যে কথা বলতে হবে মিম্বর থেকে

Mimber 3 (2)ইসলামে ইবাদতের কেন্দ্রবিন্দু মসজিদ। প্রধানত মসজিদকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে একটি ইসলামী আবহ ও সমাজকাঠামো। মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে মসজিদের সম্পর্ক ওৎপ্রোত। অন্যান্য ধর্মের উপাসনালয়ের মতো মসজিদ শুধু মুসলমানদের ইবাদতখানাই নয় বরং এর সঙ্গে জড়িত আছে মুসলমানদের ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক জীবনের অধ্যায়সমূহ। একে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে মুসলমানদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও ধর্মীয় পরিবেশ। ইসলামের শুভসূচনা মূলত মসজিদকে কেন্দ্র করেই হয়েছিল। মক্কায় অবস্থানকালীন প্রকাশ্য ও স্বাধীনভাবে কোনো কার্যক্রম চালানোর সুযোগ না থাকলেও গোপনে গোপনে বায়তুল্লাহর মসজিদকে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হয় ইসলামের কার্যক্রম। মদিনায় হিজরত করার পর মসজিদে নববী হয়ে ওঠে মুসলমানদের মূল কেন্দ্রবিন্দু। যাবতীয় কর্মপন্থা নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন হয় এখান থেকেই। রাসূল (সা.) অনন্য ত্যাগের মাধ্যমে যখন মদিনাতে একটি কল্যাণরাষ্ট্র গড়ে তুললেন তখন এর পরিচালনার জন্য আলাদাভাবে কোনো সচিবালয় কিংবা সংসদ গড়ে উঠেনি। মসজিদে নববীই ছিল সবকিছুর প্রাণ। খেজুর পাতার চাউনিতে বসেই ১২ লাখ বর্গমাইলের বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করেছেন রাসূলুল্লাহ (সা.)। দিকে দিকে ইসলামের বিজয় মশালের শুভযাত্রা শুরু হয় এই মসজিদ থেকেই।

খোলাফায়ে রাশেদার যুগেও মসজিদই ছিল প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। পরবর্তী ইসলামী খেলাফতের যুগ চলাকালীন শাসনকার্যের জন্য আলাদা স্থান নির্বাচন করা হয়ে গেলেও মসজিদের ভূমিকা অনেকাংশে ছিল অক্ষুণ্ন। কিন্তু ইসলামী খেলাফত ব্যবস্থা বিলুপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মসজিদ নিছক ইবাদতখানা হিসেবেই গণ্য হতে থাকে। মসজিদের ভূমিকাও অন্যান্য ধর্মের উপাসনালয়ের মতো হয়ে যায়। মুসলমানদের সামগ্রিক জীবনপদ্ধতিতে মসজিদের যে বিশেষ ভূমিকা হতে পারে সে কথা অনেকেরই অজানা। মসজিদ বলতেই মনে হয় এখানে শুধু নামাজ হবে আর ফজিলতসংক্রান্ত কিছু ওয়াজ-নসিহত হবে। বিশেষ করে মসজিদের প্রধান ব্যক্তি মুসলমানদের ধর্মীয় নেতা ইমামরাও নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। বেতনধারী কর্মচারী হিসেবে শুধু কর্তব্যের দায়ে ফজিলতসংক্রান্ত কিছু ওয়াজ-নসিহত এবং ফরজ নামাজ পড়ানোকেই নিজেদের প্রধান দায়িত্ব মনে করতে থাকে। ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করা কিংবা আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রতি নজর রাখার পরিবর্তে বর্তমানে তাদের অনেকের লক্ষ্য হচ্ছে কিভাবে মসজিদ কমিটিকে তুষ্ট করা যাবে। তারা যেন কোনোক্রমেই অসন্তুষ্ট না হয়ে যান। অনেক ক্ষেত্রে ইমামরা হীনম্মন্যতার কারণে সত্য কথা বলা কিংবা বাতিলের প্রতিবাদ করতেও কুণ্ঠিত হন।

মুসলিম জাতির অধঃপতন, সমাজের অবক্ষয় ও ব্যক্তিত্বের চরম অবনতির এই মুহূর্তে ইমামরা তাদের নিজেদেরকে কোনো দায়িত্ব পালনের উপযোগীই ভাবছেন কি-না তাতে সন্দেহ আছে। অথচ মুসলিম উম্মাহর এই ক্রান্তিলগ্নে ইমামরা রাখতে পারেন বিশেষ ভূমিকা। মসজিদের মিম্বর হতে পারে বিশেষ দিকদর্শক। কেননা বাংলাদেশের এমন কোনো গ্রাম বা শহর পাওয়া যাবে না যেখানে কোনো মসজিদ নেই। প্রতিটি মসজিদেই রয়েছে কমপক্ষে একজন করে ইমাম। ইসলামের প্রচার-প্রসার, সামাজিক গণসচেতনতা ও জাগরণ সৃষ্টিতে তারা রাখতে পারে গঠনমূলক ভূমিকা। অন্তত শুক্রবারে অধিকাংশ মুসলমান মসজিদে এসে হাজির হয়। ইমাম সাহেবও তাদেরকে উদ্দেশ্য করে কিছু কথা বলেন। এ কথাগুলোই যদি হয় গঠনমূলক ও পরিকল্পিত তবে তাতেই আদায় হবে বিশাল দায়িত্ব।

