জহির উদ্দিন বাবর
সম্প্রতি দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে মূলভবনের সামনে ফোয়ারার মধ্যে এক নারীর একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। এটি গ্রিক দেবী থেমিসের মূর্তি। তার ডান হাতে তলোয়ার বাম হাতে দাঁড়িপাল্লা। তলোয়ারটি নিচের দিকে নামানো। সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষের দাবি এটি নাকি ন্যায়বিচারের প্রতীক। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে নাকি আদালত প্রাঙ্গণে এই ভাস্কর্যটি আছে। তবে অন্যান্য দেশে ভাস্কর্যের গায়ে স্কার্ফ পরা থাকলেও এখানে শাড়ি পরানো হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য দেশে পায়ের নিচে সাপ থাকলেও এখানে এটি বাদ দেয়া হয়েছে।
উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়, রোমানদের কাছে এটি ন্যায়বিচারের দেবী। দেবীর চোখ বাঁধা রয়েছে। এর অর্থ হলো-একজন বিচারক পক্ষপাতিত্ব করবেন না। তার কাছে সবাই সমান। দেবীর বাম হাতে দাঁড়িপাল্লা আছে। এর অর্থ হলো- একজন বিচারক সবার মাঝে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। দেবীর ডান হাতে রয়েছে তলোয়ার। এর অর্থ হলো অন্যায়কারীকে একজন বিচারক দণ্ড প্রদান করবেন।
একটি মুসলিম দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সামনে ভাস্কর্য তথা মূর্তি স্থাপনের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন দেশের আলেম-ওলামা ও তৌহিদি জনতা। হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামি দলগুলো এই ইস্যুতে আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সরকারও এই ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে আছে অস্বস্তিতে। সরকার সরাসরি আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারছে না। তবে সরকারের মনোভাব হলো এই ইস্যুতে আন্দোলন হোক এবং ভাস্কর্যটি সরে যাক। কারণ এটি একটি রাজনৈতিক সরকারের বিরুদ্ধে পরবর্তী সময়ে ইস্যু হতে পারে।
যে দেশের প্রায় ৯০ ভাগ মুসলমান সে দেশে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে গ্রিক দেবীর মূর্তি স্থাপন মেনে নেয়ার মতো না। যাদের মধ্যে ন্যূনতম ঈমানি বোধ আছে এবং ইসলামের স্বাতন্ত্র ঐতিহ্য সম্পর্কে যারা ধারণা রাখেন তারা কখনও এটা মেনে নিতে পারেন না। কারণ জাতি হিসেবে এটা আমাদের জন্য চরম দেউলিয়াত্বের বহিঃপ্রকাশ। এর অর্থ হচ্ছে আমাদের নিজস্ব কোনো ন্যায়বিচার বা আইনের ইতিহাস নেই। আমাদের বিশ্বাস বা ঈমানের কোনো মূল্য নেই; গ্রিক দেবীই আমাদের একমাত্র আরাধ্য। এতদিন আমাদের সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে এই মূর্তিটি ছিল না, তাই বলে কি সেখানে ন্যায়বিচার ছিল না? এখন মূর্তি স্থাপন করে ন্যায়বিচার ফিরিয়ে আনতে হবে?
