জহির উদ্দিন বাবর
এক সময় ঢাকাকে বলা হতো মসজিদের শহর। তবে এখন শুধু মসজিদ নয়, মাদরাসার শহরও ঢাকা। রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যার চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে মাদরাসার সংখ্যাও। তবে সারাদেশে পরিচিত এবং প্রভাব আছে এমন মাদরাসার সংখ্যা হাতেগোনা। জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া হাতেগোনা সেই কয়েকটি মাদরাসার অন্যতম। বয়সের দিক বিবেচনা করলে রাহমানিয়ার চেয়ে প্রাচীন মাদরাসা ঢাকায় অনেক আছে। তবে সারাদেশে একবাক্যে সবাই চিনে এমন মাদরাসার তালিকায় শীর্ষে জামিয়া রাহমানিয়া। দেশের নানা প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা ছুটে আসে ঐতিহাসিক সাতমসজিদের আঙ্গিনার এই ইলমি বাগানে। হয়ত অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে রাজধানীতে আরও অনেক মাদরাসা আছে; কিন্তু রাহমানিয়া যেভাবে শিক্ষার্থীদের অদৃশ্যভাবে এর দিকে টেনে আনে সেই সম্মোহনী শক্তি বোধহয় খুব কম মাদরাসারই আছে।
জামিয়া রাহমানিয়া দেশে-বিদেশে বিপুল পরিচিতি পাওয়ার নানা কারণ আছে। তবে আমি মনে করি এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ.-এর নাম; আর এর উসিলাতেই মূলত রাহমানিয়া এতোটা মকবুল। দেশের নানা প্রান্তের শিক্ষার্থীরা ইলমের সন্ধানে রাহমানিয়ায় ছুটে আসছেন সেই শুরুলগ্ন থেকে। যখন জামিয়া রাহমানিয়া সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে আরও অনেক পিছিয়ে ছিল তখনও ঢাকার শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছে। মূলত শায়খুল হাদিস রহ.-এর মতো যুগশ্রেষ্ঠ একজন আলেমের পরশ পেতেই শিক্ষার্থীরা এভাবে ছুটে আসতেন। আজ শায়খুল হাদিস রহ. নেই, কিন্তু তাঁর রূহানি ছাপ এখনও জামিয়া রাহমানিয়ার প্রতিটি ধূলিকণায় অনুভূত হয়। এজন্যই আজও ইলমপিপাসুরা মৌমাছির মতো ভিড় করে জামিয়া রাহমানিয়ায়। শাওয়ালের শুরুতে রাহমানিয়ার আঙ্গিনায় গেলে সেটা টের পাওয়া যায়।
ছোটবেলায় মফস্বলের মাদরাসায় যখন পড়তাম তখন স্বপ্ন দেখতাম একদিন রাজধানীতে গিয়ে পড়ব। আর সেই ছোটবেলার স্বপ্নের প্রথম প্রতিষ্ঠান ছিল জামিয়া রাহমানিয়া। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যেদিন জামিয়া রাহমানিয়ার দাখেলা পেয়েছিলাম সে দিনের খুশির কথা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আমাদের সঙ্গে অনেকেই রাহমানিয়ায় ভর্তি হতে চেয়েও পারেনি; এজন্য সেদিন নিজেকে ধন্য মনে হয়েছিল। ‘রাহমানিয়ার ছাত্র ছিলাম’ এটা এখনও গর্বের সঙ্গে বলি। সত্যিই জামিয়া রাহমানিয়ার ইলমি বাগানে যে কয়দিন ছিলাম সেটা জীবনের একটি বড় অর্জন। আমরা সত্যিই সৌভাগ্যবান, যার সান্নিধ্যের প্রত্যাশায় জামিয়া রাহমানিয়ায় ছুটে আসা সেই শায়খুল হাদিস রহ. তখন অনেকটা সুস্থ-সবল। হাদিসের মসনদে তিনি তখনও পুরোপুরি সক্রিয়। তাঁর মতো যুগশ্রেষ্ঠ শায়খুল হাদিসের দরসে বসতে পারার চেয়ে জীবনের বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে!
