সেই ঈদ এই ঈদ

eid-ul-fiten-8রাসূল সা. যখন মক্কা থেকে মদিনায় এলেন হিজরত করে, দেখলেন সেখানকার ইহুদীরা ঈদ পালন করে। ঈদকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে আনন্দ ও খুশির বাঁধভাঙা জোয়ার বয়ে যায়। সে সময় রাসূল সা.ও ইসলামে দুটি ঈদের ঘোষণা দিলেন। তবে মুসলমানের ঈদ নিছকই ঈদ নয়, ইবাদতও বটে। মুসলমানের সামগ্রিক কাজই যে ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ এই ঈদ। ইসলাম প্রবর্তিত সেই ঈদ মদীনার অলিতে-গলিতে নিয়ে আসত অনাবিল আনন্দের জোয়ার। সাহাবায়ে কেরাম প্রকৃত অর্থেই ঈদের আনন্দ ও বিনোদন ভাগ করে নিতেন নিজেদের মাঝে। স্বচ্ছ-নির্মল সেই আনন্দে কোনো আবিলতা ছিল না, ছিল মুক্তপ্রাণের উচ্ছ্বাস। সব বেদনা ও গ্লানি মুছে যাওয়ার যাদুকরী প্রলেপ। প্রতীক্ষার ঈদ প্রকৃত অর্থেই ঈদ হয়ে আসত মুসলমানদের ঘরে ঘরে।

মদীনায় প্রবর্তিত সেই ঈদ চন্দ্রমাসের প্রাকৃতিক আবর্তে আজও যথা নিয়মেই আসে আমাদের দুয়ারে। আগের মতোই বছরে দুটি ঈদ আমরা পালন করি। কিন্তু মদীনার সেই ঈদের সঙ্গে আজ আমরা যে ঈদ পালন করি তার কোনো মিল নেই। ঈদ আর আমাদের কাছে ঈদ হয়ে আসে না। অনেকের কাছে ঈদ আসে বিষাদ ও জ্বালার বস্তু হয়ে। পবিত্র ও মুক্ত যে আনন্দের কথা ঈদের সঙ্গে কল্পনা করি তার কোনো উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না। বিশেষত মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর ঈদ মানেই জীবন সংগ্রামে বিপর্যস্ত সৈনিকের ওপর বাড়তি বোঝা, অনাহুত চাপ। দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নির্বাহে যারা হিমশিম খায় তাদের কাছে অতিরিক্ত খরচের বোঝা হয়ে যখন ঈদ আসে তখন তা কামনাহীন ও নিস্পৃহ হিসেবেই ঠেকে। পরিবারের কর্তা ব্যক্তিটি তখন হাড়ে হাড়ে টের পান ঈদ নামের চাপিয়ে দেয়া বস্তুটি মানসিকভাবে তাকে কিভাবে বিক্ষত করছে। অগ্নিমূল্যের লাগামহীন বাজার ব্যবস্থার এই নীতিহীন দেশে কারো জীবনেই ঈদ স্বস্থি ও স্বাচ্ছন্দের উৎসব নয়। ঐতিহ্যের টানে, সামাজিক দায়বদ্ধতায় ঈদের বাহ্যিক অবয়বটি হয়ত সবার থেকে প্রকাশ প্রায়-কিন্তু স্বতস্ফূর্ততা ও অনাবিল আনন্দের উচ্ছ্বাসে মুখর কাক্সিক্ষত সেই ঈদের আর দেখা মিলে না।

ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবে নির্মল আনন্দে মেতে ওঠার একটা ঐতিহ্য বাঙালি মুসলমানদের রয়েছে। জাতি হিসেবে আমরা বরাবরই আবেগপ্রবণ ও উৎসববিলাসী। উপলক্ষ যাই হোকÑসৌহার্দ্যপূর্ণ পারিবারিক ব্যবস্থা এবং সামাজিকতার প্রগাঢ় বন্ধনের কারণে আনুষ্ঠানিকতার বিষয়টি আমাদের কাছে অধিক গুরুত্ব পায়। সুস্থ ও গতিশীল সমাজব্যবস্থার জন্য এর প্রয়োজন আছে। তবে অপ্রয়োজনীয় বাড়তি মাতামাতি ও বাহুল্য নিমগ্নতার কারণে যে কোনো উৎসবের প্রকৃত আবেদনটা যাতে ম্লান না হয়ে যায় সে দিকেও দৃষ্টি রাখা জরুরি। অন্যথায় উৎসবের বাহ্যিক অবয়ব টিকে থাকলেও এর কোনো প্রাণ থাকে না। আমেজ ও প্রতিফলনের কাক্সিক্ষত রূপটি খুঁজে পাওয়া যায় না। বাঙালি মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক অনেক উৎসবই আজ নিষ্প্রাণ ও নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে এ কারণে। উৎসব আছে, এর কোনো প্রাণ নেই; মাতামাতি আছে, কিন্তু মূল আবেদন হারিয়ে গেছে।