মুসলমানরা স্থাপত্যকলা ও শিল্পকলার বিরুদ্ধে নয়। শিল্পকলা মুসলিম ঐতিহ্যের একটি অংশ। প্রাণহীন বস্তুর শিল্পকলা ও স্থাপত্যে ইসলামের কোনো বাধা নিষেধ নেই। কিন্তু গ্রিক দেবীর মূর্তি স্থাপন ইসলাম কোনোভাবেই সমর্থন করে না। গ্রিকপুরাণের কল্পিত দেবী থেমিস রোমানদের কাছে ন্যায়ের প্রতীক হতে পারে, আমাদের কাছে তো নয়। আমাদের সামনে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে আছে মহাগ্রন্থ আল কুরআন। পৃথিবীর ইতিহাসে এর চেয়ে ন্যায়বিচারের যথার্থ প্রতীক আর কিছু হতে পারে না। এজন্য দেশের তৌহিদি জনতার দাবি, আদালত প্রাঙ্গণে কোনো শিল্পকলা বা ভাস্কর্য স্থাপন করতে হলে সেটা হবে আল কুরআন, কোনোক্রমেই গ্রিক দেবী নয়।
সর্বোচ্চ আদালতে গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য স্থাপন উপমহাদেশে বাংলাদেশেই প্রথম। পাশের দেশ ভারতে পৌত্তলিকতার প্রাধান্য থাকা সত্ত্বেও সেখানে নেই এই প্রতীক। পাকিস্তানে তো এই ধরনের কিছু স্থাপনের প্রশ্নই আসে না। একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র নেপালেও নেই এই দেবীর মূর্তি। এমনকি শ্রীলঙ্কা-মিয়ানমারেও নেই তথাকথিত ন্যায়বিচারের এই প্রতীক। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র ইরানে ১৯৬৪ সালে কুখ্যাত শাহ প্রথমবারের মতো সুপ্রিম কোর্টের সামনে পাশ্চাত্যের অনুকরণে গ্রিক বিচারের দেবী থেমিসের মূর্তি স্থাপন করেছিল। একমাত্র এ উদাহরণটি বাদে এ পর্যন্ত মুসলিম দেশের শাসকরা যত মন্দই হোক না কেন আদালতের সামনে দেবীমূর্তি স্থাপনের মতো চরম ইসলামবিরোধী কর্মটি করেননি বা করতে সাহস পাননি। অথচ বাংলাদেশের মতো দ্বিতীয় একটি মুসলিম রাষ্ট্রে আজ দুঃসাহসিক এই অপকর্মটি করা হলো। কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোনো কিছু করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এই সরকারের আমলে এমন কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কাজ কিভাবে হলো সে জবাব এই সরকারকে একদিন না একদিন দিতে হবে।
অনেকে এর পক্ষে নানা যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ বলছেন এটা ভাস্কর্য, মূর্তি নয়। ইসলামে মূর্তির যে ধারণা কোনোক্রমেই এটা এর চেয়ে বাইরের কিছু নয়। ইসলামের আগমন পৌত্তলিকতার বিনাশের জন্য। পৌত্তলিকতার ক্ষেত্রে কোনো আপসের সুযোগ ইসলামে নেই। যাদের ঈমান আছে, ইসলামে যারা বিশ্বাস করেন তাদের পৌত্তলিকতার পক্ষে সাফাই গাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে এ ধরনের মূর্তি স্থাপনে যেকোনো ধরনের সহযোগিতা ঈমান ও বিশ্বাসের পরিপন্থী।
কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন সামান্য এই একটি ভাস্কর্যের দ্বারা কী আসে যায়। কিন্তু এটা সামান্য বিষয় নয়, এটা মেনে নেয়া মানে পৌত্তলিকতার সঙ্গে আপস করা। যে পৌত্তলিকতার রাহুগ্রাস থেকে মানবতাকে মুক্ত করে মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সা. দুনিয়াতে এসেছিলেন সেই পৌত্তলিকতা মেনে নেয়া হচ্ছে রাসুলের আগমনকে অস্বীকার করা। কেউ এটা করলে তাকে ঈমানের গণ্ডিতে গণ্য করার সুযোগ থাকে না। একটি মুসলিম দেশের বিচার বিভাগের প্রধান ভিন্ন ধর্মের কেউ হতে বাধা নেই। কিন্তু সেই প্রধান ব্যক্তিটি যদি কৌশলে সর্বোচ্চ আদালতে নিজের ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটান তা মেনে নেয়া যায় না। আমার ঈমান ও বিশ্বাস এর বিরুদ্ধে অবস্থানের কথা বলে। এজন্য সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে স্থাপিত গ্রিক মূর্তির বিরুদ্ধে কথা বলা ঈমানের দাবি। দল-মত নির্বিশেষে সবার এর প্রতিবাদ করা উচিত।