জহির উদ্দিন বাবর
ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী একটি সংগঠনের তৃতীয় সারির কথিত একজন নেতা। জি কে শামীম নামের ব্যক্তিটি নেতা কিংবা ব্যবসায়ী হিসেবে তেমন পরিচিত কেউ নন। সম্প্রতি তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন র্যাবের হাতে। এ সময় তার অফিসে নগদ পাওয়া গেছে প্রায় দুই কোটি টাকা। আর এফডিআর পাওয়া গেছে ১৬৫ কোটি টাকার। পরে অনুসন্ধানে জানা গেছে, তিনি সরকারি প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারি কাজ পেতে ঘুষই দিয়েছেন প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। সুতরাং তিনি অবৈধভাবে কত টাকা কামিয়েছেন সেটা সহজেই অনুমেয়। এই হলো একজন অখ্যাত নেতার অবৈধভাবে গড়ে তোলা সম্পদের চিত্র।
এই নেতা যাদের নাম ভাঙিয়ে চলতেন তাদেরও কেউ কেউ ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের অবৈধ সম্পদের চিত্র দেখলে চোখ কপালে ওঠার মতো অবস্থা। শত শত নয়, হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন একেকজন। এখন পর্যন্ত যারা ধরা পড়েছেন তারা প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির নেতা। মূল দলের তেমন কেউ এখনও ধরাই পড়েননি। রাঘব বোয়ালরা এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। তবে দুর্নীতির মাত্রাটি কতটা ভয়াবহ সেটা অনুমান করার জন্য এই কয়েকজনের উদাহরণই যথেষ্ট।
ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে সম্প্রতি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেন তাদের দমাতে। তখনই গোয়েন্দা প্রতিবেদন যায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে। সেই প্রতিবেদন দেখে প্রধানমন্ত্রীর চোখও কপালে উঠে যায়। কারণ তিনি নিজেও ধারণা করেননি দেশে এতো বড় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে এবং তার দলের লোকজন এর সঙ্গে জড়িত। অভিযানে নেমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও নতুন নতুন তথ্য পেতে থাকে। সবচেয়ে আলোচিত হয় অবৈধ জুয়ার আসর বা ক্যাসিনো। রাজধানী ঢাকায় অসংখ্য অভিজাত এই জুয়ার আসরের সন্ধান মিলে। ক্যাসিনো নিয়ে গণমাধ্যমে যেসব তথ্য আসে তা রীতিমত গা শিউরে ওঠার মতো। যতদূর জানা যায়, নেপাল থেকেই অভিজাত এই জুয়ার ব্যবসাটি ঢাকায় আসে। ঢাকায় যতগুলো ক্যাসিনো আছে সবগুলোর পরিচালনার পেছনে কোনো না কোনো নেপালি জড়িত। প্রতিটি ক্যাসিনো পরিচালনা করছেন ক্ষমতাসীন দলের কোনো প্রভাবশালী নেতা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই জুয়ার আসরের উৎপত্তি যে নেপালে সেখানে ক্যাসিনোর সংখ্যা মাত্র ১১টি। এর মধ্যে রাজধানী কাঠমান্ডুতে নয়টি আর রাজধানীর বাইরে দুটি। তাও সেগুলো নিজ দেশের নাগরিকদের জন্য নয়, বিদেশি পর্যটকদের জন্য। অথচ সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী ঢাকা শহরে প্রায় একশ ক্যাসিনো চলছে। আছে ঢাকার বাইরেও। এসব ক্যাসিনোতে প্রতিদিন সবমিলিয়ে প্রায় ১২০ কোটি টাকার লেনদেন হয়।
বাংলাদেশের আইনে কোনো ক্যাসিনো বৈধ নয়। প্রতিটি ক্যাসিনোই চলছে অবৈধভাবে। এজন্য তারা আশ্রয় নিয়েছে বিভিন্ন ক্লাবের। উপর দিয়ে বিভিন্ন খেলাধুলার ক্লাব, আর ভেতরে অবাধে চলছে ক্যাসিনো বা জুয়ার আসর। সেখানে শুধু জুয়াই নয়, নারীবাজিসহ সংঘটিত হয় আরও নানা অপকর্ম। সমাজের একটি শ্রেণি যারা ক্ষমতার নিয়ামকভোগী তারা জনসাধারণের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে সেখানে জুয়ার আসরে ঢালছে। এটা নতুন নয়, অনেক দিন ধরেই এই অপকর্ম চলছে, অথচ আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেখেও না দেখার ভান করে আসছে। খবরে প্রকাশ, এই ক্যাসিনো থেকে রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত ভাগ পেত। মতিঝিল থানার আশপাশে চারটি ক্যাসিনো ধরা পড়েছে, অথচ পুলিশ বলছে তারা নাকি এর খবর জানতই না! মূলত সরকারপ্রধান এ ব্যাপারে নির্দেশনা না দিলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কখনোই নিজ উদ্যোগে এসব নির্মূল করতে যেত না। কারণ তারাও এই অপকর্মের সহযোগী। আর যে দেশে প্রভাবশালী এমপি-মন্ত্রী কিংবা ক্ষমতাসীন দলের বড় বড় নেতারা এই অপকর্মের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষমতা নেই এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার।
সারা বিশ্ব আমাদের প্রিয় রাজধানী ঢাকাকে ‘মসজিদের শহর’ হিসেবে জানে। এখানে অলিতে-গলিতে অসংখ্য মসজিদ। আছে হাজার হাজার মাদরাসা। সেই মসজিদ-মাদরাসার শহর ঢাকা আজ পরিচিতি পাচ্ছে ‘ক্যাসিনোর শহর’ হিসেবে। এটা আমাদের জন্য শুধু দুর্ভাগ্যজনকই নয়, অনেক বেশি লজ্জার ও গ্লানির।
দুই.
দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, মাদক ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানকে নাম দেয়া হয়েছে ‘শুদ্ধি অভিযান’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের ঘর থেকেই শুরু করেছেন এই অভিযান। প্রথমে তিনি ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অব্যাহতি দিয়েছেন দুর্নীতির অভিযোগে। এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা। পরে ধরেছেন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ অন্য সহযোগী সংগঠনকে। ইতোমধ্যে যুবলীগের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা গ্রেপ্তারের পর দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন। সরিয়ে দেয়া হয়েছে সংগঠনটির সভাপতিকে, যিনি প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়ও হন। সরকারদলীয় হুইপ, প্রভাবশালী সংসদ সদস্যসহ কয়েক ডজন নেতার বিরুদ্ধে চলছে অনুসন্ধান। তাদের অনেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে; বিদেশযাত্রায় এসেছে নিষেধাজ্ঞা।
সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর নেয়া এই উদ্যোগগুলো ঘরে-বাইরে প্রশংসিত হচ্ছে। কতটা অতিষ্ঠ হলে নিজ দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নির্মম আচরণে বাধ্য হতে হয় সেটা প্রধানমন্ত্রীর নেয়া সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত থেকে আঁচ করা যায়। ক্ষমতার রাজনীতিতে পারতপক্ষে কেউ নিজ দলের নেতাকর্মীদের দুর্নীতি ও অপকর্মের বিষয়টি প্রকাশ্যে আনে না। কারণ এতে বিরোধী পক্ষ সুবিধা পেয়ে যায়। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা এতোটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, তাদের লাগাম এখনই টেনে না ধরলে তা যে দলের জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনবে সেটা আঁচ করতে পেরেছেন দলীয় প্রধান। এজন্য তিনি ঘোষণা দিয়েছেন যে যত বড় নেতাই হোক কেউ ছাড় পাবে না। শীর্ষ দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত অনেককে না ধরলেও মধ্যম সারি থেকে যে অভিযান শুর হয়েছে সেটা শীর্ষ পর্যন্ত পৌঁছবে এমনটা বিশ^াস দেশবাসীর। এই অভিযানে প্রধানমন্ত্রী এবং তার দলের ইমেজ নিঃসন্দেহে বাড়ছে। তবে প্রকৃত রাঘব বোয়ালদের না ধরলে এই অভিযানের উদ্দেশ্য এবং সফলতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে।