মসজিদের মিম্বর থেকে ইমামদের মাধ্যমে যে বিষয়গুলো উপস্থাপিত হতে পারে এর কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলো-
Mimber 1১. ইমাম সাহেব সাপ্তাহিক জুমাবারের খুতবাতে উপস্থিত শ্রোতা-মুসল্লি এবং তার আওতাধীন সমাজে মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় এবং সামাজিক সমস্যা কী তা চিহ্নিত করে এর সমাধানের জন্য সচেতনতা ও প্রেরণা যোগাতে পারেন। পাশাপাশি ইসলামের সোনালী যুগের ইতিহাস থেকে প্রাসঙ্গিক হৃদয়গলানো ঘটনাবলী উল্লেখপূর্বক শ্রোতা-মুসল্লির চিন্তাধারাকে শাণিত করার প্রয়াস চালাতে পারেন।

২. সমসাময়িক মুসলিম বিশ্বের সমস্যা ও এর থেকে উত্তরণের পন্থা নির্দেশ করতে পারেন। মুসলমানরা তাদের নিজেদের ঈমানী দায়িত্ব আঞ্জাম না দিলে তাদের পরিণতির কথা কুরআন-হাদীসের ভাষ্য উল্লেখপূর্বক তুলে ধরতে পারেন।

৩. সমাজে সংঘটিত সবধরনের অপকর্ম, অনৈতিক আচরণের বিরুদ্ধে মুসল্লিদেরকে সচেতন করে তুলতে পারেন। এর ভয়াবহ পরিণতির কথা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে পারেন।

৪. যুব সমাজের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি জাগ্রতকরণ এবং দেশ ও জাতির স্বার্থে অবদান রাখার জন্য তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন।

৫. সমাজে প্রচলিত ধর্মীয় গোঁড়ামী, কুসংস্কার, ধর্মের আবরণে ভণ্ডামী এবং সবধরনের শিরক-বিদআতের প্রতি সবাইকে সজাগ এবং প্রতিরোধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাতে পারেন।

৬. যেকোনো ধরনের অন্যায় ও অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হওয়া। কারো অসন্তুষ্ট হয়ে যাওয়ার তোয়াজ না করে সত্যের প্রতি লোকদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে প্রয়াস চালাতে পারেন।

৭. ছোট ছোট কোমলমতি শিশু-কিশোরদের মধ্যে দ্বীনি শিক্ষার পাশাপাশি সততা, আমানতদারি, পিতা-মাতার খেদমত, সমাজসেবা, মিল্লাতের উন্নতি প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষাদানের জন্য মসজিদভিত্তিক মক্তব গড়ে তুলতে পারেন।

৮. ইসলাম ও আধুনিকতার মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ সহাবস্থান তৈরি করে ইসলামের সার্বজনীনতা ও কালজয়ী আদর্শ প্রমাণ করতে পারেন। নবউদ্ভাবিত সমস্যাবলী সমাধানে জরুরি পরামর্শ পেশ করতে পারেন।

৯. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পরিবেশ সচেতনতা ও নৈতিক শিক্ষার প্রতি ব্যাপকভাবে গণজোয়ার সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করতে পারেন। প্রয়োজনে মুসল্লিদের সঙ্গে নিয়ে ইমাম সাহেবের নেতৃত্বে পরিবেশ সচেতনতা কমিটি গঠন করা যেতে পারে।

১০. ইমাম সাহেব শুধু বক্তব্য রেখে কিংবা পরামর্শ দিয়েই নিজেকে দায়মুক্ত করবেন না বরং তার প্রতিটি কথা ও পরামর্শ যেন কার্যকর হয় সে বিষয়ে নিজেকেই  উদ্যোগী হতে হবে।

Mimber 3 (1)মোটকথা, ইসলামী সমাজের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে হলে মসজিদকে সামাজিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু বানাতে হবে এবং মসজিদের ইমাম সাহেবকে যথাযোগ্য মর্যাদা ও ক্ষমতা দিতে হবে। আর এর জন্য ইমামদের প্রতি সাধারণ লোকদের ধারণা যেমন স্বচ্ছ হওয়া জরুরি তেমনি ইমাম সাহেবকেও এই মানসিকতা তৈরি করতে হবে যে, ইমামতি নিছক কোনো চাকরি নয়, বরং এটা একটি মহান দ্বীনি দায়িত্ব। তাই এ দায়িত্বের যা হক বা দাবি তা পালন করতেই হবে। ইমামদেরকে সে অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা সরকার ও সমাজের নেতৃস্থানীয়দের দায়িত্ব। প্রত্যেকে তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলেই সমাজ হবে সুখী ও সমৃদ্ধশালী। মসজিদ হবে সত্যিকার অর্থে ইসলামী সমাজের কেন্দ্রবিন্দু ।

Related posts

*

*

Top