজনৈতিক, সামাজিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের পথনির্দেশকরা ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে। পরস্পরে কাঁদা ছোড়াছুড়ি করছে; লেগে আছে একে-অন্যের পেছনে। মন্তব্য করছে ঢালাওভাবে। প্রকৃত অবস্থা জানার আগেই গোমরাহ, ভ-, দালাল হিসেবে আখ্যায়িত করছে পরস্পরকে। এদের মধ্যে কেউ নবীপ্রেমিক (!) হয়ে বিরোধীদের রাসূল সা. এর সঙ্গে বেয়াদবির অপবাদ দিচ্ছে। কেউ নিজেদেরকে হাদিসের প্রকৃত আমলকারী মনে করে ইমামের অনুসরণকারীদের গোমরাহ ও কুফর-শিরকের পর্যায়ে ফেলে দিচ্ছে। আবার কেউ ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বে, দলীয় মোহে অন্যের বিরুদ্ধে অনবরত কুৎসা রটাচ্ছে। এভাবে তাদের পরস্পরে সৃষ্টি হচ্ছে বৈরি সম্পর্ক। বাড়ছে হিংসা, বিদ্বেষ ও শত্রুতা। দূর হচ্ছে তাকওয়া, ইখলাস ও দীনের প্রকৃত চেতনা। ইসলামের বৃহৎ স্বার্থে আল্লাহ এবং রাসূলের সা. নামের ওপর একত্রে বসতে তারা সম্মত নয়। মুসলমানদের পরস্পরে বিভক্তির মহড়া চলছে এভাবেই।

আজকের মুলমানরা তদের সমস্যা নিরূপণে যেমন ব্যর্থ, তেমনি উত্তরণ ভাবনায় শত বিচ্ছিন্ন। একক চিন্তাধারার কোনো অস্তিত্ব নেই। তাদের অনৈক্য ও সংঘাত আরো বিরূপ আকার ধারণ করে যখন তা অনৈসলামিক দেশে হয়। ইসলামী ব্যক্তিত্বদের এই আচরণ দেখে অমুসলিমদের মনে ইসলাম সম্পর্কে ধারণা জন্মে, ইসলাম তাহলে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, সংঘাত, বিবেদ ও বিদ্বেষমূলক ধর্ম। ঐক্য, সংহতি ও সহাবস্থান ইসলামে নেই। কেননা তারা দেখে যে, চিন্তা ও ইজতেহাদগত বিষয়েও মুসলমানদের বিভিন্ন দল-উপদল পরস্পরের বিরুদ্ধে শত্রু ভাবাপন্ন। সামান্য বিষয়ের জের ধরে পরস্পরেকে ইসলামের গণ্ডিথেকে বের করে দিচ্ছে। যাচাই-বাছাই ছাড়াই ফতোয়া ছুড়ে মারছে। ঘরোয়া বিষয় ফলাও করে প্রকাশ করছে। তখন স্বভাবতই ইসলামের প্রতি অমুসলিমদের খারাপ ধারণা জন্মাবে।

অত্যন্ত আফসোস ও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, আমরা ভাঙা ও নষ্টের দিকে এগুচ্ছি; অথচ স্থাপন ও গড়ার অলীক স্বপ্ন দেখছি। যখন শত্রুরা সবাই ঐক্যবদ্ধ; চলছে ইসলাম নির্মূলের সম্মিলিত প্রয়াস; বাতিলচক্র নিজেদের লক্ষ্য অর্জনে এগুচ্ছে দৃঢ়গতিতে। তখন মুসলমানরা আত্মকলহে লিপ্ত। হালকা এবং সাধারণ জিনিসকে কেন্দ্র করে চলছে অঘোষিত লড়াই। আত্ম-প্রতিষ্ঠার জন্য সবাই মরিয়া। শুধু মুসলিম ব্যক্তিত্বদের মাঝেই নয়; মুসলিম রাষ্ট্রসমূহেও চলছে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের খেলা। খুব বড় বিষয় নিয়ে নয়; মামুলি বিষয় নিয়ে। এগুলো সমাধানের জন্য তেমন কোনো উদ্যোগেরও প্রয়োজন হয় না। আলোচনা-পর্যালোচনা দ্বারাই সম্ভব।