জামিয়া রাহমানিয়া আর শায়খুল হাদিস রহ. অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মূলত শায়খুল হাদিস রহ.কে কেন্দ্র করেই এখানে ইলমপিপাসুদের জমায়েত। যারা শায়খুল হাদিসকে ভালোবাসেন; তাঁর চিন্তাচেতনার সঙ্গে যাদের মিল রয়েছে; শায়খুল হাদিসের মিশনকে যারা এগিয়ে নিতে চান তারাই মূলত রাহমানিয়ার সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত হয়েছেন। বর্ণাঢ্য জীবনে শায়খুল হাদিস রহ. যেমন সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলেন তেমনি তাঁর হাতেগড়া জামিয়া রাহমানিয়াও একটি মকবুল প্রতিষ্ঠান। শিক্ষা-দীক্ষা, আমল-আখলাক, মিশন-ভিশন এবং কর্মক্ষেত্রে সাফল্যের ছাপ রাখার ক্ষেত্রে জামিয়া রাহমানিয়া অতুলনীয়। দীনি অঙ্গনের প্রায় সব দিকেই রয়েছে রাহমানিয়ার সন্তানদের সাফল্যজনক ছোঁয়া। প্রতিটি সেক্টরে শীর্ষ ও নেতৃস্থানীয়দের একটি বড় অংশ জামিয়া রাহমানিয়া এবং শায়খুল হাদিস রহ.-এর রুহানি সন্তান।
যেকোনো প্রতিযোগিতা, যেকোনো নেতৃত্ব, যেকোনো খেদমতে বরাবরই জামিয়া রাহমানিয়ার সন্তানরা এগিয়ে। তাদের সাফল্যগাঁথা সবার জন্য ঈর্ষণীয়। যারা জামিয়া রাহমানিয়ার কিছুদিন হলেও পড়াশোনা করেছেন তারা গর্বের সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানের পরিচয় দেন। এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেখানকার শিক্ষার্থী হওয়াই গর্বের। এমন কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যেখানকার ছাত্র বললেই সাধারণত বোঝা যায় তিনি মেধাবী। জামিয়া রাহমানিয়াও এমনই একটি প্রতিষ্ঠান। এখানে দেশসেরা এবং বাছাই করা শিক্ষার্থীরাই পড়ে থাকেন। কারণ এখানে ভর্তি হতে হয় অনেক প্রতিযোগিতা করে। আসন সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষার্থী এখানে ভর্তির আবেদন করে। ঢাকার অনেক মাদরাসা যেখানে নানা সুযোগ-সুবিধা ও প্রণোদনা দিয়েও ছাত্র পায় না সেখানে জামিয়া রাহমানিয়া বাধ্য হয়েই অনেক শিক্ষার্থীকে প্রতি বছর ফেরত দিতে হয়। একটি প্রতিষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতা ও স্বীকৃতির ক্ষেত্রে এটি অনেক বড় বিষয়।
শায়খুল হাদিস রহ.-এর স্মৃতিধন্য জামিয়া রাহমানিয়া আরও কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে অনন্য হয়ে আছে। এর মধ্যে একটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রান্তিকতামুক্ত এবং ভারসাম্য বজায় রাখা। আজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যখন প্রান্তিকতার নানা ছড়াছড়ি দেখি তখন খুব গভীরভাবে লক্ষ্য করি, এখানে জামিয়া রাহমানিয়ায় পড়–য়া কেউ নেই। সাধারণত ফেসবুকীয় অহেতুক প্যাচাল বা খোঁচাখুঁচিতে এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জড়ায় না। এর কারণ হলো, জামিয়া রাহমানিয়া আমাদেরকে শিখিয়ে প্রান্তিকতা পরিহার করতে। ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ করতে। সব মত ও পথকে শ্রদ্ধা করতে। পায়ে পড়ে কারও সঙ্গে ঝগড়া না বাঁধাতে।
মূলত এটা শায়খুল হাদিস রহ.-এর শিক্ষা। বিশাল এই ব্যক্তিত্বের অগণিত ভক্তের পাশাপাশি সমালোচকের সংখ্যাও কম ছিল না। নানা কারণে একটি মহল সুযোগ পেলেই শায়খুল হাদিস রহ.কে বিতর্কিত করতে চাইত। কিন্তু আমরা শায়খকে কোনোদিন তাদের ব্যাপারে মুখ খুলতে দেখিনি। যারা একসময় তাঁকে হাফেজ্জি হুজুর রহ.-এর সঙ্গে ইরান সফরের কারণে শিয়া বলতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি তাদের সম্পর্কেও শায়খের মুখ থেকে কোনোদিন কোনো কটূক্তি বা অভিযোগ শুনিনি। বিশাল ব্যক্তিত্ব আর সারল্য দিয়ে তিনি আলেমসমাজকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা সবসময়ই করেছেন। কাউকে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী বা শত্রু ভাবেননি। তাঁর সেই গুণটি রূহানি সন্তানেরাও পেয়েছে।
জামিয়া রাহমানিয়া ইতোমধ্যে তিন দশকের বেশি সময় পার করে এসেছে। বর্ণাঢ্য এই সময়ের সব রূহানি সন্তানকে নিয়ে পুনর্মিলনীর আয়োজন হচ্ছে-এটা অবশ্যই খুশির বিষয়। তবে একটি কষ্টের জায়গাও আছে। যাঁর স্বপ্নে গড়া এই প্রতিষ্ঠান আমাদের রুহানি পিতা শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. আমাদের মাঝে নেই। তিনি সশরীরে থাকলে বর্ণাঢ্য এই আয়োজন আরও বর্ণাঢ্য হতো। কিন্তু আল্লাহর ফায়সালার ওপর কারও কোনো হাত নেই। মহান সেই দরবারে বিশেষ মোনাজাত, শায়খুল হাদিস রহ.-এর স্বপ্নের এই প্রতিষ্ঠানটি কবুল করে নিন। এর উসিলায় তাঁকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন। আমিন।