Eid-kids-69এখনকার ঈদ প্রকৃত ঈদ হয়ে না আসার পেছনে কারণ অনেক। প্রধানত ঈদকেন্দ্রিক আমাদের যে আচরণ তা ঈদের সহজাত আনন্দধারার সহায়ক নয়। সময়ের পটপরিবর্তন, মানুষের চাহিদা ও যোগানের বাস্তবতা এবং নানা আবিলতা যুক্ত হয়ে যাওয়ায় ঈদের মূল স্পিরিট হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। এখনকার মানুষের চাহিদার পরিধি অনেক বি¯তৃত। অথচ যোগানের সামর্থ্য সবার সমান নয়। চাহিদা ও যোগানের এই টানাপোড়েনের কারণে যে কোনো উৎসবের আনন্দটাই ফিকে হয়ে যায়। জীবনযাত্রার মান আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। মানুষের ক্রয়-ক্ষমতাও বেড়েছেÑকিন্তু বর্তমান চড়া ও ঊর্ধ্বগতির বাজারমূল্যের তুলনায় তা অনেক পিছিয়ে। পিছিয়ে থাকা ও অক্ষমতার এই যে খেদ তার দংশনেই তো আজকের মানুষ কাতর, ঈদের নির্মল আনন্দটা উপভোগ করবে কিভাবে। মদীনার অলিতে গলিতে ঈদআনন্দের স্বতস্ফূর্ত ও নির্মল যে ধারার কথা চিন্তা করি সেখানে এই টানাপোড়েন ও খেদ ছিল না। তাদের চাহিদা ছিল সীমিত, যা তাদের সাধ্যের আনুকূল্যে। অথচ আজ আমরা আমাদের সাধ্যের চেয়ে অধিক কিছু পেতে আকুল হয়ে থাকি। একশ টাকা দামের ঈদ পোশাক কেনার সামর্থ্য আমার নেইÑঅথচ পাঁচশ টাকা দামের পোশাকের প্রতি আমার নজর। ডাল-ভাত যোগাতে আমাকে হিমশিম খেতে হয়Ñঅথচ ঈদ উপলক্ষে চাইনিজ-ভোজনে লালায়িত হয়ে পড়ি। উচ্চবিলাস ও উচ্চাকাক্সক্ষার কারণেই আমাদের ঈদ আর প্রকৃত ঈদ হয়ে আসে না।

সংযমের মাস রমজান পালন শেষে যে ঈদ উদযাপন করি তাতেও সংযমতার ছাপ থাকাটা ছিল প্রত্যাশিত। কারণ রমজানের প্রকৃত শিক্ষাই হলো সংযম। এই সংযম শুধু এক মাসের নয়Ñসারা বছরের জন্য। ঈদের মূল প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয় এই সংযমের মাসে। অথচ ঈদপ্রস্তুতির ক্ষেত্রে আমাদের থেকে সংযমটা পুরোপুরি প্রকাশ পায় না। ঈদকে কেন্দ্র করে রমজানের প্রথম থেকেই যে মাতামাতি শুরু হয় তাতে ক্ষেত্রবিশেষে অসংযত ও উম্মাদনার পরিচয় দিই। ঈদ উপলক্ষে চাহিদার যে বিশাল ফিরিস্তি তৈরি করা হয় তা নির্বাহের জন্য অনেকেই সংযমের মাস রমজানে অবৈধ ও অসমর্থিত পন্থা অবলম্বন করে থাকেন। বাড়তি ইনকামের অন্যায় ও অবৈধ পথ খুঁজে বের করেন। যারা চাইলেও এসব পথের সন্ধান পায় না তারা অন্তজ্ব্র্ালায় ক্ষত-বিক্ষত হন। এসব পথ পরিহার করে যারা স্বচ্ছ ও নিষ্কন্টক থাকতে চান তারাও অন্যদের ঈদ আয়োজনের প্রতিযোগিতা এবং নিজের অক্ষমতা দেখে মনের কোণে কষ্টের আছড় অনুভব করেন। অসংলগ্ন ও খাপছাড়া সামাজিক এই উদ্ভূত কালচার আমাদের সমাজের ঈদের নির্মল আনন্দ ও স্বতস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসের প্রধান অন্তরায়।

Related posts

*

*

Top