মুসলমান পরস্পরে ভাই ভাই। সে হিসেবে পারস্পরিক সম্পর্ক হওয়া উচিত ভ্রাতৃত্বের, সম্প্রীতি ও মাধুর্যের। প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নয়। কে কাজ করলেন এর চেয়ে দেখা উচিত কী কাজ করেছেন। ভালো কাজ হলে তার স্বীকৃতি দেয়া, ব্যক্তি যে কেউই হোক। ইসলাম ও গঠনমূলক সামাজিক কাজের প্রতি সর্বাত্মক সহযোগিতা জরুরি। কিন্তু যখন কাজের চেয়ে কর্তা বেশি গুরুত্ব পায়; প্রত্যেক কাজকে নিজের অবদান মনে করা হয় এবং খ্যাতির আশা থাকে, তখনই ঘটে বিপত্তি।

বর্তমানে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের অভ্যাস হলো, তারা শুধু অন্যের দোষ-ত্রুটিই দেখে। অন্যের ভুলগুলো প্রকাশ করেই শান্তি পায়। নিজের ভুল কিছুই ধরা পড়ে না তাদের রঙিন চশমায়। নিজের মধ্যে হাজার দোষ থাকার পরও অন্যের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে মজা পায়। নিজেরটি একমাত্র কাজ; অপরেরটি কিছুই না; এই ধারণা পোষণ করেন তারা। তাদের ভাব দেখে মনে হবে ইসলামের রক্ষক একমাত্র তারাই। তাদের অস্তিত্ব ও পতনের মধ্যে ইসলামের উত্থান-পতন যেন নিহিত!

বর্তমানে আমাদের মধ্যে ইসলামের আদর্শ তেমন নেই। আমাদের কাজগুলোও পূর্ণ সুন্নাত ও ইসলাম অনুযায়ী হচ্ছে না। তবুও মিথ্যা অভিনয় করার কী দরকার আছে? ইসলামের কৃত্রিম কাণ্ডরী হয়ে ইসলামী ঐতিহ্যকে বদনাম করার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ আমাদের উদ্দেশ্য কখনো খ্যাতি ও নেতৃত্ব, কখনো নিজের দল ও মতের শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য, আবার কখনো নিজের জ্ঞান বা বুদ্ধির বিকাশ। অথচ আমরা নিজেদের ভাবছি পূঁত-পবিত্র! আর অন্যদেরকে মনে করছি ভ্রষ্ট ও বিপথগামী! এটি সরাসরি ইসলামের সঙ্গে প্রতারণা। নিছক ব্যক্তিস্বার্থে ইসলামের অপব্যবহার।

রাসুল সা. গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, ‘মুসলমান তার ভাইয়ের সম্মান করবে। প্রত্যেকের প্রাপ্য অধিকার আদায় করবে। পরস্পরে হিতকামী হবে। সাহায্য-সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবে। হিংসা-বিদ্বেষ, সংকীর্ণ মানসিকতা রাখবে না।’ আল্লাহ তায়ালাও নির্দেশ করেছেন মুসলমানদের সঙ্গে সদাচরণ করতে। এমনকি অমুসলিমদের সঙ্গেও ভালো ব্যবহার করতে বলেছেন। আল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা পবিত্র মসজিদ থেকে তোমাদের বাধা দিয়েছিল সেই সম্প্রদায়ের শত্রুতা যেন তোমাদেরকে সীমালঙ্ঘনে প্ররোচিত না করে। সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।’ এই আসমানি বার্তা প্রমাণ করে ইসলাম একটি উদার, সহনশীল ও সার্বজনীন সম্প্রীতির ধর্ম। বিবেদ ও সংঘাতের এখানে কোনো স্থান নেই।

পরিস্থিতির ভয়াবহতা এই মুহূর্তে মুসলমানদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসনের তাগিদ দিচ্ছে। আর এর জন্য প্রয়োজন সবার আন্তরিকতা। এই প্রবণতা দূর করতে হলে ব্যক্তিস্বার্থ থেকে ইসলামের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। অপরের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে মন্তব্য করা চলবে না। নিজে গঠনমূলক কাজ করবে। অন্যের বিচ্যুতির পেছনে লেগে অহেতুক সময় নষ্ট না করবে না। যেসব জিনিস বিবেদ বা সংঘাত সৃষ্টি করতে পারে তা থেকে দূরত্ব বজায় রাখবে। সব সময় সহযোগিতামূলক মনোভাব পোষণ করবে। কেননা ‘আল্লাহ ওই পর্যন্ত বান্দাকে সাহায্য করেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইকে সাহায্য করে।’

Related posts

*

*

Top