বর্তমান সরকার ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায়। আর এটা সবার জানা, প্রতিটি দুর্নীতি ও অনিয়মের পেছনেই ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয় থাকে। যারা দশ বছর ধরে ক্ষমতায় তারা নানা জায়গায় শক্তিশালী হয়ে বসে আছেন। সুযোগ পেলে তারা দুর্নীতি ও অনিয়ম করবেন-এটা খুবই স্বাভাবিক। এটা শুধু এই সরকারের আমলে নয়, সব সরকারের আমলেই ক্ষমতাসীন দলের লোকজনই সাধারণত এসব অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ছিল একটি দল পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পর তাদের পরিবর্তন হতো এবং আরেক দল ক্ষমতায় আসত। এতে ঘাঁপটি মেরে শক্তিশালী হয়ে বসে অনিয়ম করার সুযোগ পেত না সুযোগ সন্ধানী চক্রটি। তাদের ভেতরে ক্ষমতার পালাবদল হলে ধরা খাওয়ার একটা ভয় কাজ করতো। এজন্য তাদের দুর্নীতি ও অনিয়মের মাত্রাটি ছিল অনেকটা সহনীয়। কিন্তু রাজনীতির সেই ভারসাম্য আর এখন নেই। পরপর দুবার ক্ষমতায় থাকার পর তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসা এবং আগামী পাঁচ বছর নির্বিঘœভাবে ক্ষমতায় থাকার অনেকটা গ্যারান্টি পেয়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের চক্রটি বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে।
সাধারণত চাঁদাবাজি, জবরদখল, টেন্ডারবাজি, কমিশন বাণিজ্য এসব দিয়েই ক্ষমতাসীন দলের নেতারা রাতারাতি বড়লোক হয়ে যান। একটা পর্যায় পর্যন্ত তাদের এসব কর্মকা-কে সবাই সহনীয়ই ধরে নেন। রাজনীতি করতে হলে এসব টুকটাক করতে হয় এটা মনেই করা হয়। কিন্তু যখন এটা স্বাভাবিকের মাত্রা অতিক্রম করে তখনই দেখা দেয় বিপত্তি। আওয়ামী লীগ টানা দুবার ক্ষমতায় থাকাকালে এটা কিছুটা স্বাভাবিক পর্যায়ে থাকলেও বর্তমানে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর তা অস্বাভাবিক আকার ধারণ করেছে। এতোটাই মাত্রা ছাড়িয়েছে যে, খোদ সরকারপ্রধান এবং দলীয় প্রধানকে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে নিজ দলে শুদ্ধি অভিযান চালানোর।
কিন্তু কথিত এই শুদ্ধি অভিযানে রাজনীতি পরিশুদ্ধ হবে কতটুকু? সাময়িক এই অভিযান আর ধরপাকড়ে সবাই পরিশুদ্ধ হয়ে যাবে? দুর্নীতি আর অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাওয়ার এই সংখ্যাটি গত কয়েক বছরে হু হু করে বেড়েছে। দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা ইতোমধ্যে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে বলে বিভিন্ন তথ্যে জানা যাচ্ছে। ক্ষমতাকে পুঁজি করে অবৈধ উপায়ে ধনসম্পদের মালিক হয়ে যাওয়ার যে প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে সেটা রোধ করা না গেলে সাময়িক এই অভিযানে তেমন কোনো সুফল আসবে না।
সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি মূল্যবান কথা বলেছেন। তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের বলেছেন, চাহিদা সীমিত রাখতে। অন্যেরটা দেখে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হতে। মূলত এই অসম প্রতিযোগিতার কারণেই আমাদের সমাজে নীতি-নৈতিকতা দিন দিন হারাতে বসেছে। অন্যের বাড়ি-গাড়ি, সম্পদ আর চাকচিক্য দেখে দেখে সবার ভেতরে একটা খাইখাই ভাব চলে এসেছে। যারা যেভাবে সুযোগ পাচ্ছে সম্পদ বানিয়ে নিচ্ছে। এটা বৈধ নাকি অবৈধ সেটা বিবেচনার মতো বোধশক্তি নেই বললেই চলে।
নীতি-নৈতিকতাহীন অসৎ এই সমাজব্যবস্থাকে পরিশুদ্ধ করতে হলে সবার আগে দরকার জবাবদিহিতা বোধ। রাষ্ট্রযন্ত্র চাইলেও সব নাগরিকের ভেতরে এই বোধ জাগাতে পারবে না। এর জন্য দরকার ধর্মীয় মূল্যবোধ। সাচ্ছন্দের সঙ্গে জীবনযাপনের জন্য মানুষের অর্থকড়ির প্রয়োজন আছে। তবে এই চাহিদার একটা মাত্রা আছে। নীতি-নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ মানুষের মধ্যে সেই মাত্রাটি টেনে দেয়। যারা এসবের ধার-ধারে না তারাই মূলত লাগামছাড়া জীবনযাপন করে। এজন্য সবার আগে দরকার ধর্মীয় অনুশাসন প্রতিষ্ঠা। আর এই কাজটি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যত বেশি হবে ততই রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গল।